এক দিনের ক্রিকেটে সচিনের ৪৯টি শতরানের রেকর্ড ভেঙে দিতে পারেন বিরাট। —ফাইল চিত্র
সুনীল গাওস্করের সময় ক্রিকেট কোচেরা বলতেন তাঁর খেলা দেখে শিখতে। সচিন তেন্ডুলকরের সময় তাঁরা বলতেন মুম্বইকরের খেলা উপভোগ করতে। এখন কোচেরা বলেন বিরাট কোহলির খেলা দেখ আর শুধু হাততালি দাও, কারণ অন্য গ্রহের মানুষের খেলা কখনও অনুকরণ করা সম্ভব নয়। তবে কি বিরাটই ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার? ভারতের মাটিতে সব থেকে বেশি শতরানের মালিক হতেই বিরাটকে নিয়ে এই আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। এই পরিসংখ্যানে সচিনকে টপকে গিয়েছেন তিনি। এক দিনের ক্রিকেটে সব মিলিয়ে সচিনের ৪৯টি শতরানের রেকর্ডও ভেঙে দিতে পারেন বিরাট। তা হলে কি শুধু সংখ্যার বিচারে বিরাটকেই কি সর্বকালের সেরা ব্যাটার বলে দেওয়া যায়?
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে রবিবার ১৬৬ রান করেন বিরাট। ঘরের মাঠে এক দিনের ক্রিকেটে ২১টি শতরান হয়ে গেল তাঁর। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে মোট ৪৬টি আন্তর্জাতিক শতরান করে ফেললেন বিরাট। সচিনের রয়েছে ৪৯টি শতরান। এখনও যাকে ক্রিকেটের কঠিনতম পরীক্ষা বলা হয়, সেই টেস্টে যদিও ফারাকটা অনেক। ৫১টি শতরান রয়েছে সচিনের। বিরাট এখনও পর্যন্ত ২৭টি শতরান করেছেন লাল বলের ক্রিকেটে। অর্থাৎ, এখনও ফারাক ২৪-এর। ৩৪ বছরের বিরাটের পক্ষে যে সংখ্যা ছোঁয়া বেশ কঠিন।
২০১১ সালে টেস্টে অভিষেক হওয়া বিরাট এখনও পর্যন্ত ১০৪টি টেস্ট খেলেছেন। তাঁর রয়েছে ৮১১৯ রান। লাল বলে সচিনকে ছোঁয়া বিরাটের পক্ষে বেশ কঠিনই। ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে পাঁচটি টেস্টে মাত্র ১৩৪ রান করেছিলেন বিরাট। জেমস অ্যান্ডারসনরা বিরাটকে বার বার অফস্টাম্পের বাইরে বল করে আউট করেন। চার বছর পর যদিও দেখা যায় অন্য বিরাটকে। পাঁচটি টেস্টে এ বার তিনি করেন ৫৯৩ রান। ছিল দু’টি শতরানও। ২০২১ সালে ইংল্যান্ড সফরে আবার সমস্যা দেখা দেয় বিরাটের। সেই সময় তাঁর খারাপ ছন্দ চলছিল। চারটি টেস্টে মাত্র ২১৮ রান করেন তিনি। সদ্য শেষ হওয়া বাংলাদেশ সিরিজ়েও সে ভাবে রান করতে করতে পারেননি বিরাট।
সাদা বলের ক্রিকেটে এলেই যদিও বদলে যান বিরাট। এক দিনের ক্রিকেটে ৪৬টি শতরান করতে সচিন নিয়েছিলেন ৪৩১টি ইনিংস। বিরাট সেই মাইলফলক ছুঁয়েছেন ২৫৯টি ইনিংসে। প্রথম ১০টি শতরান করতে সচিন নিয়েছিলেন ১৩১টি ইনিংস। কিন্তু বিরাটের প্রথম ১০ শতরান এসেছিল ৮০টি ইনিংসে। অর্থাৎ শুরু থেকেই শতরান করার গতিতে সচিনের থেকে অনেক এগিয়ে বিরাট। কোহলির খেলা ২৫৯টি এক দিনের ইনিংসের মধ্যে ১৫৭টি ম্যাচে ভারত জিতেছে। সচিনের খেলা ৪৫২টি ইনিংসের মধ্যে ভারত জিতেছে ২৩১টি ম্যাচ। এই জয়ী ম্যাচগুলির মধ্যে বিরাটের শতরান এসেছে ৩৮টি ইনিংসে। ভারতের জেতা ম্যাচগুলির মধ্যে সচিনের ৩৩টি শতরান রয়েছে। অর্থাৎ এই পরিসংখ্যানে ইতিমধ্যেই সচিনকে টপকে গিয়েছেন বিরাট।
বিরাট সচিনকে টপকে যাবেন? শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে বিরাটের শতরানের পর গাওস্কর বলেন, “বিরাট দারুণ ছন্দে রয়েছে। নিউ জ়িল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তিনটে করে ম্যাচ রয়েছে। এক দিনের ক্রিকেটে সচিনের ৪৯টি শতরান ছুঁতে বিরাটের আর তিনটে শতরান প্রয়োজন। আইপিএলের আগে ৬টা ইনিংস পাবে বিরাট। ও এটা করতে পারবে না ভাবার কোনও কারণ নেই।”
কিন্তু এটা তো সাদা বলের ক্রিকেট। যে লাল বলের খেলাকে বিরাট নিজেও গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন, সেই ক্রিকেটে কিন্তু বিরাট শেষ শতরান করেছেন ২০১৯ সালে। সেটাও এসেছিল ঘরের মাঠে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।
সাদা বলের ক্রিকেটে রান পেলেও দলকে একার হাতে ট্রফি জেতানোর নিদর্শন এখনও রাখতে পারেননি বিরাট। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ দলে বিরাট ছিলেন। তিনি ৯ ম্যাচে ২৮২ রান করেছিলেন। সেই বিশ্বকাপে সচিন ৯ ম্যাচে করেন ৪৮২ রান। পরবর্তী সময় বিরাট দেশের অধিনায়কও হয়েছেন, কিন্তু দলকে ট্রফি এনে দিতে পারেননি। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সব থেকে বেশি রান এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে, কিন্তু দল বিদায় নেয় সেমিফাইনাল থেকে। দেশকে একার হাতে ট্রফি এখনও এনে দিতে পারেননি বিরাট।
সচিন এবং বিরাটের আগে গাওস্করের ব্যাটিং ছিল চর্চার বিষয়। ১২৫টি টেস্টে ৩৪টি শতরান রয়েছে তাঁর। এক দিনের ম্যাচ খেলেছেন ১০৮টি। সেখানে যদিও শতরান একটিই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৩৩টি ম্যাচ খেলে তাঁর সংগ্রহ ১৩,২১৪ রান। ক্যারিবিয়ান পেস আক্রমণের বিরুদ্ধে হেলমেটহীন মাথায় খেলে গিয়েছেন বছরের পর বছর। তাঁর ব্যাটিং শিল্প অবাক করে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। সেই সময়ের ক্রিকেটের সঙ্গে এখন অনেকটাই তফাত। গাওস্করের রান এক সময় টপকানো অসম্ভব মনে করা হত। সচিন সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৬৬৪টি ম্যাচ খেলে করেছেন ৩৪,৩৫৭ রান। কিন্তু তাঁদের মধ্যে তফাত অনেকটাই। গাওস্করের অভিষেক হয় ১৯৭১ সালে, সেই সময় জন্মই হয়নি সচিনের।
সচিন যে সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলেন, বিরাটের তখন এক বছর বয়স। ২০০৮ সালে বিরাটের অভিষেকের সময় সচিন ১৯ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে ফেলেছেন। গাওস্কর, সচিন এবং বিরাটের কেরিয়ারের মধ্যে তফাত অনেক। পরিস্থিতি, ক্রিকেটের নিয়ম, আধুনিক সুযোগসুবিধা— তফাত সবেতেই। বিরাট আগের দিন দলের তিন জন থ্রো ডাউন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৫ জনের একটা ভারতীয় দলে এখন প্রায় সমসংখ্যক সাপোর্ট স্টাফ থাকেন। দলে যেমন থ্রো ডাউন দেওয়ার লোক রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন ভিডিয়ো বিশ্লেষক। যিনি প্রতিটি ব্যাটারের কোথায় কী ভুল হচ্ছে, তা দেখিয়ে দিতে পারেন। তাঁর কাছে বিপক্ষের বোলারদের সম্পর্কেও তথ্য থাকে। সেই বোলারদের বল করার ধরন ভিডিয়ো দেখে আগে থেকেই আন্দাজ করে নিতে পারেন বিরাটরা। এই ধরনের সুবিধা গাওস্করের কাছে ছিল না। সচিন নিজের কেরিয়ারের বেশির ভাগ সময় এই ধরনের কোনও সুবিধা পাননি।
বদলে গিয়েছে ক্রিকেটের বেশ কিছু নিয়মও। এখন বিশ্ব ক্রিকেটে জোরে বোলার বলতে গেলে নেই। সেখানে গাওস্করকে সামলাতে হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ঙ্কর পেস ব্যাটারি। তার উপর তাঁরা চাইলে গাওস্করকে ওভারের ছ’টি বলই বাউন্সার করতে পারতেন। করতেনও। সেই আক্রমণ সামলাতে হয়েছে প্রাক্তন ওপেনারকে। এই নিয়ম এখন পাল্টে গিয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি ওভারে একটি বাউন্সার দেওয়ার নিয়ম হয়। তত দিনে গাওস্কর অবসর নিয়ে নিয়েছেন। বোলাররা যদিও ওভারে একটি বাউন্সারের নিয়ম মেনে নিতে পারেননি। অনেকেই এর বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে নিয়ম হয় ওভারে দু’টি বাউন্সার দেওয়া যাবে। তার আগে সচিন পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে ফেলেছেন। সেই সময়ের মধ্যে সচিন টেস্টে মাত্র পাঁচটি শতরান করেছিলেন। এক দিনের ক্রিকেটে কোনও শতরান ওই সময়ের মধ্যে আসেনি।
ক্রিকেটে ফিল্ডিংয়ের নিয়মের তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হয় ১৯৯২ সালে। নিয়ম হয়, প্রথম ১৫ ওভারে দু’জন ফিল্ডার ৩০ গজের বাইরে থাকবে। ২০০৫ সালে ১৫ থেকে কমে সেটা হয় ১০ ওভার। সেই সঙ্গে যোগ হয় আরও ১০ ওভারের ফিল্ডিং বিধিনিষেধ, যা বোলিং দল ঠিক করে কখন নেওয়া হবে। ২০০৮ সালে ঠিক হয়, প্রথম ১০ ওভার বিধিনিষেধের পর বাকি ১০ ওভারের মধ্যে ৫ ওভার ঠিক করবে বোলিং দল, অন্য ৫ ওভার ঠিক করবে ব্যাটিং দল। এর পরেও বার বার পাল্টায় এই নিয়ম। শেষ বার পাল্টেছিল ২০১৫ সালে। তত দিনে সচিন অবসর নিয়েছেন। কিন্তু ১৯৯২ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে সচিন ৭২টি শতরান করেছিলেন। অর্থাৎ ভারতের প্রাক্তন ওপেনার সিংহভাগ শতরান করেছিলেন, যখন প্রথম ১৫ ওভারে মাত্র দু’জন ফিল্ডার থাকত ৩০ গজের বাইরে।
বিরাট তাঁর ১৪ বছরের ক্রিকেট কেরিয়ারে ফিল্ডিং বিধিনিষেধের মধ্যেই খেলেছেন। নিয়ম, পরিস্থিতির এত বদলের কারণে তুলনায় যেতে রাজি নন অরুণ লাল। ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় সচিন এবং বিরাটকে দেখেছেন। বাংলার প্রাক্তন কোচ আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “দু’জন আলাদা সময়ের ক্রিকেটার। তুলনা করাটা মুশকিল। অনেকে বলতে পারেন বিরাট এখন ভিডিয়ো দেখে বোলারদের সম্পর্কে আগে থেকে জানতে পারেন। ক্রিকেটের অনেক নিয়ম ব্যাটারদের সুবিধা করে দিয়েছে যা সচিন পাননি। তাই তুলনা করাটা মুশকিল। তবে বিরাট কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটটাকেই বদলে দিয়েছে। ও আসার আগে ভারতীয় দল ফিটনেস নিয়ে ভাবত না সে ভাবে। এখন ভারতীয় দল অনেক ফিট। সেটা তো বিরাটের জন্যই।”
ভারতীয় দল রান তাড়া করে জেতার ক্ষেত্রে নিজেদের অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। এর পিছনে অবশ্যই রয়েছেন বিরাট। তাঁকে ‘চেজ় মাস্টার’ বলেও ডাকা হয় এই কারণে। গোটা কেরিয়ারে সচিন ১২৪টি ইনিংস খেলেছেন (এক দিনের ক্রিকেটে) যেখানে ভারত রান তাড়া করে জিতেছে। বিরাট ইতিমধ্যেই ৮৯টি ইনিংস খেলেছেন, যেখানে ভারত রান তাড়া করে জিতেছে। সচিন এই ১২৪টি ইনিংসে ১৪টি শতরান করেছেন। বিরাট ৮৯টি ইনিংসের মধ্যে ২২টি শতরান করেছেন রান তাড়া করার সময়।
সচিনের ১০০টি শতরানের থেকে আর ২৬টি শতরান দূরে বিরাট। অরুণ বললেন, “১০০টা শতরান করতে হলে বিরাটের এখনও অন্তত ৪ বছর লাগবে। অত দিন বিরাট খেলবে কি না তা স্পষ্ট নয়। এখন ম্যাচ খেলার সংখ্যাও কমিয়ে দিয়েছে ও। তাই ১০০ শতরান হবে কি না বলা কঠিন।”
বিরাট এখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলছেন না। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে খেলেননি। নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধেও দলে রাখা হয়নি তাঁকে। এই বছর এক দিনের বিশ্বকাপ রয়েছে। সেই জন্য ৫০ ওভারের ক্রিকেটেই বেশি খেলানো হচ্ছে বিরাটদের। খেলছেন টেস্টও। বিরাট আরও ক’বছর খেলবেন সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ তাঁর। তিনি সচিনকে টপকে যেতে পারবেন কি না তা বোঝা যাবে কেরিয়ার শেষে। তত দিনে বিরাটের দায়িত্ব থাকবে দলকে ট্রফি জেতানো, লাল বলের ক্রিকেটে শতরানে ফেরা।
লিয়োনেল মেসি আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপটা এনে না দিলে তাঁকে হয়তো সারা জীবন দিয়েগো মারাদোনার পিছনেই থাকতে হত। একটা বিশ্বকাপ তাঁকে সর্বকালের সেরার দৌড়ে এনে দিয়েছে। কোহলিকেও রান করে দেশকে জেতাতে হবে, ট্রফি দিতে হবে, একটা বিশ্বকাপ দিতে হবে। এর ধারেকাছে এখনও পৌঁছতে পারেননি তিনি।