কেকেআরের বিরুদ্ধে আগ্রাসী মেজাজে বেঙ্গালুরুর বিরাট কোহলি। ছবি: আইপিএল।
ছক্কা! এই শব্দের সঙ্গে আমবাঙালির পরিচয় হয় ছোট বয়সেই। লুডোর বোর্ডে ছক্কা পড়বেই, তার নিশ্চয়তা থাকে না। ছয়, এই সংখ্যাটির সঙ্গে সখ্য শুধু লুডোর নয়। বিভিন্ন খেলায় এই ছয় সংখ্যার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। যেমন টেনিসে সেট জিততে হলে অন্তত ছ’টি গেম জিততে হয়। ক্রিকেটেও ছক্কার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এক ওভার মানে ছ’টি বল। আর ব্যাটার ছক্কা হাঁকালে তো কথাই নেই।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আসার পর থেকে ক্রিকেটে এখন ছক্কার রমরমা। যে ব্যাটার ছয় মারতে পারেন না, তাঁর কদর নেই। আইপিএলেও ছক্কা হচ্ছে প্রতি ম্যাচে। ২০ ওভারের ক্রিকেটে ছক্কাও যেন খানিকটা একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে। শুধু ছক্কায় আর মন ভরছে না ক্রিকেটপ্রেমীদের। কোন ব্যাটারের ছক্কা কত দূরে গিয়ে পড়ল, তা নিয়েই বেশি চর্চা হয়।
২০ ওভারের ক্রিকেটে ছয় তো হবেই। সেই ছয়ের আবার রকমফের রয়েছে। আত্মবিশ্বাসী ছয়। বল ঠিক মতো ব্যাটে না লেগে ছয়। চোখ বন্ধ করে ব্যাট চালিয়ে ছয়। মাঠের ধারে পড়া ছয়। গ্যালারিতে পড়া ছয়। স্টেডিয়ামের বাইরে চলে যাওয়া ছয়।
স্টেডিয়ামের বাইরে চলে যাওয়া ছয় আইপিএলেই প্রথম দেখা গিয়েছে, তা নয়। ১৯৮৩ সালে এক দিনের বিশ্বকাপে জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিল দেবের মারা একটি ছক্কা মাঠের বাইরে গাড়ি রাখার জায়গায় গিয়ে পড়েছিল। সে যুগের ক্রিকেটে অবশ্য ঘন ঘন ছয় দেখা যেত না। ব্যাটারেরা মাটিতে বল রেখে শট খেলতেই পছন্দ করতেন। টেস্ট ক্রিকেট ছক্কা মারা প্রায় অপরাধ হিসাবে দেখা হত। সেই যুগ আর নেই। সেই ক্রিকেটও আর নেই। ক্রিকেটপ্রেমীরা গ্যালারি ভর্তি করেন চার-ছয় দেখার জন্যই। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলও ব্যাটারদের স্বার্থে বোলারদের উপর নানা বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিয়েছে। ২০ ওভারের ক্রিকেটে এখন ছক্কা মারতে না পারাই যেন অপরাধ! বিশ ওভারের ক্রিকেটে ছক্কা এখন বোলারদের কাছে বিষের মতো। আবার সেটাই ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে অমৃতসমান!
এ বারের আইপিএলেও ছক্কা হচ্ছে প্রচুর। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মারা মারছেন। মহম্মদ সিরাজ, সুনীল নারাইনেরাও সুযোগ ছাড়ছেন না। ২ এপ্রিল পর্যন্ত এ বারের আইপিএলে যতগুলি ম্যাচ হয়েছে, তার মধ্যে দীর্ঘতম ছয়টি এসেছে লখনউ সুপার জায়ান্টসের নিকোলাস পুরানের ব্যাট থেকে। মঙ্গলবার রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের ক্রিকেটারের একটি শটে বল উড়ে গিয়েছে ১০৬ মিটার। পিছিয়ে নেই কলকাতা নাইট রাইডার্সের বেঙ্কটেশ আয়ারও। বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধেই তিনি ১০৬ মিটারের ছক্কা হাঁকিয়েছেন। তিনিও রয়েছেন যুগ্ম ভাবে এক নম্বরে। তৃতীয় স্থানে রয়েছেন মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের ঈশান কিশন। তিনি সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে ১০৩ মিটার দূরে বল পাঠিয়েছেন। চতুর্থ স্থানে কলকাতার আন্দ্রে রাসেল। হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে ১০২ মিটারের ছক্কা মেরেছেন ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডার। পঞ্চম স্থানে বাংলার তরুণ উইকেটরক্ষক-ব্যাটার অভিষেক পোড়েল। পঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে দিল্লি ক্যাপিটালসের অভিষেকের একটি শট ৯৯ মিটার অতিক্রম করেছে। ষষ্ঠ স্থানে হায়দরাবাদের ট্র্যাভিস হেড। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে তাঁর দীর্ঘতম ছয় ৯৮ মিটারের। সপ্তম স্থানে শিখর ধাওয়ান। পঞ্জাব অধিনায়ক লখনউ সুপার জায়ান্টসের বিরুদ্ধে ৯৬ মিটারের ছক্কা মেরেছেন। অষ্টম স্থানে আবার রাসেল। হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে তাঁর ছয়ের দৈর্ঘ্য ছিল ৯৬ মিটার। নবম স্থানে রয়েছেন হায়দরাবাদের হেনরিক ক্লাসেন। কেকেআরের বিরুদ্ধে ৯৪ মিটারের ছয় মেরেছিলেন তিনি। যুগ্ম ভাবে নবম স্থানে রিয়ান পরাগ। রাজস্থান রয়্যালসের ব্যাটারও ৯৪ মিটার দূরে ছয় মেরেছেন দিল্লির বিরুদ্ধে। একাদশ স্থানে পঞ্জাবের জনি বেয়ারস্টো। ইংরেজ উইকেটরক্ষক-ব্যাটার লখনউয়ের বিরুদ্ধে মেরেছেন ৯৩ মিটারের ছয়। এ বারের আইপিএল ছক্কার সেরা একাদশে চোখ রাখলেই বোঝা যাচ্ছে, লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। কোনও দেশের ক্রিকেটারেরাই পিছিয়ে নেই।
তবু পিছিয়ে রয়েছে এ বারের আইপিএল। ১০৬ মিটার আর এমন কী! গত বছরের তুলনায় এখনও পর্যন্ত এ বার ছক্কার দূরত্ব কম। গত বছর দূরত্বের বিচারে প্রথম ১০টি ছক্কা ছিল যথাক্রমে ১১৫ মিটার (ফ্যাফ ডুল্পেসি), ১১৪ মিটার (টিম ডেভিড), ১১২ মিটার (জস বাটলার), ১১১ মিটার (শিবম দুবে), ১০৯ মিটার (আন্দ্রে রাসেল), ১০২ মিটার (শিবম), ১০১ মিটার (রিঙ্কু সিংহ), ১০১ মিটার (বেঙ্কটেশ আয়ার), ১০১ মিটার (রহমানুল্লাহ গুরবাজ়), ১০১ মিটার (নেহাল ওয়াধেরা) এবং ১০১ মিটার (লিয়াম লিভিংস্টোন)।
ক্রিকেটে ছক্কার কথা উঠলে ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রথমেই মনে আসে যুবরাজ সিংহের ছয় ছক্কার কথা। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্টুয়ার্ট ব্রডের একটি ওভারের প্রতিটি বলই মাঠের বাইরে পাঠিয়েছিলেন যুবরাজ। রবি শাস্ত্রী, হার্সেল গিবস, কায়রন পোলার্ড-সহ মোট ১০ জন ক্রিকেটারের এই কৃতিত্ব রয়েছে। প্রথম ১৯৬৮ সালে এই কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন গ্যারি সোবার্স। যে সময় ক্রিকেটে ছক্কা ছিল বিরল।
ঘরের লুডো থেকে পাড়ার ক্রিকেট— একটা ছক্কাই বদলে দেয় মুখমণ্ডলের ভূগোল। আইপিএলে আবার ছক্কা হলেই নেচে ওঠেন চিয়ার লিডারেরা! বেজে ওঠে প্রতিযোগিতার ‘সিগনেচার টিউন’।
আইপিএলে সব থেকে লম্বা ছয়ের নজির রয়েছে প্রতিযোগিতার প্রথম বছরেই। ১২৪ মিটারের ছয় মেরেছিলেন অ্যালবি মর্কেল এবং প্রবীণ কুমার। তাঁদের কাছাকাছি আছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ২০১১ সালে ১২২ মিটারের ছক্কা মেরেছিলেন। তাঁর পর যথাক্রমে আছেন রবীন উথাপ্পা (২০১০ সালে ১২০ মিটার), ক্রিস গেল (২০১৩ সালে ১১৯ মিটার), রস টেলর (২০০৮ সালে ১১৯ মিটার), যুবরাজ সিংহ (২০০৯ সালে ১১৯ মিটার), বেন কাটিং (২০১৬ সালে ১১৭ মিটার), লিয়াম লিভিংস্টোন (২০২২ সালে ১১৭ সালে) এবং ফ্যাফ ডুপ্লেসি (২০২৩ সালে ১১৫ মিটার)। এই তালিকাতেও লড়াই টান টান।
এ বার দেখা যাক আইপিএলে কোন বছরে সব থেকে লম্বা ছক্কা কত মিটারের ছিল। ২০০৮ সালে মর্কেলের ছয় ১২৪ মিটারের ছিল। ২০০৯ সালে যুবরাজের ছয় ১১৯ মিটার, ২০১০ সালে উথাপ্পার ছয় ১২০ মিটার, ২০১১ সালে গিলক্রিস্টের ছয় ১২২ মিটার দূরে পড়েছিল। পরে বছর দীর্ঘতম ছয়ের দূরত্ব কমে যায়। ২০১২ সালে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ছয় ১১২ মিটার দূরে পড়েছিল। ২০১৩ সালে গেলের ছয় ১১৯ মিটার, ২০১৪ সালে ডেভিড মিলারের ছয় ১০২ মিটার, ২০১৫ সালে এবি ডিভিলিয়ার্সের ছয় ১০৮ মিটার, ২০১৬ সালে কাটিংয়ের ছয় ১১৭ মিটার, ২০১৭ সালে হেডের ছয় ১০৯ মিটার, ২০১৮ সালে ডিভিলিয়ার্সের ছয় ১১১ মিটার, ২০১৯ সালে ধোনির ছয় ১১১ মিটার, ২০২০ সালে পুরানের ছয় ১১৭ মিটার, ২০২১ সালে রুতুরাজ গায়কোয়াড়ের ছয় ১০৮ মিটার, ২০২২ সালে লিভিংস্টোনের ছয় ১১৭ মিটার এবং ২০২৩ সালে ডুপ্লেসির ছয় ১১৫ মিটার দূরে গিয়ে পড়েছিল।
গত মরসুমে আইপিএলে ম্যাচ প্রতি ১৫.৫টি ছয় হয়েছিল। এ বার ম্যাচপ্রতি প্রায় ১৮টি ছক্কা হয়েছে। আরও একটি আকর্ষণীয় তথ্য হল, এ বার প্রথম ১৭টি ম্যাচে ৭৮ জন ব্যাটার ৩০০টি ছক্কা মেরেছেন। এর আগে কোনও আইপিএলে এত কম ম্যাচে ৩০০টি ছক্কা হয়নি। প্রতিযোগিতার প্রথম ১৭টি ম্যাচ ধরা হলে এর আগে সব থেকে বেশি ছয় হয়েছিল ২০২৩ মরসুমে। গত বছর প্রথম ১৭টি ম্যাচে ছয়ের সংখ্যা ছিল ২৫৯টি। এ বছরের থেকে ৪১টি কম। তার আগে রেকর্ড ছিল ২০২০ মরসুমের। সে বার আইপিএলের প্রথম ১৭টি ম্যাচে ছক্কা হয়েছিল ২৫৮টি। তার আগের রেকর্ডটি ছিল ২০১৮ সালের। সে বার প্রথম ১৭টি ম্যাচে ছয়ের সংখ্যা ছিল ২৪৫টি। ২০২২ মরসুমে প্রথম ১৭টি ম্যাচে ব্যাটারেরা ছয় মেরেছিলেন ২৪৫টি। প্রথম ১৭টি ম্যাচের নিরিখে সব থেকে বেশি ছয় মেরেছেন হায়দরাবাদের হেনরিক ক্লাসেন। তিনি তিনটি ম্যাচ খেলে মেরেছেন ১৭টি ছক্কা। আবার কলকাতা নাইট রাইডার্স-দিল্লি ক্যাপিটালস ম্যাচে হয়েছে সব থেকে বেশি ছয়। গত ৩ এপ্রিল দু’দলের ব্যাটারেরা মেরেছিলেন মোট ২৯টি ছয়।
পরিসংখ্যান থেকেই পরিষ্কার, কোনও বছর লম্বা ছয় হয়েছে। কোনও বছর দূরত্ব কমেছে। তবে দিন দিন ছক্কার সংখ্যা বাড়ছে আইপিএলে। ছক্কার গড় দৈর্ঘ্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতি বছর। বল কত দূরে উড়ে যাবে, তা নির্ভর করে একাধিক বিষয়ের উপর। ভারতীয় দলের প্রাক্তন ওপেনার নভজ্যোত সিংহ সিধু বলেছেন, ‘‘ছয় মারার জন্য ব্যাটারের টেকনিক অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তার থেকেও জরুরি হল টাইমিং। ব্যাট এবং বলের সংযোগ কখন এবং কী ভাবে হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে ছয় কতটা লম্বা হবে।’’ প্রায় একই কথা বলেছেন সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক বলেছেন, ‘‘টেকনিক, পাওয়ার এবং এখনকার আধুনিক ব্যাট। টেকনিক সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। টেকনিক না থাকলে কিছুই হবে না। পাওয়ারও আছে। আন্দ্রে রাসেল যে শক্তি দিয়ে ছয় মারে যশস্বী জয়সওয়াল তা মারে না। আবার যশস্বীর টেকনিক অনেক ভাল। এখনকার আধুনিক ব্যাটের কথাও বলব। এখনকার ব্যাটে বল লাগলেই দ্রুত ছুটে যায়। এটাও একটা কারণ। তা ছাড়া আইপিএলের ম্যাঠগুলো ছোট থাকে। যাতে বেশি রান হয়। খেলা যাতে উপভোগ্য হয়। এ জন্যও বেশি ছয় হয়।’’
ক্রিকেটীয় যুক্তি অস্বীকার করার জায়গা নেই। বিভিন্ন ক্রিকেট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অভিভাবকেরা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যান টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার তৈরি করার জন্য। প্রশিক্ষকদের একাংশও বল ছাড়ার আগে বল মারা শেখান। তাঁদেরও লক্ষ্য আইপিএল। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের এই প্রতিযোগিতা ক্রিকেট দর্শন, মানসিকতা বদলে দিয়েছে। যে পরিবর্তন আকৃষ্ট করেছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটিকেও। ১৫৫.৯ গ্রামের সাদা গোলক যত বেশি উড়ে যাবে মাঠের বাইরে, তত মজবুত হবে ভবিষ্যৎ। বিশের বিষে টেস্ট ক্রিকেট যতই ক্ষতিগ্রস্ত হোক, ছক্কার একটা আলাদা ব্যাটার আছে। বীরেন্দ্র সহবাগ, ক্রিস গেলরা কি আর এমনি এমনি তারকার মর্যাদা পান!