Indian Cricket

এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে! অষ্টাদশে পা-রাখা আইপিএলের হাত ধরে সাবালক ভারতীয় ক্রিকেট

২০২৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। এই বছর জিতে নিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। ২০২৩ সালের এক দিনের বিশ্বকাপের ফাইনালের পর থেকে এখনও পর্যন্ত সাদা বলের ক্রিকেটে আইসিসি প্রতিযোগিতায় কোনও ম্যাচ হারেনি ভারত। নেপথ্যে আইপিএল?

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫ ০৮:৫২
Rinku Singh and Rohit Sharma

(বাঁ দিকে) আইপিএলের প্রস্তুতিতে রিঙ্কু সিংহ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হাতে রোহিত শর্মা (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

কেউ বলেন, টাকার গরম! কেউ একটু পরিশীলিত হয়ে বলেন, টাকার আস্ফালন! প্রায় জন্মলগ্ন থেকে আইপিএল খানিক বখাটে ছেলের তকমা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। আঠারোয় পা দিয়ে আজ সে সাবালক। আর এই ১৮ বছর ধরে বখাটে ছেলেটাই সাবালক করে দিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটকে।

Advertisement

পর পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে ভারতীয় দল এখন সত্যিই অপ্রতিরোধ্য। ২০২৩ সালের এক দিনের বিশ্বকাপের ফাইনালের পর থেকে এখনও পর্যন্ত সাদা বলের ক্রিকেটে আইসিসি প্রতিযোগিতায় কোনও ম্যাচ হারেনি ভারত। এক দিনের বিশ্বকাপেও শুধু ফাইনালেই হারতে হয়েছিল। গত দু’বছরে দু’টি ট্রফি বুঝিয়ে দিল ভারত কতটা শক্তিশালী দল। সাদা বলের ক্রিকেটে ভারতকে বিশ্বসেরা করে তোলার নেপথ্যে আইপিএলের অবদান অনস্বীকার্য।

আইপিএলে মাত্র দু’মাসে কোটি কোটি টাকা পান এক এক জন ক্রিকেটার। সারা বছর দেশের হয়ে খেলে ওই টাকা পাওয়া সম্ভব নয়। রঞ্জি ট্রফি (ঘরোয়া ক্রিকেট প্রতিযোগিতা) খেলে তো নয়ই। আইপিএলে ১০ টি দলের প্রত্যেকটিতে গড়ে ১৭-১৮ জন ভারতীয় ক্রিকেটার খেলার সুযোগ পান। অর্থাৎ, আইপিএলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন সব মিলিয়ে প্রায় ১৭০ থেকে ১৮০ জন ভারতীয় ক্রিকেটার। যাঁরা সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁরা বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের সঙ্গে সাজঘর ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, আবার কখনও তাঁদের বিরুদ্ধে খেলছেন।

KKR

আইপিএল জয়ের পর কলকাতা নাইট রাইডার্স। —ফাইল চিত্র।

রঞ্জি ট্রফি, সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফি বা বিজয় হজারে ট্রফিতে শুধু ভারতীয় ক্রিকেটারেরা খেলেন। বেশির ভাগ সময় সেখানে দেশের আন্তর্জাতিক তারকাদের খেলতে দেখা যায় না। ফলে ঘরোয়া ক্রিকেটারেরা নিজেদের মান যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ পান না সেখানে। আইপিএল সেই সুযোগ এনে দেয়। এই প্রতিযোগিতা যেমন টাকা দেয়, তেমনই পরখ করে নেয় ক্রিকেটারদের যোগ্যতাও। এর সেরা উদাহরণ জসপ্রীত বুমরাহ।

২০১৩ সালে আইপিএলে অভিষেক হয় বুমরাহের। ২০ বছর বয়সের তরুণ বুমরাহ তখন অপরিচিত। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হাত ধরে অভ্যুত্থান ভারতীয় পেসারের। আইপিএলে বুমরাহের প্রথম শিকার ছিলেন বিরাট কোহলি। যিনি তত দিনে এক দিনের বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছেন। তারকা হয়ে উঠেছেন। সেই কোহলির উইকেট নিয়ে বুমরাহের শুরু। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা পেসার। আবার বুমরাহ খেলতে না পারলেও ভারত ট্রফি জিততে পারে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিই তার প্রমাণ।

দীনেশ কার্তিকের মতে, ভারতীয় ক্রিকেটের মানসিকতা বদলে দিয়েছে আইপিএল। সব সময় ক্রিকেটারেরা জেতার জন্য মরিয়া। আইপিএলের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন ভারতের প্রাক্তন উইকেটরক্ষক। তিনি বলেন, “ক্রিকেটারদের মধ্যে জেতার খিদে তৈরি করেছে আইপিএল। এখানে প্রচুর টাকা, প্রচুর সুযোগ-সুবিধা, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। এই পারিপার্শ্বিকের যত উন্নতি হয়েছে, তত ভারতীয় ক্রিকেটের মানও বেড়েছে।”

এ বারের আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর কোচের দায়িত্বে রয়েছেন কার্তিক। তিনি বলেন, “আইপিএলের জন্য ভারত চাইলে একই সময়ে একসঙ্গে দু’-তিনটে দল নামিয়ে দিতে পারে। এত প্রতিভাবান ক্রিকেটার দেশে রয়েছে।” একই কথা শোনা গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার পেসার মিচেল স্টার্কের গলাতেও। তিনি বলেন, “ভারত মনে হয় একমাত্র দেশ যারা একই দিনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এক দিনের ম্যাচ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি খেলতে পারে। এতটাই শক্তিশালী দল ওদের। অন্য কোনও দেশ এটা পারবে না।”

কার্তিক এবং স্টার্কের কথা যে কতটা ঠিক, তার উদাহরণ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে টি-টোয়েন্টি এবং এক দিনের সিরিজ়। সেখানে দু’টি সিরিজ়ে ইংল্যান্ড প্রায় একই দল খেলিয়েছিল। কিন্তু ভারতের দু’টি দল প্রায় সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। টি-টোয়েন্টি সিরিজ়ে ভাল খেলে এক দিনের দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন বরুণ চক্রবর্তী। পরে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলেও সুযোগ পান তিনি। এই বরুণের উত্থানের নেপথ্যে অবশ্যই আইপিএল।

ভারতীয় দলে খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে রিঙ্কু সিংহ, হর্ষিত রানা, অভিষেক শর্মা, বরুণদের সঙ্গে যেমন দর্শকদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল আইপিএলে, তেমনই হার্দিক পাণ্ড্য, সূর্যকুমার যাদব, বুমরাহদেরও চিনিয়েছিল এই প্রতিযোগিতা। সেরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের সঙ্গে খেলার যে একটা উপকার আছে তা মনে করিয়ে দেন কার্তিক। আইপিএলের শুরুর দিকে খেলেছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। সেই সময় কার্তিকও খেলেছিলেন তাঁর সঙ্গে। অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞ পেসারের সঙ্গে সাজঘর ভাগ করে নেওয়ায় লাভবান হয়েছিলেন কার্তিক। তিনি বলেন, “প্রথম বছর আইপিএলে আমি ম্যাকগ্রাকে পেয়েছিলাম। খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম ওর অনুশীলন। কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। এমন একজন তারকার সঙ্গে সহজ ভাবে মিশতে পেরে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল। আগামী দিনে নিজের সেরাটা দিতে পেরেছিলাম সেই কারণেই।”

IPL Mitchell Starc

আইপিএলে মিচেল স্টার্ক। —ফাইল চিত্র।

আইপিএল যে ভারতীয় ক্রিকেটকে শক্তিশালী করেছে, সেটা মনে করেন স্টার্কও। তিনি বলেন, “আইপিএল দুর্দান্ত একটা প্রতিযোগিতা। এটাই বিশ্বের এক নম্বর টি-টোয়েন্টি লিগ। সবচেয়ে বেশি প্রতিভাবান যারা, তারা এখানেই খেলে। এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”

আইপিএল খেলতে পারলে আর্থিক উন্নতিও হয় ক্রিকেটারদের। কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলা রিঙ্কুর জীবন যেমন বদলে দিয়েছে এই প্রতিযোগিতা। তাঁর বাবা বাড়ি বাড়ি গ্যাস দেওয়ার কাজ করে মানুষ করেছিলেন পাঁচ ছেলেমেয়েকে। ছোট থেকেই দারিদ্রে ডুবে ছিলেন রিঙ্কু। কিন্তু আইপিএলে সুযোগ পেতেই বদলে যায় জীবন। এখন শুধু আইপিএল খেলে বছরে ১৩ কোটি টাকা আয় করেন রিঙ্কু। তিনি একা নন, বহু ক্রিকেটারের জীবন বদলে দিয়েছে আইপিএল। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে এই টাকা আয় করা সম্ভব নয়। আইপিএল ভারতীয় ক্রিকেটারদের আর্থিক সুরক্ষা দিয়েছে। যা নিশ্চিন্তে ক্রিকেটে মন দিতে সাহায্য করেছে তাঁদের।

সুনীল গাওস্করের মতো ব্যক্তিত্ব একাধিক বার আইপিএলের সমালোচনা করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, বছরে মাত্র ৬০-৭০ দিন খেলে কেন এত টাকা পাবেন ক্রিকেটারেরা? চেতেশ্বর পুজারার মতো যাঁরা সারা বছর ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে ঘাম ঝরান, তাঁরা কেন কম টাকা পাবেন? গাওস্করের সমালোচনায় পুজারাদের টাকা অনেকটাই বেড়েছে। ১৮ বছরে আইপিএলও এই সব সমালোচনা সহ্য করে ভারতীয় ক্রিকেটকে শক্তিশালী করেছে। সাদা বলের ক্রিকেটে দল অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন থেকে যাবে শুধু লাল বল নিয়ে। দেশের মাটিতে নিউ জ়িল্যান্ড সিরিজ় এবং অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বর্ডার-গাওস্কর ট্রফিতে হার এখনও ভোলা যায়নি। এই বছর ইংল্যান্ডে গিয়ে খেলবেন রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা। আইপিএল শেষে সে দিকেও নজর থাকবে দর্শকদের। ব্যর্থ হলে ভারতের টেস্ট দল নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠবে।

Advertisement
আরও পড়ুন