Nitish Kumar Reddy

মাঠে ‘পুষ্পা’র লড়াই, গ্যালারিতে হুঙ্কার বাবার, সাজঘর থেকে বেরিয়ে এসে রোহিতদের নীতীশবরণ

টেস্টে প্রথম শতরানটি করে ফেলেছেন নীতীশ। শনিবার সকাল থেকে ব্যাট করতে নেমে, সারা দিন ক্রিজ়ে থেকে দলকে যেমন বাঁচালেন, তেমনই নিজের ক্রিকেট কেরিয়ারে ছুঁলেন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মাইলফলক।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:২২
Nitish Kumar Reddy

(বাঁ দিকে) শতরানের পর নীতীশ কুমার রেড্ডি। প্রার্থনায় তাঁর বাবা মুতিয়ালা রেড্ডি (ডান দিকে)। ছবি: এক্স।

স্কট বোলান্ডের বলটি মিড অনের উপর দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠিয়েই দৌড় শুরু করলেন নীতীশ কুমার রেড্ডি। বুঝে গিয়েছেন তাঁর বাবার প্রার্থনা সফল হয়েছে। টেস্টে প্রথম শতরানটি করে ফেলেছেন তিনি। শনিবার সকাল থেকে ব্যাট করতে নেমে, সারা দিন ক্রিজ়ে থেকে দলকে যেমন বাঁচালেন, তেমনই নিজের ক্রিকেট কেরিয়ারে ছুঁলেন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মাইলফলক।

Advertisement

নীতীশের শতরানের (১০৫ রানে অপরাজিত) পর পরই মেলবোর্নে খারাপ আলোর কারণে খেলা বন্ধ হয়। মাঠ ছাড়ছিলেন অপরাজিত নীতীশ। আর গ্যালারি থেকে চিৎকার করে যাচ্ছিলেন নানা মুতিয়ালা রেড্ডি। ছেলেকে ডেকে যাচ্ছিলেন। ৯০ হাজারের মেলবোর্নের গ্যালারি থেকে সেই চিৎকার নীতীশের কানে পৌঁছনো সম্ভব ছিল না। কিন্তু মুতিয়ালা তখন মরিয়া। পারলে রেলিং টপকে মাঠে ঢুকে পড়েন ছেলেকে জড়িয়ে ধরার জন্য। বাবা হয়তো সেই সময় নীতীশের কাছে যেতে পারেননি। কিন্তু গোটা ভারতীয় দল তখন সাজঘর ছেড়ে মাঠে নেমে এসেছে নীতীশকে বরণ করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বিরাট কোহলির হাত থেকে টেস্টের টুপি পেয়েছিলেন তিনি। পার্‌থে অভিষেকের পর মেলবোর্নে শতরান। ভারতীয় ক্রিকেট নতুন এক নাম পেয়ে গিয়েছে। এখন দেখার তিনি তারকা হয়ে উঠতে পারেন কি না।

২০১৮ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের একটি অনুষ্ঠানে বিরাট এবং অনুষ্কা শর্মার সঙ্গে নিজস্বী তুলেছিলেন নীতীশ। তখন তাঁর বয়স ১৫ বছর। সেই সময় তাঁর নাম পরিচিত ছিল না। সেই বিরাটের হাত থেকেই পার্‌থে টেস্ট টুপি পেলেন নীতীশ। সাজঘরে দেখিয়েছেন ২০১৮ সালের নিজস্বীটি। তবে এখন তাঁর সঙ্গে নিজস্বী তোলার জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন হাজার হাজার সমর্থকেরা। নীতীশের পরিবারও মেলবোর্ন টেস্টের আগে অনুষ্কার সঙ্গে ছবি তুলেছিল। শনিবার সেই পরিবারের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য দৌড়লেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট এবং মাইকেল ভনের মতো ক্রিকেটারেরা।

২০১৮ সালে বিরাটের সঙ্গে নিজস্বী তোলার প্রসঙ্গে নীতীশ বলেছিলেন, “আর যদি কখনও বিরাটের সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ না পাই, সেই ভেবে তুলে রেখেছিলাম ছবিটা। বিরাট তখন অত জনপ্রিয়। আমার ছোটবেলার স্মৃতি ওই ছবি। বিরাটের আমি খুব বড় ভক্ত। সব ম্যাচ দেখতাম। আমি হিসাব করতাম বার বার, যাতে ভারতীয় দলের হয়ে আমি অভিষেক করার সময় বিরাট অবসর না নিয়ে নেয়।” আর সেই বিরাটের হাত থেকেই অভিষেক টেস্টের আগে টুপি পেয়ে নীতীশ বলেছিলেন, “অসাধারণ অনুভূতি। ভারতের হয়ে খেলার স্বপ্ন বরাবর দেখেছি। ওই মুহূর্তটা ভুলতে পারব না। ক্রিকেট খেলা শুরু করার সময় থেকেই বিরাট ভাই আমার আদর্শ।”

শনিবার নীতীশ যখন ব্যাট করতে নামেন, তখন ১৯১ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল ভারত। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ২২১ রানে ৭ উইকেট হয়ে যায়। সেখান থেকে ওয়াশিংটন সুন্দরকে (৫০) সঙ্গে নিয়ে ইনিংস গড়তে শুরু করেন। এই সিরিজ়েই অভিষেক হয়েছে ২১ বছরের নীতীশের। একাধিক ইনিংসে ৪০ রানের গণ্ডি পার করলেও অর্ধশতরান ছিল অধরা। শনিবার সেই অর্ধশতরান করলেন তিনি। আর ৫০ রান করেই ব্যাট ঘুরিয়ে থুতনির নীচ দিয়ে হাত নিয়ে গেলেন। ‘পুষ্পা’ সিনেমায় অল্লু অর্জুনকে দেখা গিয়েছিল থুতনির নীচ দিয়ে হাত নিয়ে গিয়ে বলতে “পুষ্পা, ঝুঁকেগা নহি।” নীতীশ সেটাই করলেন ব্যাট হাতে।

৫০ করে উৎসব করেছিলেন ‘পুষ্পা’র মতো, ১০০ করে নীতীশ হলেন ‘বাহুবলী’। এক হাঁটু মুড়ে বসে ব্যাটটি সামনে রাখলেন বাহুবলী ছবিতে অভিনেতা প্রভাস যে ভাবে তলোয়ার রেখেছিলেন, সেই ভাবে। সত্যিই তখন তিনি বাহুবলী। যখন ব্যাট করতে নেমেছিলেন, তখন ভারতীয় দলের কাঁধ ঝুঁকে পড়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সামনে। ৫০ রান করে তাই নীতীশের বার্তা ছিল ‘ঝুঁকেগা নহি’। আর ১০০ রান করে অস্ট্রেলিয়া দলকে যুদ্ধের বার্তা দিয়ে রাখলেন ‘বাহুবলী’ নীতীশ।। মেলবোর্নে আরও দু’দিনের খেলা বাকি। ভারতীয় দল যে লড়াই ছাড়বে না, সেই বার্তা দিয়ে গেলেন নীতীশ।

Nitish Kumar Reddy

শতরান করে দলকে লড়াইয়ে ফিরিয়ে নীতীশ কুমার রেড্ডি। ছবি: পিটিআই।

শনিবার একটা সময় নীতীশের শতরান হবে কি না তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে ওয়াশিংটন তার পর বুমরাহ আউট হয়ে যান। নীতীশ তখন ৯৯ রানে অপরাজিত। সিরাজ ব্যাট করতে নামেন প্যাট কামিন্সের ওভারে। তখন তিনটি বল বাকি। সেই তিন বল সিরাজ যখন খেলছেন, তখন বার বার দেখানো হয় নীতীশের বাবাকে। তিনি প্রার্থনা করছিলেন। গোটা গ্যালারি তাঁর সঙ্গে প্রার্থনা করছিল। কারণ সিরাজ আউট হলেই যে ইনিংস শেষ। ৯৯ রানেই আটকে যেতে হবে নীতীশকে। কিন্তু সিরাজ উইকেট দেননি। তিনি তিনটি বল সামলে দেন। আর পরের ওভারের তৃতীয় বলেই চার মেরে শতরান করেন নীতীশ।

নীতীশ যে লড়াকু, তা প্রথম টেস্টেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। পার্‌থে ভারতীয় প্রথম ইনিংসে ১৫০ রানে শেষ হয়ে যায়। তার মধ্যে ৪১ রান করেছিলেন নীতীশ। তাঁর সেই ৫৯ বলের ইনিংসই বুঝিয়ে দিয়েছিল সহজে ছাড়ার পাত্র নন তিনি। অ্যাডিলেডে আবার মিচেল স্টার্কের ৬ উইকেট নেওয়াকে ছাপিয়ে ভারত-অস্ট্রেলিয়া দিন-রাতের টেস্টের প্রথম দিনের শেষে আলোচনায় উঠে এসেছিল নীতীশের ছক্কা। তাঁর হাতে ছক্কা খেয়ে এক রকম বাক্‌রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন স্কট বোল্যান্ড। ভারতের ইনিংসের ৪২তম ওভারের দ্বিতীয় বলটি খারাপ করেননি বোল্যান্ড। অফ স্টাম্পের সামান্য বাইরে বল রেখেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার জোরে বোলার। নীতীশ দ্রুত নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে পয়েন্ট এবং গালির মাঝামাঝি অংশ দিয়ে রিভার্স স্কুপে বল পাঠিয়ে দেন মাঠের বাইরে। নীতীশের এই শট দেখে হেসে ফেলেন ২২ গজের অন্য প্রান্তে থাকা যশপ্রীত বুমরা। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারেরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। এক রকম হতভম্ব হয়ে যান বোল্যান্ড।

নীতীশকে টেস্ট দলে নেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছিল অনেক। আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে এই বছরের শুরুতে নজর কেড়েছিলেন তিনি। কিন্তু আইপিএল আর টেস্ট ক্রিকেট তো এক নয়। সাদা বলের ক্রিকেটে সাফল্য পাওয়া অলরাউন্ডার কি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লাল বলের ক্রিকেটে পারবেন? পরিস্থিতি যে কঠিন তা জানতেন নীতীশও। কিন্তু কোচ গৌতম গম্ভীরের একটা কথা অনুপ্রেরণা হিসাবে নিয়েছিলেন তিনি। নীতীশ বলেছেন, “কোচ বলছিলেন, ‘যদি কেউ বাউন্সার দেয় তা হলে সেই বল কাঁধ দিয়ে আটকাও। মনে করো দেশের জন্য একটা গুলি হজম করছ’। ওই কথাটাই আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। উনি বিশ্বাস করেছেন যে দেশের জন্য আমি গুলি খেতে পারি। গৌতম স্যরের থেকে শোনা এই কথাটাই সবচেয়ে ভাল লেগেছে।”

পার্‌থ টেস্ট শুরুর এক দিন আগেই নিজের অভিষেকের কথা জানতে পেরেছিলেন নীতীশ। নিজেকে শান্ত রেখেছিলেন ম্যাচের আগে। বিকেলে সাইকেল চালিয়েছেন। তার পর ঠান্ডা মাথায় নৈশভোজ করেছিলেন। নীতীশের কথায়, “হর্ষিত (রানা) এবং আমাকে অভিষেকের কথা এক দিন আগে জানানো হয়েছিল। আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। তবু রাতের খাবার খাওয়ার সময় চুপচাপ ছিলাম। খুব বেশি চাপ নিতে চাইনি। বিকেলে একসঙ্গে সাইকেল চালিয়েছি। বেশ ভাল লেগেছে।”

নীতীশকে ক্রিকেটার তৈরি করার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা। অন্য শহরে বদলি হয়ে যাচ্ছিল বাবার। কিন্তু তাতে ছেলের ক্রিকেট কেরিয়ারের ক্ষতি হত। তাই চাকরি ছেড়েছিলেন মুতিয়ালা। তার দাম দিয়েছেন নীতীশ। ভারতের হয়ে খেলে পাওয়া প্রথম জার্সিটি উপহার দিয়েছেন বাবাকে। আর মেলবোর্নে ভারতীয় দলকে উপহার লড়াইয়ের জমি। এক সময় ফলো-অন বাঁচানোর কথা ভাবতে হচ্ছিল ভারতকে। সেখান থেকে পাল্টা লড়াই করার কথা ভাবতেই পারেন রোহিতেরা।

অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৪৭৪ রান তুলেছিল। ভারত এখন ৯ উইকেট হারিয়ে ৩৫৮ করেছে। ১১৬ রানে পিছিয়ে রয়েছে তারা। রবিবার সকালে নীতীশ এবং সিরাজ (২ রানে অপরাজিত) মিলে এই ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করবেন। পরের কাজ জসপ্রীত বুমরাহদের।

Advertisement
আরও পড়ুন