Mohun Bagan

১০ কারণ: হারের হ্যাটট্রিকের ধাক্কা কাটিয়ে লিগ-শিল্ড জয়, কোন জাদুতে ভারতসেরা মোহনবাগান

২০২৩-২৪ সালের আইএসএলে লিগ-শিল্ড জিতল মোহনবাগান। শেষ ম্যাচে ঘরের মাঠে মুম্বই সিটি এফসিকে হারাল তারা। কোন জাদুতে ভারতসেরা হল মোহনবাগান?

Advertisement
দেবার্ক ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৪৪
লিগ-শিল্ড জয়ের পর মোহনবাগান ফুটবলারদের উচ্ছ্বাস।

লিগ-শিল্ড জয়ের পর মোহনবাগান ফুটবলারদের উচ্ছ্বাস। ছবি: পিটিআই।

যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে রেফারি খেলা শেষের বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে যেন বোমা ফাটল। শব্দ-বোমা। প্রায় ৫০ হাজার সবুজ-মেরুন সমর্থক একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন। এই মুহূর্তটার জন্যই তো গ্যালারি ভরিয়েছিলেন তাঁরা। একটাই প্রার্থনা। প্রিয় দল যেন লিগ-শিল্ড জেতে। সেটাই করে দেখালেন সবুজ-মেরুন ফুটবলারেরা। আইএসএলের ১০ বছরের ইতিহাসে যে মুম্বই সিটি এফসিকে মোহনবাগান এক বারও হারাতে পারেনি, সেই দলকেই ২-১ গোলে হারাল তারা। খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার আধ ঘণ্টা পরেও যুবভারতীর গ্যালারি কানায় কানায় ভর্তি। কেউ যেন ফিরতেই চাইছেন না। আনন্দে নাচছেন আট থেকে আশি। বেশির ভাগেরই চোখে জল। দলের লিগ-শিল্ড জয় দেখে মাঠ ছাড়তে চাইছেন তাঁরা। এই রাত যেন তাঁদের ফুরনোর নয়। মোহনবাগান অধিনায়ক শুভাশিস বসু যখন ভারতের ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কল্যাণ চৌবের হাত থেকে লিগ-শিল্ড নিলেন তখন শব্দের ডেসিবল আরও বাড়ল। তা বেড়েই চলল দলের শিল্ড জয়ের উৎসবের সঙ্গে।

Advertisement

ম্যাচে শুরুতেই যুবভারতীতে দেখা গিয়েছিল একটি বিশাল টিফো। সেখানে দলের ফুটবলারেরা একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে। উপরে লেখা, “চলো একসঙ্গে আমরা করে দেখাই।” কিছুটা দূরে আর একটি টিফোতে শোলের সেই বিখ্যাত দৃশ্য। মোটরবাইকে বসে জয়-বীরু। খালি বদলে গিয়েছে চরিত্রদের মুখ। অমিতাভ বচ্চন ও ধর্মেন্দ্রর জায়গায় সেখানে জেসন কামিংস ও আর্মান্দো সাদিকু। সত্যিই তো, একসঙ্গে না খেললে এই জয় সম্ভব ছিল না। খেলা শেষে বাগান ফুটবলারদের মুখে বার বার ফিরে এল সেই দলের কথা। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধার কথা। একসঙ্গে ভারতসেরা হওয়ার কথা।

অথচ গত বছর ডিসেম্বর মাসে পর পর তিনটি ম্যাচ হেরে লিগ-শিল্ডের লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়েছিল মোহনবাগান। সেখান থেকে কী ভাবে ফিরে এল তারা? মোহনবাগানের ভারতসেরা হওয়ার নেপথ্যে ১০ কারণ খুঁজল আনন্দবাজার অনলাইন।

১) মরসুমের মাঝে কোচবদল— গত বছর বাগানকে আইএসএল জিতিয়েছিলেন জুয়ান ফেরান্দো। এ বারও শুরু থেকে তিনিই কোচ ছিলেন। কিন্তু মুম্বই, গোয়া ও কেরলের কাছে হারের পরেই কোচ বদল করার সিদ্ধান্ত নেয় বাগান ম্যানেজমেন্ট। এক জন আইএসএল জয়ী কোচকে মরসুমের মাঝে এ ভাবে সরিয়ে দেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন তাঁরা। তবে আগে থেকে একটি বিকল্প তৈরি করে রেখেছিলেন তাঁরা। ভারতীয় ফুটবলে পোড়খাওয়া কোচ আন্তোনিয়ো লোপেজ় হাবাসকে মরসুমের শুরু থেকেই জুড়ে দেওয়া হয়েছিল ফেরান্দোর সঙ্গে। টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হাবাস আগে থেকেই দলের ফুটবলারদের চিনতেন। তাই যখন ফেরান্দোকে সরিয়ে তাঁকে কোচ করা হয়, দলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লাগেনি তাঁর।

২) হাবাসের জাদু— ভারতীয় ফুটবলে হাবাস বেশ সফল কোচ। আগে আতলেতিকো দ্য কলকাতাকে দু’বার আইএসএল জিতিয়েছেন তিনি। যাঁরা হাবাসকে চেনেন, তাঁরা বলেন এই স্পেনীয় খুব কড়া ধাঁচের। তাঁর কাছে সবার আগে শৃঙ্খলা। সেটা না মানলে যত বড় নামই হোক না কেন, ছেঁটে ফেলতে দু’বার ভাবেন না তিনি। হাবাস জানেন, লিগ জিততে হলে দলের রক্ষণ সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই মরসুমেও সেটা করেছেন তিনি। তার সঙ্গে আক্রমণের ধারও বাড়িয়েছেন তিনি। নিজের চেনা ছক থেকে বেরিয়ে এসেছেন। চলতি মরসুমে মোহনবাগান সব থেকে বেশি গোল করেছে। এই পরিসংখ্যানই বল দিচ্ছে হাবাসের কৃতিত্ব। সব থেকে বড় কথা দলকে এক ছাতার তলায় এনেছেন তিনি। সবাই সেখানে সবার সঙ্গে খেলেছে। একে অপরের সাফল্যে আনন্দ করেছে। একটি দল হিসাবে খেলেছে মোহনবাগান। সেখানেই তারা বাকিদের টেক্কা দিয়েছে। তাই তো লিগ-শিল্ড জিতে বাগান ফুটবলারেরা বলে দিলেন, হাবাসের মতো কড়া স্যরকেই তাঁরা চান।

৩) দলের ছয় বিদেশির ধারাবাহিকতা— এ বার মোহনবাগানের বিদেশি ফুটবলারেরা নজর কেড়েছেন। রক্ষণে ছিলেন হেক্টর ইয়ুস্তে ও ব্রেন্ডন হামিল। মাঝমাঠে জনি কাউকো ও দিমিত্রি পেত্রাতোস। আক্রমণে জেসন কামিংস ও আর্মান্দো সাদিকু। এই ছয় বিদেশির মধ্যে কাউকো ও পেত্রাতোস ছিলেন প্রথম একাদশের নিয়মিত সদস্য। রক্ষণ ও আক্রমণে এক জন করে শুরু করেছেন প্রতি ম্যাচে। তবে সবাইকে সুযোগ দিয়েছেন হাবাস। প্রত্যেকের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল। কামিংস বা সাদিকু, যখনই সুযোগ পেয়েছেন গোল করার চেষ্টা করেছেন। দু’জনের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা চলেছে। রক্ষণের দুই ফুটবলারকেও অদল-বদল করে খেলিয়েছেন কোচ। দীর্ঘ লিগ হওয়ায় প্রত্যেককে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে। মাঝে একটা সময় কামিংস গোল পাচ্ছিলেন না। অনেক সবুজ-মেরুন সমর্থক তাঁর সমালোচনা করলেও কোচ ভরসা রেখেছেন। লিগ-শিল্ডের জয়সূচক গোল কিন্তু এসেছে কামিংসের পা থেকেই।

৪) কাউকোর অন্তর্ভুক্তি— মরসুমের শুরু থেকে কাউকো দলে ছিলেন না। তখন খেলতেন হুগো বুমোস। গত মরসুম থেকেই বাগান কোচ ফেরান্দো ও ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বুমোসের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছিল। তার পরেও এ বার শুরু থেকে রেখে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু বুমোসের খেলা ক্রমে খারাপ হচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, খেলার তেমন ইচ্ছাই নেই তাঁর। হাবাস কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পরেই বুমোসকে বাদ দিয়ে কাউকোকে দলে নেন। নরওয়ের ফুটবলার কাউকো এই দলে মিডফিল্ড জেনারেলের কাজ করেছেন। মোহনবাগানের সব আক্রমণ শুরু হয়েছে কাউকোর পাস থেকে। যেমন ডিফেন্স চেরা পাস বাড়িয়েছেন, তেমনই প্রয়োজনে গোল করেছেন। আক্রমণের পাশাপাশি রক্ষণেও নেমেছেন। রক্ষণ ও আক্রমণের মাঝে একটি অদৃশ্য সুতোর কাজ করেছেন কাউকো। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, মরসুমের মাঝে তাঁকে দলে নিয়ে সঠিক কাজই করেছেন হাবাস।

৫) দিমিত্রি পেত্রাতোস— আলাদা করে বলতে হয় এই অস্ট্রেলীয় ফুটবলারের কথা। গোটা মরসুম জুড়ে বাগানের সব থেকে ধারাবাহিক ফুটবলার তিনি। প্রতিটি ম্যাচে খেলেছেন। গোল করেছেন, করিয়েছেন। এই দলে পেত্রাতোসের কোনও নির্দিষ্ট জায়গা নেই। গোটা মাঠ জুড়ে খেলেন। প্রয়োজনে রক্ষণে নামেন। দলের সব সেট পিস তিনিই নেন। খেলা তৈরি করেন। অনেকটা জায়গা জুড়ে খেলেন তিনি। আবার গোলও করেন। এই মরসুমে মোহনবাগানের হয়ে সব থেকে বেশি ১০টি গোল করেছেন পেত্রাতোস। করিয়েছেন ৬টি। ফাইনালে কোনও গোল না করলেও তিনিই ম্যাচের সেরা হয়েছেন। এই পরিসংখ্যান বুঝিয়ে দিচ্ছে, দলকে ভারতসেরা করতে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি গোল করে সনি নর্দের ‘স্টেনগান’ সেলিব্রেশনকেও ফিরিয়ে এনেছেন পেত্রাতোস।

৬) ভারতীয় ফুটবলারদের লড়াই— কোনও দলকে লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে শুধু বিদেশিদের ফর্মে থাকলে চলবে না। পাশাপশি ভারতীয় ফুটবলারদেরও ভাল খেলতে হয়। সেই কাজটা এ বার করেছেন লিস্টন কোলাসো, মনবীর সিংহেরা। বিশেষ করে নজর কেড়েছেন মনবীর। ৭টি গোল করিয়েছেন তিনি। বাঁ প্রান্ত, ডান প্রান্ত ধরে ক্রমাগত আক্রমণে উঠেছেন। কোলাসো একটা বড় সময় চোটে থাকলেও যখনই সুযোগ পেয়েছেন গোল করেছেন। ফাইনালের প্রথম গোলও এসেছে তাঁর পা থেকে। মুম্বইয়ের রক্ষণকে বোকা বানিয়ে কোলাসো যে গোলটি করেছেন তা যে কোনও ফুটবলারের স্বপ্ন। সাহাল আব্দুল সামাদ ও আশিক কুরুনিয়নের মতো দু’জন জাতীয় দলে খেলা ফুটবলারকে মরসুমের অনেকটা সময় পায়নি বাগান। তার পরেও তাদের সমস্যা হয়নি। কারণ, অনিরুদ্ধ থাপা, শুভাশিস বসু, আনোয়ার আলি, আশিস রাই, কিয়ান নাসিরি, গ্লেন মার্টিন্সরা লড়াই করেছেন। সুযোগ পেয়ে অভিষেক সূর্যবংশীর মতো তরুণ ভারতীয় ফুটবলারও নজর কেড়েছেন। বিদেশিদের পাশাপাশি দেশীয় ফুটবলারেরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করায় লিগ-শিল্ড জিতেছে মোহনবাগান।

৭) বিশাল কাইথের ভরসার হাত— গোলের নীচে ভরসা দিয়েছেন বিশাল কাইথ। ভারতীয় এই গোলরক্ষক গত মরসুমেও বাগানকে আইএসএল জিতিয়েছিলেন। ফাইনালে টাইব্রেকারে নায়ক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন কাইথ। এ বার কয়েকটি ম্যাচে তাঁর কিপিং নজর কেড়েছে। বিশেষ করে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ফিরতি ডার্বিতে একটি পেনাল্টির পাশাপাশি দু’টি নিশ্চিত গোল বাঁচিয়েছিলেন তিনি। সেই ম্যাচ ড্র হলে কিন্তু লিগ-শিল্ড জিততে পারত না মোহনবাগান। এ বারের আইএসএলে গোলরক্ষকদের পারফরম্যান্স বিচার করলে নিঃসন্দেহে সেরা কাইথ। দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে বড় ভূমিকা নিয়েছেন তিনি।

৮) প্রাক্‌-মরসুম প্রস্তুতি— এ বারের আইএসএলের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিল বাগান। শিবির করেছিল তারা। গত বারের প্রতিযোগিতা শেষে যেখানে যেখানে ফাঁক ছিল, তা ভরাট করার চেষ্টা করেছে সবুজ-মেরুন। ডুরান্ড কাপ জয় বাগানকে অনেকটা সুবিধা দিয়েছে। মরসুমের শুরুতে একটি সর্বভারতীয় ট্রফি জেতা ফুটবলারদের আত্মবিশ্বাস অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার ফল পরবর্তী প্রতিযোগিতায় পেয়েছে বাগান। কোচও বুঝতে পেরেছেন কোন ফুটবলারকে কোন ম্যাচে তাঁর দরকার। আইএসএলের শুরু থেকেই বোঝা গিয়েছে, বাকি দলগুলির থেকে এগিয়ে রয়েছে সবুজ-মেরুন।

৯) দলের বেশির ভাগ ফুটবলার ধরে রাখা— গত মরসুমে মোহনবাগানে যে ফুটবলারেরা খেলেছিলেন তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই এই মরসুমেও খেলেছেন। কাউকো, পেত্রাতোসরা পুরনো। দলের ভারতীয় ফুটবলারদের বেশির ভাগই এ বারও ছিলেন। শুধু কয়েকটি জায়গায় ফুটবলার নিতে হয়েছিল। তাঁরা এসে একটি তৈরি দলের সঙ্গে খুব সহজে মিশে যেতে পেরেছেন। দলে খুব বেশি বদল না করার ফল পেয়েছে সবুজ-মেরুন। যেখানে বাকি দলগুলিকে নিজেদের প্রথম একাদশ বাছার জন্য কয়েকটি ম্যাচ দেখে নিতে হয়েছে সেখানে মোহনবাগান শুরু থেকেই তৈরি একাদশ খেলাতে পেরেছে।

১০) কর্তাদের নাক না গলানো— বিশ্বের বিভিন্ন সফল ক্লাব দেখলে বোঝা যাবে, সেই সব ক্লাবের কর্তারা ফুটবলের বিষয়ে নাক গলান না। তাঁরা প্রয়োজনীয় টাকা দেন। কোন ফুটবলার খেলবে, কী ভাবে দল চলবে তা ছেড়ে দেন কোচ ও সাপোর্ট স্টাফদের উপর। সেটাই করেছেন মোহনবাগান কর্তারা। দল চালিয়েছেন হাবাস। তাঁকে সাহায্য করেছেন ম্যানুয়েল পেরেজ়, ক্লিফোর্ড মিরান্ডারা। কোন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কী ভাবে খেলা হবে, কোন কোন ফুটবলারকে নেওয়া হবে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হাবাস। কোচ ও সাপোর্ট স্টাফদের এই স্বাধীনতা দলকে সফল করেছে। লিগ-শিল্ড চ্যাম্পিয়ন করেছে মোহনবাগানকে।

আরও পড়ুন
Advertisement