Cricket Coaching

পুজারা না কি দ্রে রাস? অ্যাকাডেমিগুলিতে কোচ, বাবা-মায়েরা সন্তানকে কী তৈরি করতে চাইছেন?

ক্রিকেট শেখার হুজুগ। তবে সেই সব মা-বাবা কি ছেলেমেয়েকে লাল বলের ক্রিকেট খেলার জন্য তৈরি করতে চান? না কি সব নজর আইপিএলের দিকে?

Advertisement
শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪ ১৯:০৫
pujara and russell

চেতেশ্বর পুজারা এবং আন্দ্রে রাসেল। —ফাইল চিত্র।

সকালবেলা কলকাতার রাস্তায় বেরোলেই দেখা যায় পিঠে ক্রিকেটের কিট ব্যাগ নিয়ে বাইকের পিছনে বসে ছেলে, আর বাইক চালাচ্ছেন বাবা। ক্রিকেট শেখার হুজুগ। তবে সেই সব মা-বাবা কি ছেলেমেয়েকে লাল বলের ক্রিকেট খেলার জন্য তৈরি করতে চান? না কি সব নজর আইপিএলের দিকে?

Advertisement

২০০৮ সাল থেকে শুরু হয়েছে আইপিএল। আর সেই প্রতিযোগিতাতেই সর্বনাশ দেখছেন ক্রিকেট অ্যাকাডেমিগুলি। ১৬ বছর ধরে চলছে আইপিএল। ক্রিকেটের সঙ্গে বিনোদন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। মাঠে খেলা দেখতে যান শাহরুখ খান, প্রীতি জিন্টার ভক্তেরাও। ক’ওভার খেলা হয়েছে সে দিকে নজর থাকে না। চোখ থাকে বলিউড তারকাদের দিকে। আর সেই প্রভাব পড়ছে ক্রিকেট শেখার আঁতুড়ঘরগুলিতেও।

কলকাতার বিভিন্ন ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ঢুঁ মারলে শোনা যায় ছেলেমেয়েকে আইপিএল খেলার জন্য তৈরি করার আবেদন। আর সেই আবেদন আসে মা-বাবার থেকেই। বহু দিন ধরে কোচিং করাচ্ছেন সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়কের মতে এখন আইপিএল খেলাটাই প্রধান লক্ষ্য হয়ে গিয়েছে। তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “আগে আমরা ধাপে ধাপে শিখতাম। কোচিং শুরু করার পর সেই ভাবেই শেখাতাম। কিন্তু এখন সবাই একলাফে মগডালে উঠতে চায়। লাল বলের ক্রিকেট খেলার ধৈর্যটাই নেই, শেখা তো দূর। মা-বাবারাই দাবি করেন ছেলেমেয়েকে আইপিএল খেলার জন্য তৈরি করে দিতে।”

cricket academy

শহরের একটি অ্যাকাডেমিতে খুদেদের ক্রিকেট অনুশীলন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

এমন দাবি শুধু সম্বরণের কোচিং অ্যাকাডেমিতে হয়, এমন নয়। আট-ন’বছর ধরে ক্রিকেট শেখাচ্ছেন শিবসাগর সিংহ। তাঁর হাত ধরেই বদলে গিয়েছে সাইকা ইশাকের ক্রিকেট জীবন। মেয়েদের আইপিএলে নজর কেড়েছেন। ভারতীয় দলেও জায়গা করে নিয়েছেন। সেই সাইকার কোচ শিবসাগর বললেন, “এখনকার ছেলেমেয়েদের ক্রিকেট খেলা শেখার ইচ্ছা কম। অল্প একটু শিখেই প্রতিযোগিতায় খেলতে চায় ওরা। আইপিএলে সুযোগ পাওয়ার কথা ভাবে।”

শুধু কলকাতার ক্রিকেট শিক্ষার্থীদের দোষ দিলে হবে না। ভারত জুড়েই এমন দাবি বাবা-মায়েদের। রোহিত শর্মার কোচ দীনেশ লাড কোচিং করাচ্ছেন প্রায় ২৫ বছর ধরে। তাঁর কাছে মুম্বইয়ের বাচ্চারা আসেন ক্রিকেট শিখতে। কিছু দিন আগে মাখায়া এনতিনি তাঁর ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন লাডের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে। রোহিতের ছোটবেলার কোচ বললেন, “এখন ছেলেমেয়েরা খেলা শিখতেই আসে আইপিএল খেলার জন্য। ওখানে টাকা বেশি পাওয়া যায়। এটাই একমাত্র কারণ। ব্যাট হাতে নিয়েই বড় শট খেলার চেষ্টা করে। সকলের খেলার ধরনই এটা হয়ে গিয়েছে। খুবই ক্ষতিকারক একটা প্রবণতা।”

Andre Russell in practice

নাইট রাইডার্সের অনুশীলনে আন্দ্রে রাসেল। ছবি: কেকেআর।

বাবা-মায়েরা অনেক সময় বোঝেনও না ছেলেমেয়ের কোনটাতে ভাল হবে। দ্রুত শিখে খেলতে নামলেই মনে করেন যে ভাল হবে। তাতে বিপদে পড়েন কোচেরাও। সম্বরণ হাসতে হাসতে বললেন, “আমাকে এক বার এক ছাত্রের বাবা এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কত দিন শিখলে আইপিএল খেলার সুযোগ পাবে? আমি বলেছিলাম, ‘আমার কাছে একটা হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ আছে। তিন দিন খাওয়ালেই তৈরি হয়ে যাবে।’” মজা করে বললেও এমন ঘটনা ঘটে। আইপিএলের রং-আলো ধীরে ধীরে সাদা রঙের জার্সির জৌলুস কমিয়ে দিচ্ছে।

সম্বরণ এবং শিবসাগর জানালেন তাঁরা প্রথমে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেন। অনেক বাবা-মা তাতে বোঝেন। কেউ কেউ বোঝেন না। ভারতের প্রাক্তন নির্বাচক সম্বরণ বললেন, “বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি। অনেকে বোঝেন। অনেকে আবার বুঝতে চান না। তবে আলাদা করে আইপিএলের জন্য ক্রিকেটার তো তৈরি করা সম্ভব নয়।” লাড বললেন, “আমি অ্যাকাডেমিতে কাউকে নেওয়ার আগে দেখি তার মধ্যে প্রতিভা আছে কি না। অনেকে তাতে আমার সমালোচনাও করেন। বলেন আমি এখন বড় কোচ হয়ে গিয়েছি। তাই বাছাই করে নিই। কিন্তু সেটা না করলে মুশকিল।” শিবসাগর বললেন, “এখন প্রচুর ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। আমার এখানে যদি পছন্দ না হয়, তখন অন্য কোথাও চলে যাবে। তাই দুটো দিকই সামলাতে হয়। আমি চেষ্টা করি আগে সকলের প্রাথমিক ভিতটা ঠিক করতে। সেটাই এখন ঠিক নয় অনেকের। অথচ তারা আইপিএল খেলার স্বপ্ন দেখে। একটা অলীক স্বপ্ন।”

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড টেস্ট খেলার জন্য বাড়তি অর্থ দেওয়ার কথা বলেছে। লাল বলের ক্রিকেটে উৎসাহ বৃদ্ধি করার জন্যই বোর্ড এই অর্থ দেবে। রাহুল দ্রাবিড়ের মতো কেউ কেউ মনে করেন যে, টেস্ট খেলার জন্য লাল বল এবং সাদা জার্সিটাই যথেষ্ট। আলাদা করে অর্থ দিয়ে উৎসাহ বৃদ্ধি করার করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু দু’মাসের আইপিএলে যেখানে কোনও কোনও ক্রিকেটার ২৪ কোটি টাকা উপার্জন করেন সেখানে টেস্ট খেলার জন্য উৎসাহ বৃদ্ধি করতে অর্থের প্রয়োজন একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

cricket students

পুজারার শতরান না রাসেলের ঝড়, কী দেখে উল্লসিত হয় খুদেরা? ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

সুনীল গাওস্কর যদিও ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের নয়, ঘরোয়া ক্রিকেটারদের বেতন বৃদ্ধির দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “রাহুল দ্রাবিড় বলেছিল ক্রিকেটারদের এই যে বাড়তি টাকা দেওয়া হচ্ছে, সেটাকে ও পুরস্কার বলতে চাইবে। এটা বিসিসিআই-এর দারুণ একটা সিদ্ধান্ত। তবে আমি বলব টেস্ট ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর রঞ্জি ট্রফির দিকে নজর দিতে। রঞ্জিতে ক্রিকেটারেরা যে টাকা পায়, সেটা দ্বিগুণ বা তিন গুণ করে দেওয়া হলে আরও বেশি করে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে চাইবে সকলে। রঞ্জি খেলে তেমন টাকা পাওয়া যায় না বলেই অনেকে খেলতে চায় না। রাজ্যের হয়ে ১০টা ম্যাচ খেলার জন্য আরও বেশি টাকা চায় ক্রিকেটারেরা।” গাওস্করের সঙ্গে সহমত সম্বরণ। তিনি বললেন, “ঘরোয়া ক্রিকেটারদের টাকা অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে। না হলে সবাই আইপিএল খেলার জন্য ছুটবে। সেটা ঠিক নয়। ক্রিকেটের মান পড়ে যাবে। বোর্ডের এই দিকটাও নজর দেওয়া উচিত।”

বাবা-মায়ের নজর আইপিএলের দিকে। তা হলে কি ধীরে ধীরে দেশের হয়ে খেলা উঠে যাবে? ভয়ের কথা শোনালেন ভারত অধিনায়ক রোহিতের কোচ। লাড বললেন, “আমার ছেলে যখন ছোট ছিল, স্বপ্ন দেখতাম ও ভারতের হয়ে খেলবে। কিন্তু এখনকার অভিভাবকেরা সেই স্বপ্ন দেখেন না। তাঁদের সন্তানেরা আইপিএল খেলতে পারলেই তাঁরা খুশি।” আগামী দিনে হয়তো আর চেতেশ্বর পুজারা খুঁজে পাওয়া যাবে না। সকলেই আন্দ্রে রাসেল, সূর্যকুমার যাদব হতে চাইবেন।

আরও পড়ুন
Advertisement