Mohun Bagan

মোহন-সমর্থকদের উচ্ছ্বাস ছাপিয়ে গেল ডার্বি জয়কেও, ‘জয়-বীরুর’ লিগ-শিল্ড জয়ে শহর সবুজ-মেরুন

মোহনবাগান ফুটবলারেরা দর্শকের সমর্থন চেয়েছিলেন। ৬১ হাজার দর্শক মাঠে এসে প্রিয় দলের প্রতি নিজেদের ভালবাসা উজাড় করে দিলেন। সবুজ-মেরুনে মোড়া শহরের উচ্ছ্বাস ছাপিয়ে গেল মোহনবাগানের ডার্বি জয়কেও।

Advertisement
অভীক রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ০০:২৮
football

মোহনবাগানের সমর্থকদের বানানো সেই ব্যানারে কামিংস (বাঁ দিকে) এবং সাদিকু। ছবি: এক্স।

দৃশ্য এক: সংযুক্তি সময়ের খেলা চলছে তখন। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে মুম্বই একটা গোল শোধ করে দেওয়ায় স্টেডিয়াম নিস্তব্ধ। আচমকাই সাদা ‘বিব’ গায়ে ডাগআউট থেকে বেরিয়ে এসে মোহনবাগানের গ্যালারির দিকে এগিয়ে গেলেন আর্মান্দো সাদিকু। দু’হাত তুলে সমর্থকদের জেগে উঠতে বললেন। দেখাদেখি ছুটে এলেন সহকারী কোচ ম্যানুয়েল পেরেস এবং আরও কিছু ফুটবলার। একই কাজ করলেন তাঁরা। সামান্য ঝিমিয়ে পড়া মোহনবাগানের গ্যালারি আবার জেগে উঠল।

Advertisement

দৃশ্য দুই: ম্যাচের আর কয়েক সেকেন্ড বাকি। সাজঘরে ফেরার সিঁড়ির সামনে অস্থির পায়ে ঘোরাঘুরি করছেন জনি কাউকো। জার্সি দিয়ে মুখ ঢাকা। মাঠে খেলা হয়ে চলেছে। নজর নেই সে দিকে। কখনও পিছন ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। কখনও আবার জার্সিতে মুখ ঢেকে ফেললেন। রেফারি বাঁশি বাজাতে অবশেষে স্বস্তি। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন মাটিতে। মাথা ঠেকালেন। উঠেই সতীর্থদের সঙ্গে উৎসব করতে ছুটলেন।

সোমবারের যুবভারতী স্টেডিয়াম সাক্ষী থাকল এ রকম অসংখ্যা মুহূর্তের। মোহনবাগানের প্রথম বার ঐতিহাসিক লিগ-শিল্ড জয়ের মুহূর্তের সাক্ষী থাকার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি তারা। ফলে কাতারে কাতারে সমর্থকের ভিড় দেখা গেল বিকেল থেকেই। ডার্বি থাকলে সাধারণত এক-একটি দলের ৩০-৩৫ হাজার সমর্থক খেলা দেখার সুযোগ পান। কিন্তু সোমবার গোটা স্টেডিয়াম তো মোহনবাগানেরই। খেলা শুরুর তিন ঘণ্টা আগেই সমাজমাধ্যমে মোহনবাগান জানাল, টিকিট ‘সোল্ড আউট’। তা যে নেহাত কথার কথা নয় মালুম হল স্টেডিয়ামে গিয়ে। ম্যাচের পর যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস হল, তা ছাপিয়ে গেল ডার্বি জয়কেও।

বিকেলের বাইপাস ছিল অবরুদ্ধ। একের পর এক টেম্পোর ভিড়। কোনওটা আসছে রুবির দিক থেকে। কোনওটা এয়ারপোর্টের দিক থেকে। সঙ্গে বাইকের মিছিল তো রয়েছেই। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার ভিড়ের মাঝে মোহন-সমর্থকের উন্মাদনা গাড়ির লাইন আরও লম্বা করে দিল। বাড়িয়ে দিল অপেক্ষা। মাঠের ভেতরেও ভিড় জমতে শুরু করে অনেক আগে থেকেই। সমর্থকদের একটি দল ড্রাম নিয়ে এসেছিলেন। গোটা ম্যাচে তা বাজিয়ে গেলেন। নিষিদ্ধ থাকলেও লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রচুর শব্দবাজি আনা হয়েছিল। মোহনবাগানের দু’টি গোল এবং ম্যাচের শেষে দেদার বাজি ফাটল। নজর কেড়ে নিল একটি পোস্টার। ‘শোলে’ সিনেমার আদলে তৈরি করা সেই পোস্টারে জয় এবং বীরু হলেন কামিংস এবং সাদিকু। একে অপরের হাত ধরে রয়েছেন। তবে অন্যতম সফল বিদেশি দিমিত্রি পেত্রাতোসের থাকা উচিত ছিল বলে অনেকেরই মত।

মোহনবাগান সমর্থকদের উচ্ছ্বাস।

মোহনবাগান সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। ছবি: এক্স।

ম্যাচটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য চেষ্টার কোনও কসুর করেনি মোহনবাগান। সমর্থকেরা যাতে আসনে বসতে না পারেন, তার ‘ব্যবস্থা’ ছিল তৈরি। মোহনবাগানকে নিয়ে তৈরি একের পর এক হিট গান বাজানো হল। সঙ্গে থেকে থেকেই ‘জয় মোহনবাগান’ চিৎকার। স্টেডিয়ামের সামনে লাগানো হয়েছিল একাধিক পোস্টার। সাজঘরে যাওয়ার আগে তা নিশ্চয়ই চোখ এড়ায়নি মুম্বই ফুটবলারদের।

ম্যাচের মাঝে ক্ষণে ক্ষণে দৃশ্য বদলাল। মোহনবাগানের গোলের পর সবাই মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে উদ্‌যাপন করলেন। মাঝে মাঠের বড়পর্দায় দেখা গেল লখনউ সুপার জায়ান্টসের ক্রিকেটার কেএল রাহুল এবং কোচ ল্যান্স ক্লুজ়‌নারদের। কিন্তু এ দিনের আকর্ষণ তাঁরা ছিলেন না। ছিলেন মাঠের ১১ জন সবুজ-মেরুন জার্সিধারী। মাঠের সমর্থন চেয়েছিলেন লিস্টন কোলাসো, শুভাশিস বসুরা। সেটা পূর্ণ মাত্রায় পেলেন এবং কাজে লাগালেন।

মোহনবাগান সমর্থকদের একটি ব্যানার।

মোহনবাগান সমর্থকদের একটি ব্যানার। ছবি: এক্স।

ম্যাচ শেষ হওয়ার পর মাঠেই কিছু ক্ষণ ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন’ গানের সঙ্গে নেচে নিলেন ফুটবলারেরা। কিছু ক্ষণ পরেই বেরোল ‘চ্যাম্পিয়ন্স’ লেখা সাদা রঙের জার্সিও। কোচ থেকে ফুটবলার, সবাই পরে নিলেন। ফেডারেশন সভাপতি কল্যাণ চৌবের হাত থেকে শুভাশিস শিল্ড নেওয়ার সময় চিৎকারে কান পাতা দায়। ক্যামেরার সামনে সামান্য পোজ় দেওয়ার পরেই লিস্টন, কামিংস, সাদিকুরা চলে গেলেন সমর্থকদের কাছে। বার বার তুলে ধরে দেখালেন। চলল ‘ভাইকিং ক্ল্যাপ’ও।

বাকিরা যখন উচ্ছ্বাসে মত্ত, তখন সব কিছুর থেকে আড়ালে ছিলেন আন্তোনিয়ো লোপেস হাবাস। শিল্ড নিয়ে উচ্ছ্বাসের সময় কোনও মতে তাঁকে টেনে আনা হল। বাকি সময় এ সব কোলাহল থেকে তিনি অনেকটা দূরে থাকলেন। কখনও ডাগআউটে গিয়ে বসছেন, কখনও সহকারী পেরেসের সঙ্গে কথা বলছেন, কখনও মালিক সঞ্জীব গোয়েন্‌কার সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। খাদের কিনারা থেকে দলকে তুলে এনে চ্যাম্পিয়ন করেও একজন কোচ কী করে এতটা নির্লিপ্ত হতে পারেন! হয়তো এ জন্যেই তিনি বাকিদের থেকে আলাদা। হয়তো এ জন্যেই তিনি ডাগআউটে না থাকলেও দল বিপক্ষের ডেরায় গিয়ে চার গোল দিয়ে আসে। মোহনবাগান দলে চরিত্রের ভিড় থাকলেও আসল চালিকাশক্তি যে হাবাসই, সেটা ম্যাচের পর বোঝা গেল।

আরও পড়ুন
Advertisement