সুনীল ছেত্রীদের ভাগ্য নির্ধারণ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভারতীয় দলে কোন ফুটবলার খেলবেন, তা নাকি ঠিক করে দেন এক জ্যোতিষী! সুনীল ছেত্রীরা কেমন খেলেন তার উপর দল নির্বাচন হয় না। কোচ ইগর স্তিমাচ ফুটবলারদের ঠিকুজি-কুষ্ঠি দিয়ে দেন এক জ্যোতিষীকে। তিনি বলে দেন, কোন ম্যাচে কোন ফুটবলারের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। তাঁকেই প্রথম একাদশে রাখেন স্তিমাচ।
এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের আগে স্তিমাচ বার্তা পাঠিয়েছিলেন দিল্লির জ্যোতিষী ভূপেশ শর্মাকে। তাঁর সঙ্গে স্তিমাচের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় ফুটবল সংস্থার কর্তারাই। এমনটাই জানাচ্ছে একটি ইংরাজি দৈনিক। ৯ জুন স্তিমাচ সেই জ্যোতিষীকে লিখেছিলেন, “১১ জুন রাত সাড়ে ৮টা থেকে ম্যাচ শুরু। সেই খেলার জন্য ফুটবলারদের তালিকা পাঠালাম। এখানে সব তথ্য রয়েছে।” যে তালিকার কথা স্তিমাচ বলেছেন সেটি আসলে ভারতের প্রথম একাদশ। চোটের কারণে ভারতীয় দল সেই সময় বিপর্যস্ত। ওই দিন আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচ ছিল ভারতের। ওই ম্যাচটি জিততেই হত যোগ্যতা অর্জন করার জন্য।
স্তিমাচের বার্তা পাঠানোর এক ঘণ্টার মধ্যে উত্তর দেন ভূপেশ। প্রত্যেক ফুটবলারের নামের পাশে সেই জ্যোতিষী নিজের মতামত লেখেন। ভূপেশ কারও নামের পাশে লেখেন, “ভাল”, কারও নামের পাশে, “অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস না দেখালে ভাল খেলবে”, কারও পাশে লেখা, “ভাল দিন, তবে খুব আগ্রাসী হয়ে যাবে।” ১১ জুন ম্যাচ শুরুর এক ঘণ্টা আগে যখন দল ঘোষণা হচ্ছিল, সেই সময় দু’জন ফুটবলার বাদ পড়েন। জ্যোতিষীর মতে সেই দিন তাঁদের ভাগ্য ভাল ছিল না বলে দলে জায়গা হয়নি সেই দুই ফুটবলারের।
এটা এক বারের ঘটনা নয়, একাধিক বার ঘটেছে। গত বছর মে-জুন মাসে স্তিমাচ এবং জ্যোতিষীর মধ্যে ১০০-র বেশি বার্তা আদানপ্রদান হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। সেই সময় ভারত জর্ডনের বিরুদ্ধে প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল। সেই সঙ্গে এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে খেলেছিল কাম্বোডিয়া, আফগানিস্তান এবং হংকংয়ের বিরুদ্ধে। ম্যাচের আগে স্তিমাচের সঙ্গে জ্যোতিষীর কথাবার্তা শুধু যে ফুটবলারদের যোগ্যতা অনুযায়ী সুযোগ পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে তা-ই নয়, দলের ভিতরের খবর চলে যাচ্ছে এক জন বাইরের লোকের কাছে।
স্তিমাচ শুধু দল নির্বাচন নয়, জ্যোতিষীর পরামর্শ মেনে ম্যাচের মাঝে খেলোয়াড় পরিবর্তন করতেন বলেও জানা গিয়েছে। এছাড়া ফুটবলারদের জন্ম তারিখ, সময়, স্থান জানিয়ে দিতেন জ্যোতিষীকে। এক ফুটবলারের সময় খারাপ জানতে পারলে, তাঁর বদলে কাকে খেলানো যাবে সেটাও ঠিক করতেন ভূপেশের পরামর্শ মেনেই। ফুটবলারদের চোট সারতে কত দিন সময় লাগবে তা-ও জানতে চেয়েছেন জ্যোতিষীর কাছে। একাধিক ফুটবলারের তথ্য দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন তাঁদের মধ্যে কাকে খেলালে ভাল ফল পাওয়া যাবে। জর্ডনের বিরুদ্ধে হেরে গিয়েছিল ভারত। সেই ম্যাচের স্তিমাচ সেই জ্যোতিষীকে লেখেন, “কোনও অসুস্থ ফুটবলারের ভাগ্য ভাল থাকলেও তাঁকে খেলাতে পারব না। সেটা উচিত হবে না।” উত্তর আসে, “ঠিকই। এরকম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শরীর কতটা সুস্থ সেটা দেখতে হবে। শারীরিক ভাবেও আমরা পিছিয়ে অনেকের থেকে। ফুটবলে ভারতের ইতিহাস জঘন্য। ক্রিকেটেও অনেক বছর সময় লেগেছে এই জায়গায় পৌঁছতে।”
কলকাতায় ৮ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্ব ছিল। সেই সময় প্রতিটি ম্যাচের দু’দিন আগে আলোচনা করতেন স্তিমাচ এবং ভূপেশ। সেই সময় প্রথম একাদশ থেকে ফুটবলারদের সুস্থ হয়ে ওঠার সময়, সব কিছু নিয়েই আলোচনা হত তাঁদের। সে বার এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের তিনটি ম্যাচেই জিতেছিল ভারত। কাম্বোডিয়াকে ২-০ গোলে হারিয়েছিল তারা। আফগানিস্তানকে হারিয়েছিল ২-১ গোলে। হংকংকে হারিয়েছিল ৪-০ গোলে।
ওই সংবাদমাধ্যমের তরফে জ্যোতিষীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। যে সময় এই ঘটনা ঘটেছিল, সেই সময় ভারতীয় ফুটবল সংস্থার প্রধান ছিলেন প্রফুল্ল পটেল। তিনি এই বিষয়ে কিছু জানতেন না বলে জানিয়েছেন। ২০২২ সালে স্তিমাচের সঙ্গে ভূপেশের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন সচিব কুশল দাস। তিনি বলেন, “একটা বৈঠকে দেখা হয়েছিল ভূপেশের সঙ্গে। বলিউডের অনেকের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি। জ্যোতিষের মাধ্যমে ফুটবলারদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।” স্তিমাচকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোচ বলেন, “আমাকে বলা হয়েছিল ভূপেশ দলের উন্নতি করবে। এটা আমাকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল। তার বেশি কিছু নয়। আমি এক জন বিদেশি সহকারী কোচ চেয়েছিলাম। সেটা পাইনি।” কুশল বলেন, “দু’মাসের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ভূপেশকে। তার জন্য ১২ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। ভারত এশিয়ান কাপে যোগ্যতা অর্জন করেছে। সেটা অনেক বড়।”
ইতিমধ্যেই স্তিমাচকে শো কজ করেছেন ভারতীয় ফুটবল সংস্থা। এক সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্যে কারণ দর্শানোর বিজ্ঞপ্তি (শো-কজ়) দেওয়া হল ভারতীয় ফুটবল দলের কোচ ইগর স্তিমাচকে। তাঁকে এই বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে ভারতীয় ফুটবল সংস্থা (এআইএফএফ)। তারা জানিয়েছে, বিতর্কিত মন্তব্য করে চুক্তি ভেঙেছেন স্তিমাচ।