যে ভাবে রাজার ধন চুরি করছে করোনাভাইরাস। -প্রতীকী ছবি।
ভাইরাসের ‘হস্ত’ করে সমস্ত রাজার ধন চুরি! সার্স-কোভ-২ ভাইরাস ‘রাজার ধন’ চুরি করছে। ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে ‘রাজা’র ‘প্রাণপাখি’দের! মানুষের ফুসফুসের কোষগুলি থেকে। নিজে বাঁচবে বলে। খুব দ্রুত হাজারে হাজারে বংশবৃদ্ধি করবে বলে। শুধু হানাদার নয়। এমন নয় যে ‘এল, গুলি করল, শত্রু মারল আর উধাও হয়ে গেল’! জানা গেল, গোটা বিশ্ব তোলপাড় করে দেওয়া সার্স-কোভ-২ ভাইরাস আদতে ধুরন্ধর ছিনতাইবাজও।
দেখা গেল, মানবদেহের যে অঙ্গটি স্বাভাবিক বাতাস ছাড়া আর কোনও কিছুকেই ঢোকার অনুমতি দেয় না, সেই ফুসফুসের মৌমাছির ঘরের মতো প্রকোষ্ঠগুলির কোষে কোষে কী নিখুঁত কলাকৌশলে ছিনতাই চালিয়ে যায় করোনাভাইরাস!
মানব দেহকোষের প্রত্যেকটিতেই প্রায় ১০ হাজার রকমের বিপাকক্রিয়া চলে। বিভিন্ন জিনের সক্রিয়তায় দেহকোষে থাকা পরমাণুগুলি নানা ভাবে একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে কোথাও তৈরি করে কোলেস্টেরল। কোথাও বা ফ্যাটি অ্যাসিড, লিপিড অথবা অ্যারাকিডোনিক অ্যাসিড। বা অন্য কোনও পদার্থ। দেখা গেল, করোনাভাইরাস আমাদের ফুসফুসের কোষগুলির সেই স্বাভাবিক রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলির (বিপাকক্রিয়া) কয়েকটির পথকে কী ভাবে বদলে দেয়। কী ভাবে ছিনতাই করে তাদের নিয়ে যায় ভুল পথে। ভাইরাস যেমনটি চাইছে, ঠিক সেই পথে। যাতে ভাইরাসের ভাল হয়। তার দেহ গড়ে ও বেড়ে ওঠার আরও মালমশলা পায়। বংশবৃদ্ধি করতে পারে নিশ্চিন্তে।
তাতে মানুষের ফুসফুসের কোষগুলির স্বাভাবিক পথচলা ব্যাহত হয়। থমকে যায়। বা সেই পথগুলি অন্য দিকে মোড় নেয়। বদলে যায় তাদের অভিমুখ। তার ফলে ফুসফুস হারিয়ে ফেলে তার স্বাভাবিক ছন্দ। চলার গতি। দুর্বল হয়ে পড়ে উত্তরোত্তর।
অন্য পথের হদিশ দেওয়া গবেষণা
করোনা সংক্রমণে গত দেড় বছর ধরে গোটা বিশ্ব সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ার পর এ বার মানুষের ফুসফুসে করোনাভাইরাসের ছিনতাইবাজি ধরা পড়ল এক বঙ্গসন্তানের গবেষণায়। খড়্গপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি)’-র ‘স্কুল অব এনার্জি সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর অধ্যাপক অমিত ঘোষ ও তাঁর ছাত্র পীযূষ নন্দার গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘প্লস কম্পিউটেশনাল বায়োলজি’-তে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেহাতই দু’-একটি অন্য রকমের ভাবনাচিন্তা বাদ দিলে এত দিন করোনাভাইরাস রোখার জন্য টিকা বা ওষুধ আবিষ্কারের সাধারণ লক্ষ্য ছিল মানুষের দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে জোরদার করে তোলার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি করা। অমিত ও তাঁর ছাত্রের গবেষণায় আরও গভীরে গিয়ে চিকিৎসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হল। ফুসফুসের কোষের ওই রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলির পথ যাতে সার্স-কোভ-২ বা অন্য যে কোনও ভাইরাস বদলে দিতে না পারে সেই লক্ষ্যে ওষুধ বা আরও কার্যকরী টিকা আবিষ্কারের রাস্তাটা খুলল।
ভাইরাসের ভাল, কপাল পোড়ে মানুষের
একেবারে জেনেবুঝে মানুষের ক্ষতি করতেই যে করোনাভাইরাস এই ছিনতাই করে, তা কিন্তু নয়। করে নিজের ভালর জন্য। যাতে মানব দেহকোষে ভাইরাস নিজে ভাল ভাবে বাঁচতে পারে। বংশবৃদ্ধি ঘটাতে পারে। কিন্তু তাতেই তার আশ্রয়দাতার (মানুষ বা অন্য প্রাণী) ফুসফুসের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। চলার প্রয়োজনীয় শক্তি না পেয়ে ফুসফুস উত্তরোত্তর অবসন্ন হয়ে পড়তে থাকে। তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
করোনাভাইরাস যা যা করে শুধু নিজে বাঁচবে বলে
গবেষকরা দেখেছেন, সংক্রমণের পর মানুষের ফুসফুসের প্রকোষ্ঠগুলির কোষে কোষে অন্তত চারটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার পথ বদলে দেয় করোনাভাইরাস। তার ফলে ফুসফুসে থাকা লিপিড আর অক্সিজেনে জারিত (অক্সিডাইজ্ড) হয়ে ভেঙে যেতে পারে না। ফলে ফুসফুসের কোষগুলির সক্রিয়তার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিও তৈরি করতে পারে না। ভাঙে না বলে মানবকোষে লিপিড জমতে শুরু করে প্রচুর পরিমাণে। সংক্রমণের পর যা ভাইরাস তার নিজের দেহের বাইরের আবরণটিকে শক্ত করে তুলতে কাজে লাগায়।
প্রায় একই ভাবে ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি মানুষের ফুসফুসের কোষে কোষে তৈরি হয় বটে। কিন্তু সেগুলিকেও আর ভাঙতে দেয় না এই ভাইরাস। ফলে মানবকোষে ফ্যাটি অ্যাসিডও জমতে থাকে প্রচুর পরিমাণে। নিজের ভালর জন্য এই ফ্যাটি অ্যাসিডকেও কাজে লাগায় করোনাভাইরাস। একই ভাবে ব্যাহত হয় অ্যারাকিডোনিক অ্যাসিডের সংশ্লেষণ (‘সিন্থেসিস’)-ও। এই অ্যারাকিডোনিক অ্যাসিডই মানবকোষে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে আর তাকে বাড়িয়ে তোলার ‘সিগন্যাল’ বা বার্তা পাঠায়। করোনাভাইরাসের হানাদারিতে সেই অ্যারাকিডোনিক অ্যাসিডের সংশ্লেষণ ব্যাহত হয় বলেই মানবকোষ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার শক্তি হারিয়ে ফেলে।
মূল গবেষক অধ্যাপক অমিত ঘোষ আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘আমরা দেখেছি লিপিডের ভেঙে গিয়ে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া একেবারেই থমকে যাচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর। বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কোলেস্টেরল সংশ্লেষণের প্রক্রিয়াও। ফুসফুসে ফ্যাটি অ্যাসিড জমতে বাধা দিচ্ছে না বটে। কিন্তু তা ভাঙতেও দিচ্ছে না হানাদার ভাইরাস। ফলে মানবকোষে ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ অযথা বেড়ে যাচ্ছে সংক্রমিত হওয়ার পর। ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি পরিমাণে জমে গেলে ফুসফুসের কোষগুলির স্বাভাবিক সঙ্কোচন, প্রসারণের প্রক্রিয়ায় তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শরীরে বাড়তি মেদ জমলে আমরা যেমন আর আগের মতো দৌড়োদৌড়ি করতে পারি না, ঠিক তেমনই।’’
কী ভাবে জানা গেল?
অমিত এবং তাঁর গবেষক ছাত্র পীযূষ জানাচ্ছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি এবং আক্রান্ত হয়েছেন এমন দু’ধরনের রোগীদের ফুসফুসের কোষগুলিতে রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি কোন কোন পথ ধরে এগোয় এবং কী ভাবে সেই পথগুলি বদলে যায়, যেতে পারে বিশেষ একটি গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে তাঁরা সেই সবের ‘সিম্যুলেশন’ করেছেন কম্পিউটারে। সেই গাণিতিক মডেলই দেখিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস কী ভাবে আমাদের ফুসফুসের কোষগুলিতে চার ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার পথ বদলে দিচ্ছে বা তাদের কী ভাবে প্রভাবিত করছে। এর আগে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মিলে গিয়েছে এই গাণিতিক মডেলের পূর্বাভাস।
খড়্গপুরের অমিতের পরিক্রমা
মাধ্যমিক থেকে শুরু করে মাস্টার্স— খড়্গপুরের অমিতের শিক্ষাজীবনের এই পর্বটুকু খড়্গপুরেই। আইআইটি থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করে পিএইচ ডি করতে যান বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এ। তার পর প্রথম পোস্ট ডক্টরাল আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। লরেন্স বার্কলে মেডিক্যাল সেন্টারে দ্বিতীয় পোস্ট ডক্টরালের পর দেশে ফিরে অমিত অধ্যাপনা শুরু করেন খড়্গপুর আইআইটি-তেই।
ড্রাগ টার্গেট খুঁজতে সহায়ক হবে এই গবেষণা
সল্টলেকের ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (এসআইএনপি)’-এর বায়োফিজিক্স ও স্ট্রাকচারাল জিনোমিক্স বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সংগ্রাম বাগের কথায়, “সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের আক্রমণে মানবদেহের কোষে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ও সেগুলির পথে (মেটাবোলোমিক্স) কী কী পরিবর্তন হয়, এই কাজ সেই বিষয়টি বোঝার প্রথম ধাপ হয়ে দাঁড়াল। মানবদেহে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের প্রভাব খুব ভাল ভাবে বোঝার জন্যে এই ধরনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি খুব জরুরি ছিল। বিশেষ করে সেই সময়ে, যখন আমরা ঠিক মতো বুঝেই উঠতে পারছি না এই ভাইরাসটি কী ভাবে বিভিন্ন রোগীর দেহে বিভিন্ন উপসর্গ তৈরি করে আর চিকিৎসার ফলাফল কেন এক রোগী থেকে অন্য রোগীতে আলাদা হয়ে যায়।”
সংগ্রাম জানাচ্ছেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসায় নতুন নতুন ‘ড্রাগ টার্গেট’ (মানবদেহে ওষুধ পাঠানোর ঠিকানা) খুঁজে পেতে সাহায্য করবে এবং অন্যান্য রোগের জন্য প্রচলিত ওষুধকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোখার জন্য ব্যবহার করা যায় কি না (ড্রাগ রিপারপাসিং) তা বুঝতে সাহায্য করবে। তবে এ ব্যাপারে আরও পরীক্ষানিরীক্ষা প্রয়োজন।
ফুসফুসের ক্ষতি কী কী ভাবে হচ্ছে, জানা গেল এই প্রথম
বরাহনগরের ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)’-এর বায়োলজিক্যাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক অরুণাভ গোস্বামীর মতে, গত দেড় বছর ধরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে গবেষণার মূল অভিমুখটাই ছিল টিকা তৈরি করা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানবদেহে যাতে অ্যান্টিবডি তৈরি করা যায়। কিন্তু এই ভাইরাসটি মানবদেহের যে অঙ্গটিকে মূলত টার্গেট করে, সেই ফুসফুসের কতটা কী ক্ষয়ক্ষতি হয় এই সংক্রমণে, ফুসফুসের সেই ক্ষতিটা ঠিক কী ভাবে করে করোনাভাইরাস, ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসের পুনরুদ্ধার আদৌ সম্ভব কি না, সে ব্যাপারে এখনও কোনও স্পষ্ট ছবি বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকদের হাতে নেই। এই গবেষণাপত্র সেই ছবিটাই তুলে ধরতে পেরেছে। ফলে এ বার ওষুধ আবিষ্কারের সম্ভাবনা তৈরি হল। তাই এই গবেষণাপত্রটি অত্যন্ত সময়োপযোগী।
অরুণাভের কথায়, “আশা করছি, এই গবেষণাপত্রটি এ বার কোভিড রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে চিকিৎসকদেরও। সেই মতো প্রাথমিক ভাবে তাঁরা কয়েকটি ওষুধও দিতে পারবেন কোভিড রোগীদের। যাতে রোগটি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে না পারে।”
অন্যান্য রোগের চিকিৎসারও নতুন পথ খুলতে পারে
এসআইএনপি-র বায়োফিজিক্স ও স্ট্রাকচারাল জিনোমিক্স বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সৌমেন মান্নাও বলছেন, “এটা খুবই প্রশংসনীয় কাজ। কারণ, মানবদেহে বিভিন্ন জিনের প্রকাশমাত্রার (কখনও কেউ জাগে, কেউ ঘুমিয়ে পড়ে বা কেউ বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে) তারতম্যের জন্য কোষের বিপাকক্রিয়াগুলির কী কী পরিবর্তন হয়, এই গবেষণা তা আরও নিখুঁত ভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।”
সৌমেন জানাচ্ছেন, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য ফুসফুসের কোষে বিপাকক্রিয়াগুলির কয়েকটির যে যে পরিবর্তন হতে পারে বলে এই গাণিতিক মডেলের সাহায্যে পূর্বাভাস দিয়েছেন গবেষকরা, তা এর আগে কয়েকটি পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মিলে গিয়েছে। যেমন দেখা গিয়েছে, গ্লুকোজের বিপাক নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ ‘মেটফর্মিন’ (যা ডায়াবিটিসের রোগীদের দেওয়া হয়) আর কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ ‘স্ট্যাটিন’— এই দু’টিই রোগীদের দেহে কোভিডের ভয়াবহ হয়ে ওঠার আশঙ্কা কমায়। এই গবেষণা মানবকোষের বিভিন্ন বিপাকক্রিয়ার উপর বিভিন্ন রোগের প্রভাব বুঝতে আর তা নিরাময়ের ওষুধ খুঁজে বার করতে আরও বেশি সহায়ক হবে।
শুধুই কোভিড নয়, ভাইরাস, ছত্রাক, ব্যাক্টেরিয়াঘটিত অন্যান্য রোগেরও আরও কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কারের দরজা খুলে দিতে পারে এই গবেষণা, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
অমিতের মডেলই ফেলুদা, ব্যোমকেশ বক্সি!
অমিত ও তাঁর ছাত্রের গাণিতিক মডেল ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারে একটি মাইলস্টোন! কারণ, অমিতের গণিতই তো করোনাভাইরাসের ছিনতাইবাজির ফন্দিফিকির আর কলাকৌশলকে ধরে ফেলল। হাতেনাতে। ফেলুদা বা ব্যোমকেশ বক্সির মতো!
ছবি ও গ্রাফিক তথ্য সৌজন্যে: অধ্যাপক অমিত ঘোষ।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।