(বাঁদিকে) ব্রেন্ডন ম্যাকালাম এবং বেন স্টোকস। ছবি: এক্স (টুইটার)।
ব্রেন্ডন ম্যাকালাম টেস্ট দলের কোচ হওয়া থেকে ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ়ের আগে পর্যন্ত চারটি টেস্ট হেরেছিল ইংল্যান্ড। রোহিত শর্মাদের বিরুদ্ধে সিরিজ়ের পর হারের সংখ্যা আট। ম্যাকালাম টেস্ট ক্রিকেটে ‘বাজ়বল’ দর্শন নিয়ে আসার পর থেকে এত বড় ধাক্কা খাননি বেন স্টোকসেরা। এই হারের পর ম্যাকালামও বলছেন, বাজ়বলে কিছু পরিমার্জনের প্রয়োজন রয়েছে। ফিরে আসার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী অধিনায়ক স্টোকসও। তাঁদের পরিকল্পনা নিয়ে অবশ্য তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে।
ইংল্যান্ড বাজ়বল (ইংল্যান্ডের কোচ ব্রেন্ডন ম্যাকালাম আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলাচ্ছেন দলকে। যে হেতু তাঁর ডাকনাম ‘বাজ়’, ইংল্যান্ডের ক্রিকেটকে বাজ়বল বলা হচ্ছে।) খেলতে শুরু করার পর কখনও টেস্ট সিরিজ় হারেনি। গত অ্যাশেজ়ে দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া কিছুটা বেগ দিলেও সিরিজ় ড্র হয়েছিল। ভারতের বিরুদ্ধে হারের পর সমালোচনায় মুখর ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটারদের একাংশ। পিচ, পরিবেশ বুঝে স্টোকসদের খেলতে না পারার সমালোচনা করছেন। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে কখনও কোনও দল ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েও ১-৪ ব্যবধানে সিরিজ় হারেনি। স্বভাবতই সমালোচনার সুর বেশ চড়া।
এমন পরিস্থিতিতে ম্যাকালাম মেনে নিতে বাধ্য হলেন, তাঁর পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। মেনে নিয়েছেন, কিছু জায়গায় উন্নতি করতে হবে স্টোকসদের। ইংল্যান্ডের একটি সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ম্যাকালাম বলেছেন, ‘‘এই ধরনের পরাজয় দেখিয়ে দেয় দলের কোথায় কোথায় উন্নতি প্রয়োজন। ঘাটতিগুলো বোঝা যায়। আগামী দু’মাস আমাদের সেগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। সামনের গ্রীষ্মে পরের টেস্ট সিরিজ়ের সময় যাতে আমাদের আরও উন্নত দল হিসাবে ফিরে আসতে হবে।’’
ম্যাকালাম যদিও মানছেন না তাঁর বাজ়বল ব্যর্থ। তিনি বলেছেন, ‘‘গত দু’বছর আমাদের ফল যথেষ্ট ভাল। দু’বছর আগে আমরা যে জায়গায় ছিলাম, সেখান থেকে আজকের অবস্থায় এসেছি। অনেক কিছু ভাল হয়েছে। বেশ কিছু প্রতিভা আবিষ্কার করেছি আমরা। কয়েক জন ক্রিকেটার এই সময়ের মধ্যে অনেকটাই উন্নতি করেছে। আমাদের আরও এগোতে হবে। অনেক দক্ষ ক্রিকেটার এবং ভাল দল রয়েছে। আমরা ধারাবাহিক ভাবে উন্নতি করতে না পারলে, সেই সব ক্রিকেটার বা দলের বিরুদ্ধে ভাল ফল করতে পারব না।’’
সিরিজ় জয়ের জন্য রোহিতদের প্রশংসা করেছেন ম্যাকালাম। তিনি বলেছেন, ‘‘ভারত যে ভাবে খেলেছে, তার জন্য ওদের কৃতিত্ব দিতে হবে। ওরা সব সময় ভীষণ চাপে থাকে। তার প্রধান কারণ, ওদের নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রত্যাশা অনেক। সেই চাপ সামলে বেশ ভাল ক্রিকেট খেলেছে ভারত। আমরা যে ভাবে খেলতে চাই, সে ভাবে খেলেই ভারত আমাদের প্রায় উড়িয়ে দিয়েছে। লড়াইয়ে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। নিশ্চিত ভাবেই আমাদের পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন করতে হবে।’’ সিরিজ় হারলেও ভারত সফরের সুফল ঘরে তুলতে চান ইংল্যান্ডের টেস্ট কোচ। তিনি বলেছেন, ‘‘যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা ভারতে গিয়েছিলাম, সেটা পূরণ হয়নি। তবে এই সফরে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। ভারত আমাদের থেকে অনেক ভাল খেলেছে। ক্রিকেটীয় দক্ষতাতেও ভারত এগিয়ে ছিল। আমরা তেমন প্রতিরোধ গড়তে পারিনি। সব মিলিয়ে ওরা আমাদের থেকে অনেকটাই ভাল ছিল।’’
কোচের সঙ্গে এক মত স্টোকসও। উন্নতি এবং পরিবর্তনের কথা মেনে নিলেও, তাঁর বিশ্বাস বাজ়বল খেলেই তাঁরা আবার সাফল্যের রাস্তায় ফিরতে পারবেন। স্টোকসের বক্তব্য, ‘‘একটা হারে সব কিছু বদলে যায় না। তবে ব্যর্থতা খুব বড় শিক্ষক। বিশেষ করে খেলার ক্ষেত্রে। ব্যর্থতা হতাশা নিয়ে আসে। হতাশায় মনে হয় যেন ফেরার কোনও রাস্তা নেই। আবার অন্য দিক আছে। দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে ফিরে আসার জেদ তৈরি করে। খামতিগুলো ঢেকে ফিরে আসতে উদ্দীপ্ত করে।’’ স্টোকস মনে করেন, ভারতীয় দল অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সাফল্য পেয়েছে। বিশেষ করে ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে তাঁরা অনেকটা পিছিয়ে ছিলেন। ইংল্যান্ডের বিকল্প পরিকল্পনার ঘাটতির কথাও মেনে নিয়েছেন স্টোকস। বাজ়বলে প্রয়োজনীয় কিছু পরিবর্তন তাঁদের আবার সাফল্যে এনে দিতে পারে বলেও বিশ্বাস করেন ইংল্যান্ডের টেস্ট অধিনায়ক।
কোচ-অধিনায়ক বাজ়বল দর্শনকে আঁকড়ে থাকতে চাইছেন। উন্নততর বাজ়বলের খোঁজ করছেন। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন বাজ়বল নিয়েই। প্রাক্তন অধিনায়ক মাইকেল ভন রাঁচী টেস্টের পরেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। সিরিজ় শেষ হওয়ার পর সমাজমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘‘ঘরের মাঠে ভারত অত্যন্ত শক্তিশালী। প্রথম দলের বেশ কয়েক জনকে পায়নি ভারত। তবু দেখিয়ে দিয়েছে, ওরা কতটা শক্তিশালী। ইংল্যান্ড ব্যাট হাতে কখনও প্রত্যাশিত পারফর্ম করতে পারেনি। অনেক ভাল দলের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে হেরেছে ইংল্যান্ড।’’ এখানেই থামেননি ভন। ইংল্যান্ডের একটি দৈনিকে নিজের কলামে ভন লিখেছেন, ‘‘সব থেকে বেশি হতাশার হল, সারা বিশ্বে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো প্রতিভা থাকার পরেও ব্যাটিং ব্যর্থতা ডুবিয়েছে। দুটো সিরিজ়ে এমন ঘটনা ঘটল। আমি চিন্তিত আরও একটা ব্যাপারে। ছেলেরা মুখে যে কথাগুলো বলছে, সেগুলো কি ওরা মন থেকে বিশ্বাস করে। এটা আরও বিপজ্জনক। ইতিবাচক থাকা ভাল। অনুপ্রেরণামূলক। আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সততা। দলের কথা শুনলে মনে হবে, ওরা সব ঠিক করছে। ভুল স্বীকার করে না কখনও। বলে না, একই কাজ অন্য ভাবে করা যেতে পারত কিনা।’’
আর এক প্রাক্তন অধিনায়ক প্রশ্ন তুলেছেন ধর্মশালায় শততম টেস্ট খেলা জনি বেয়ারস্টোর ফর্ম নিয়ে। পাঁচটি টেস্টের ১০ ইনিংসে ২৩০ রান করেছেন বেয়ারস্টো। কুকের বক্তব্য, ‘‘সব ফরম্যাটে আমাদের কয়েক জন সফল ক্রিকেটারদের অন্যতম বেয়ারস্টো। অথচ ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ়ে এক দমই ভাল খেলতে পারেনি। ওকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা নির্বাচকদের জন্য খুব কঠিন হতে পারে। তবু কোথায় খেলা হচ্ছে এটা মাথায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।’’ ম্যাকালাম-স্টোকসদের বিকল্প পরিকল্পনা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ভারতের মাটিতে টেস্ট সিরিজ় জয়ী শেষ বিদেশি অধিনায়ক। ইংল্যান্ডের ক্রিকেট লিখিয়ে জোনাথ অ্যান্ড্রু বলেছেন, ‘‘হতাশাজনক ফল। জবাবদিহি তো করতে হবে। না হলে ক্রিকেটপ্রেমীরা বিশ্বাস রাখবে কী করে!’’
ম্যাকালাম-স্টোকস খামতির কথা মেনে নিলেও বাজ়বল ক্রিকেট দর্শন বাতিল করতে রাজি নন। তাঁরা উন্নততর বাজ়বলের কথা বলছেন। যদিও ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একাংশ তাঁদের পরিকল্পনা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন।