ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা। —ফাইল চিত্র
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের দু’টি টুইট। শুক্রবার একটি করা হয় দুপুর তিনটের সময়। অন্যটি ঠিক এক মিনিট পরে। প্রথমটিতে ছিল ভারতের ১৬ জনের টেস্ট দল, অন্যটিতে ১৭ জনের এক দিনের দল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ় সফরে কারা যাবেন তা জানিয়ে দিয়েছে বোর্ডের নির্বাচকেরা। যে কমিটিতে লোক নেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বোর্ড। উত্তরাঞ্চল থেকে কেউ নেই সেই কমিটিতে। প্রাক্তন নির্বাচক প্রধান চেতন শর্মা পদত্যাগ করার পর এখনও কাউকে নেয়নি বোর্ড। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিবসুন্দর দাসের নেতৃত্বে দল বেছে নিয়েছে বোর্ড। দু’টি টুইট করেই গোটা দেশকে জানিয়ে দিলেন কারা খেলবে। সংবাদ মাধ্যমের সামনে তাঁরা কেউ আসেননি। তাই কোনও প্রশ্নের উত্তরও দিতে হয়নি। কিন্তু তাঁদের বেছে নেওয়া দল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
কেন পুজারা বাদ?
টেস্ট দল থেকে বাদ চেতেশ্বর পুজারা। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে রান পাননি তিনি। ৩৫ বছরের টেস্ট ব্যাটারকে শুধু সেই জন্য বাদ দেওয়া হয়েছে এমন নয়। গত দু’বছরে শুধু টেস্ট খেলা পুজারার গড় ৩২। শতরান মাত্র একটি। সেটাও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। এক বার দল থেকে বাদও পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটে সাসেক্সের হয়ে আট ম্যাচে ১০৯৪ রান করে পুজারা আবার ভারতীয় দলে ফিরে আসেন। কিন্তু দেশের জার্সিতে সেই ছন্দ দেখা যায়নি। তাই আরও এক বার বাদ পড়তে হল পুজারাকে। যদিও একই যুক্তি কাজ করল না বিরাট কোহলি বা রোহিত শর্মার ক্ষেত্রে। গত দু’বছরে বিরাটের টেস্ট গড় ৩২.১৩। শতরান একটি। রোহিতের গড় ৪২.১১। শতরান দু’টি। সুনীল গাওস্কর বলেন, “ব্যাটিং ব্যর্থতায় কেন বলি করা হল পুজারাকে? ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য অনেক কিছু করেছে ও। সমাজমাধ্যমে পুজারার তেমন ভক্ত নেই বলে বাদ পড়তে হল? পুজারাকে বাদ দিলে তেমন আওয়াজ উঠবে না বলেই কি বাদ ও? যাবতীয় যুক্তির বাইরে এই সিদ্ধান্ত।” এক মত প্রাক্তন নির্বাচক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি বললেন, “এত তাড়াতাড়ি পুজারাকে বাদ দেওয়া উচিত হল না। পুজারা বাদ গেলে তো রোহিত, বিরাটেরও বাদ যাওয়া উচিত। সেটা তো করলেন না নির্বাচকেরা।”
কেন শামি বিশ্রামে?
বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে মহম্মদ শামিকে। সেটার কারণও বোঝা মুশকিল। টানা দু’মাস আইপিএল এবং পাঁচ দিনের একটি টেস্ট খেলার পর বিশ্রাম অবশ্যই জরুরি ছিল। সেটা তো পেয়েছেন শামি। ভারতের এক মাস কোনও ম্যাচ নেই। ১২ জুলাই ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে খেলবে তারা। আর কত বিশ্রাম প্রয়োজন তাঁর? যদিও গাওস্কর মনে করছেন আরও বেশি বিশ্রাম দেওয়া উচিত ছিল। ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক বলেন, “মাত্র ২০-২৫ দিনের বিশ্রাম পাচ্ছে ভারতের সিনিয়র ক্রিকেটারেরা। ৪০ দিন বিশ্রাম দেওয়া উচিত। তবেই তো পুরো তরতাজা হয়ে ফিরতে পারবে ওরা।”
কেন রুতুরাজ দলে?
ক্যারিবিয়ান সফরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রুতুরাজ গায়কোয়াড়কে। মহারাষ্ট্রের এই ওপেনারের দলে সুযোগ পাওয়া নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর থেকে ভাল খেলেও সুযোগ পেলেন না অভিমন্যু ঈশ্বরন। ভারতীয় দলে চার জন ওপেনারকে নেওয়া হয়েছে। রোহিত শর্মা, শুভমন গিল তো ছিলেনই। তাঁদের সঙ্গে যোগ হলেন রুতুরাজ এবং যশস্বী জয়সওয়াল। তরুণ ওপেনার যশস্বীর দলে সুযোগ পাওয়া নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠছে না। কিন্তু রুতুরাজকে নিয়ে উঠছে। অভিমন্যু গত রঞ্জিতে আট ম্যাচে ৭৯৮ রান করেছেন। তাঁর গড় ৬৬.৫। শতরান তিনটি। সেখানে রুতুরাজ চার ম্যাচে ৪৫৭ রান করেছেন। গড় ৫২ এবং শতরান একটি। ওপেনার না হলেও মিডল অর্ডারে খেলার দাবিদার ছিলেন সরফরাজ খানও। তিনি শেষ রঞ্জিতে করেছেন ছ’ম্যাচে ৫৫৬ রান। গড় ৯২.৬৬। শতরান তিনটি। তাঁদের বাদ দিয়ে কেন রুতুরাজ? এক প্রাক্তন নির্বাচক বলেন, “রুতুরাজকে মনে হয় দলে নেওয়া হয়েছে ও পেসারদের ভাল খেলে বলে। তাই রঞ্জিতে গড় ৪০ হলেও ও জায়গা করে নিয়েছে। রুতুরাজের ক্ষেত্রে রান দেখেনি নির্বাচকেরা। সরফরাজ আইপিএল পেসারদের বিরুদ্ধে ব্যর্থ। অভিমন্যু রঞ্জির নক আউট পর্বে রান পায়নি। এগুলোর দিকেও নজর রাখা হয়। শুধু রান দেখা হয় না।”
রঞ্জিতে রানের দিক থেকে বাকিদের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও রুতুরাজ সাদা বলের ক্রিকেটে ধারাবাহিক। লিস্ট এ এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে (পড়ুন আইপিএলে) তিনি রান করেছেন। সেখানে অভিমন্যু আইপিএলে দলই পাননি আর সরফরাজ প্রথম একাদশে খুব বেশি সুযোগ পাননি। তাহলে কি আইপিএল দেখে টেস্ট দল বাছলেন নির্বাচকেরা? বাংলার রঞ্জিজয়ী প্রাক্তন অধিনায়ক সম্বরণ বললেন, “আইপিএলে রুতুরাজ, যশস্বী ভাল খেলেছে। সেই কারণেই ওদের নেওয়া হয়েছে। আগামী দিনের ওপেনার হিসাবে রুতুরাজকে দেখা হচ্ছে। এটা খুব ভাল সিদ্ধান্ত বলেই আমার মনে হয়েছে।”
অভিমন্যু, সরফরাজ কেন বাদ?
অভিমন্যু গত বছর শুধু রঞ্জি নয়, ভারত এ দলের হয়েও শতরান করেছেন। নেতৃত্বও দিয়েছেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। টানা পাঁচটি শতরান ছিল তাঁর। কিন্তু তাঁকে না নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচকদের যুক্তি হতে পারে রঞ্জির গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে অভিমন্যুর ব্যর্থতা। বাংলা নক আউট পর্বে ওঠার পর থেকেই রান পাচ্ছিলেন তিনি। সরফরাজ শুধু এই রঞ্জি নয়, ধারাবাহিক ভাবে রান করে আসছেন গত রঞ্জি থেকে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩৭ ম্যাচে ৩৫০৫ রান করেছেন সরফরাজ। গড় ৭৯.৬৫ এবং শতরান ১৩টি। তার পরেও তাঁর বাদ পড়ার কী কারণ? আর কী করতে হবে ভারতীয় দলে ঢুকতে হলে?
রঞ্জি না আইপিএল?
আইপিএলে ভাল খেলার জন্য যদি রুতুরাজ দলে জায়গা পান, তাহলে টেস্ট দলে জয়দেব উনাদকট কেন? তিনি রঞ্জিতে ভাল খেলার কারণে টেস্ট দলে জায়গা পেয়েছেন। বাংলার মুকেশ কুমার যেমন লাল বলে ধারাবাহিক। তাই তিনি জায়গা পেয়েছেন। আবার রঞ্জিতে ভাল খেলেও বাদ পড়েছেন অভিমন্যু, সরফরাজের মতো ব্যাটারেরা। কারও ক্ষেত্রে আইপিএল দেখা হচ্ছে, কারও ক্ষেত্রে রঞ্জি। দল নির্বাচন দেখে সেটা বলা মুশকিল। একমত সম্বরণ। বললেন, “কারও ক্ষেত্রে আইপিএলের পারফরম্যান্স দেখা হয়েছে, কারও ক্ষেত্রে লাল বল। এটা আমার খুব অদ্ভুত লাগল।”
রাহানে কেন সহ-অধিনায়ক?
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের পর রোহিত বলেছিলেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে দলে বদল হবে। কিন্তু রোহিতের সহকারী হিসাবে ৩৫ বছরের রাহানেকে দেখে অবাক অনেকেই। তরুণ কোনও ক্রিকেটারকে সহ-অধিনায়ক করলে তিনি তৈরি হতে পারতেন। ২১ বছর বয়সে সহ-অধিনায়ক করা হয়েছিল মনসুর আলি খান পটৌডিকে। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই দলেও শুভমন গিল রয়েছেন। তাঁকে ভবিষ্যতের তারকা বলা হচ্ছে। সুযোগ দিয়ে দেখা যেতে পারত। সেটা করলেন না নির্বাচকেরা। তাঁরা পিছন দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। এক সময় দল থেকে বাদ দেওয়া রাহানেকে সহ-অধিনায়ক করার কারণ খুঁজে পাওয়া ভার। সম্বরণও তেমনটাই মনে করছেন। তিনি বললেন, “খুব ভুল সিদ্ধান্ত এটা। সহ-অধিনায়ক এমন কাউকে করা উচিত যে আরও সাত-আট বছর খেলবে। রাহানে দলে আছে ঠিক আছে। তাঁকে সহ-অধিনায়ক করার কোনও যুক্তি নেই।”