- প্রতীকী ছবি।
অস্ত্রোপচার করাতে হবে না? অস্ত্রোপচারের পরেও দীর্ঘ দিন ধরে চালিয়ে যেতে হবে না কেমোথেরাপি? সহ্য করতে হবে না কেমোথেরাপির ওষুধবিষুধের জোরালো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ধাক্কা? এ বার কি তবে ওষুধেই পুরোপুরি সারানো যাবে স্তনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রোগ ‘ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার’?
তেমনই আশা জাগিয়েছে তিন বঙ্গসন্তানের আবিষ্কার। আমেরিকার কানসাসে ভেটারেন অ্যাফেয়ার্স মেডিক্যাল সেন্টারের দুই অধ্যাপক সুশান্ত ও স্নিগ্ধা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁদের গবেষক ছাত্র অম্লান দাস এমন একটি রাসায়নিক মিশ্রণ তৈরি করেছেন, যা দিয়ে ওষুধ বানানো হলে স্তনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ক্যানসারও সেরে যেতে পারে। সেই মিশ্রণের প্রধান যৌগটি থাকে গ্রিন টি, ব্ল্যাক টি— সব ধরনের চায়েই। গ্রিন টি-তে থাকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে। তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা গবেষণা পত্রিকা ‘ফার্মাকোলজি: রিসার্চ অ্যান্ড পারস্পেক্টিভ্স’-এ।
গবেষকরা যে রাসায়নিক মিশ্রণটি তৈরি করেছেন, তা ইঁদুরের উপর পরীক্ষায় পুরোপুরি সফল হয়েছে। গবেষকরা প্রথম পর্যায়ের (ফেজ-ওয়ান) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরুর চেষ্টা চালাচ্ছেন। নিশ্চিত হওয়ার জন্য অবশ্য মানবশরীরে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হবে।
স্তন ক্যানসারের ভয়াবহতা
হার্ট অ্যাটাকের পরেই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মহিলার মৃত্যু হয় যে অসুখে, তা হল স্তন ক্যানসার। মহিলাদের মোটামুটি যে ৯ ধরনের ক্যানসারে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়, তার মধ্যে একেবারে শীর্ষে রয়েছে স্তন ক্যানসার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (‘হু’)-র পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, গত বছর অতিমারির সময় বিশ্বে ২৩ লক্ষ মহিলা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। মৃতের সংখ্যাও তার কাছাকাছি। বিশ্বে অন্যান্য ক্যানসারে মহিলাদের আক্রান্ত হওয়ার হার যেখানে ১.৬ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে, সেখানে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার গড়ে ৩০ শতাংশ। সাড়ে ৮ গুণেরও বেশি! ‘হু’-র পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, সবক’টি মহাদেশেই মহিলাদের মৃত্যুর সবচেয়ে গুরুতর কারণ যে সব রোগ, তার তালিকায় প্রথম তিনটি প্রাণঘাতী অসুখের একটি স্তন ক্যানসার। ক্যানসারের টার্গেটেড বা প্রিসিশন থেরাপি ও কেমোথেরাপির যথেষ্ট উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও।
ভারতের ছবি আরও ভয়াবহ
হু জানাচ্ছে, ভারতে প্রতি ১০ মিনিটে ১ জন মহিলার মৃত্যু হয় স্তন ক্যানসারে। আর প্রতি ৪ মিনিটে ১ জন মহিলা স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা করান। ২০১৮ সালে ভারতে বিভিন্ন ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলাদের ২৭ শতাংশই ছিলেন স্তন ক্যানসারের রোগী। বাকি ৭/৮ রকমের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩৫.২ শতাংশ মহিলা। এর মধ্যে রয়েছেন সব বয়সের মহিলাই। কলকাতায় যে ১০ রকমের ক্যানসারে মহিলাদের আক্রান্ত হতে দেখা যায়, তার ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ স্তন ক্যানসারের রোগী।
স্তন ক্যানসারের রকমফের, গবেষকদের কাজের ক্ষেত্র
স্তন ক্যানসার মূলত ৪ ধরনের হয়। এক, এস্ট্রোজেন রিসেপ্টর পজিটিভ (ইআর প্লাস) স্তন ক্যানসার। এ ক্ষেত্রে মহিলাদের দেহে ক্যানসার কোষগুলির বাড়বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এস্ট্রোজেন হরমোন (প্রোটিন)। বিভিন্ন হরমোন থেরাপির মাধ্যমে এই ক্যানসার নিরাময় সম্ভব। দুই, প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর পজিটিভ (পিআর প্লাস) স্তন ক্যানসার। এ ক্ষেত্রে মহিলাদের দেহে ক্যানসার কোষগুলির বাড়বৃদ্ধিতে সাহায্য করে প্রোজেস্টেরন হরমোন (প্রোটিন)। হরমোন থেরাপি করে এই ক্যানসারও সারানো যায়। তিন, হিউম্যান এপিডার্মাল গ্রোথ ফ্যাক্টর রিসেপ্টর (এইচইআর টু প্লাস) স্তন ক্যানসার। এই ক্যানসারের ক্ষেত্রে মহিলাদের দেহে এইচইআর টু প্লাস প্রোটিন সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর অ্যান্টিবডির মাধ্যমে এই ক্যানসারও সারানো যায়। চার, ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসার। প্রথম তিন ধরনের স্তন ক্যানসারই হয় তিনটি প্রোটিনের জন্য। এই সব ধরনের ক্যানসার সারিয়ে তোলা সম্ভব চিকিৎসায়। কিন্তু ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারের রোগীর দেহে ওই তিনটি প্রোটিন থাকে না। তাই এর চিকিৎসা এক রকম অসম্ভবই। এই ক্যানসারই সবচেয়ে ভয়াবহ। রোগীকে বাঁচাতে অস্ত্রোপচার করে স্তন বাদ দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। তার পরেও রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে দীর্ঘ দিন ধরে কেমোথেরাপি চালিয়ে যেতে হয়। যার নানা রকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়।
গত বছরের একটি গবেষণা জানিয়েছে, ভারতে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলাদের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশই ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারের শিকার। গবেষকরা কাজ করেছেন সেই ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসার নিয়েই। মানবদেহে কিছু জিন রয়েছে যাদের সক্রিয়তাই ক্যানসার কোষের বাড়-বৃদ্ধিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এদের নাম ‘অঙ্কোজিন’। আবার এমনও কয়েকটি জিন রয়েছে যেগুলি ক্যানসার কোষগুলির বাড়বৃদ্ধি রুখে দেয়। তাদের নাম ‘টিউমার সাপ্রেসর’।
আগের গবেষণায় কী কী জানা গিয়েছিল?
অন্যতম গবেষক, কানসাসের ভেটারেন অ্যাফেয়ার্স মেডিক্যাল সেন্টারের ক্যানসার রিসার্চ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা অধিকর্তা অধ্যাপক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছেন, প্রায় ১০ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে আগেই দেখা গিয়েছিল মানবদেহে ‘সিসিএন-৫’ নামে একটি বিশেষ জিন রয়েছে যা টিউমার সাপ্রেসর হিসাবে কাজ করে। ক্যানসার কোষগুলির বাড়বৃদ্ধি রুখে দেয়। এ-ও দেখা গিয়েছিল, বাইরে থেকে দেহে সিসিএন-৫ জিনটি ঢোকানো হলে ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারের কোষগুলির আর বাড়বৃদ্ধি হচ্ছে না। সেই কোষগুলির মধ্যে ক্যানসারের ধর্ম (অঙ্কোজেনিক প্রপার্টিজ) কমে যাচ্ছে। কমছে ক্যানসার স্টেম সেলের পরিমাণও। এ-ও দেখা যায়, ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারের রোগীর দেহে এই সিসিএন-৫ জিন আদৌ সক্রিয় থাকে না।
গ্রিন টি খেতে অভ্যস্তদের কেন কম হয় স্তন ক্যানসার?
এপিডিমিওলজির বিভিন্ন গবেষণায় এর আগে দেখা গিয়েছে, পৃথিবীর যে সব দেশের মানুষ বা যে সব জনগোষ্ঠী কয়েকশো বছর ধরে মূলত গ্রিন টি নিয়মিত খেতে অভ্যস্ত, তাঁরা স্তন ক্যানসারে ততটা আক্রান্ত হন না। এর জন্য গ্রিন টি-তে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকা একটি যৌগের বড় ভূমিকা থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছিল বিভিন্ন গবেষণা। যৌগটির নাম ‘ইজিসিজি’ বা ‘এপিগ্যালোক্যাটেচিন’। এই যৌগটি থাকে সব রকমের চায়েই। তবে গ্রিন টি-তে যে পরিমাণে থাকে, অন্য রকমের চায়ে থাকে তার চেয়ে অনেক কম। আগের গবেষণাগুলিতে এও- দেখা যায়, স্তন ক্যানসার রুখতে এই ইজিসিজি যৌগটির তেমন চটজলদি কোনও ভূমিকা নেই। দীর্ঘ দিন ধরে যে সব দেশের মানুষ বা জনগোষ্ঠী গ্রিন টি খেতে অভ্যস্ত, শুধু তাঁদের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। এর কারণ একটাই— গ্রিন টি-তে থাকা এই যৌগটিকে বেশি ক্ষণ মানবশরীর ধরে রাখতে পারে না। রেচনতন্ত্রের মাধ্যমে তা শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।
এই গবেষণার কী কী লক্ষ্য ছিল?
মূল গবেষক অম্লান দাস জানাচ্ছেন, তাঁদের মূলত দু’টি লক্ষ্য ছিল। এক, গ্রিন টি-তে খুব বেশি পরিমাণে থাকা এই ইজিসিজি যৌগটিকে কোনও ভাবে মানবশরীরে অনেক বেশি সময় ধরে রাখা সম্ভব কি না তা দেখা। দুই, ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলির বাড়বৃদ্ধি রুখতে পারে মানবশরীরে থাকা যে জিন, সেই সিসিএন-৫-এর সক্রিয়তা এই ইজিসিজি যৌগটি বাড়াতে পারে কি না, সেটা পরীক্ষা করে দেখা।
লক্ষ্যে পৌঁছতে কী করেছেন গবেষকরা?
একটি রাসায়নিক মিশ্রণ বানানো হয়। ‘চিটোসান’ নামে একটি পলি স্যাকারাইড দিয়ে বানানো খাঁচায় ইজিসিজি-র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলিকে (ন্যানো-পার্টিকল) পুরে ফেলা হয়। তার পর তার সঙ্গে ফোলিক অ্যাসিডকে জুড়ে দেওয়া হয়। ফোলিক অ্যাসিড ব্যবহারের কারণ আগেই গবেষকদের জানা ছিল, সুস্থ, স্বাভাবিক মানবকোষগুলির ভিতরে যে গতিতে যে হারে নানা ধরনের বিপাকক্রিয়া হয়, ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলিতে সেই গতি বা হার অনেক বেশি। এ-ও জানা ছিল, সুস্থ, স্বাভাবিক মানবকোষের চেয়ে ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলির অনেক বেশি পরিমাণে দরকার হয় ফোলিক অ্যাসিড আর ভিটামিন বি-১২। তাদের বিপাকক্রিয়ার গতি ও হার বাড়ানোর জন্য। যা ক্যানসার কোষগুলির বাড়বৃদ্ধির সহায়ক হয়। তাই ফোলিক অ্যাসিড এই মিশ্রণটিকে ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারের কোষগুলির মধ্যে ঢুকতে সাহায্য করে। আর তাতেই কেল্লা ফতে। খাঁচার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ইজিসিজি-র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলি ক্যানসার কোষগুলিকে মেরে ফেলে।
সিউড়ি থেকে সুশান্তের পরিক্রমা, সঙ্গী কলকাতার অম্লান
বীরভূ্মের সিউড়িতে জন্ম সুশান্তের। সেখানকার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বি এসসি পাশ করার পর এম এসসি করেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাণীবিজ্ঞান নিয়ে। সঙ্গে ছিল জেনেটিক্সও। পিএইচ ডি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার পর প্রথম পোস্ট ডক্টরাল বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে। দ্বিতীয় পোস্ট ডক্টরাল ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার পরেই যোগ দেন কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারের অধ্যাপক হিসাবে। সুশান্ত এখন কানসাস সিটির ভেটারেন অ্যাফেয়ার্স মেডিক্যাল সেন্টারের ক্যানসার রিসার্চ ইউনিটের অধিকর্তা। অম্লান কলকাতার মানুষ। অ্যান্ড্রুজ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর অ্যান্ড্রুজ কলেজ থেকে বি এসসি পাশ করেন মাইক্রোবায়োলজিতে অনার্স নিয়ে। এম এসসি এবং পিএইচ ডি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার পর আমেরিকার ওহায়ো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পোস্ট ডক্টরাল ও কানসাস সিটির ভেটারেন অ্যাফেয়ার্স মেডিক্যাল সেন্টার থেকে দ্বিতীয় পোস্ট ডক্টরাল। এখন গবেষক হিসাবে কাজ করছেন কল্যাণীর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স (এনআইবিএমজি)’-এ।
কী ভাবে পরীক্ষা চালিয়েছেন গবেষকরা?
অম্লান বলছেন, “ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালানো হয়। গবেষণাগারে তাদের শরীরে ঢোকানো হয় ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত কোষ। তার পর এক দল ইঁদুরকে খাওয়ানো হয় শুধু ইজিসিজি। যা গ্রিন টি-তে থাকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে। আর এক দল ইঁদুরকে খাওয়ানো হয় ফোলিক অ্যাসিডের খাঁচায় ইজিসিজি-র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলিকে পুরে গবেষকদের বানানো রাসায়নিক মিশ্রণটি।”
পরীক্ষা কী কী জানিয়েছে?
সুশান্ত ও তাঁর স্ত্রী অন্যতম গবেষক স্নিগ্ধা বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এই পরীক্ষায় চারটি ঘটনা ঘটতে দেখা গিয়েছে। এক, দু’দল ইঁদুরের ক্ষেত্রেই ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলিতে ক্যানসারের ধর্ম কমে গিয়েছে। সম পরিমাণে। দুই, দু’দল ইঁদুরের ক্ষেত্রেই ক্যানসার স্টেম সেলের পরিমাণ কমেছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। সম পরিমাণে। যা প্রমাণ করছে, গবেষকদের বানানো মিশ্রণে বাইরে ফোলিক অ্যাসিডের খাঁচা থাকলেও তা ক্যানসার কোষগুলির বিপাকক্রিয়ার হার বাড়াতে সাহায্য করতে পারছে না। বরং খাঁচার ভিতরে থাকা ইজিসিজি-র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলি ক্যানসার কোষগুলির বাড়-বৃদ্ধি রুখে দিচ্ছে। তিন, মানবশরীরের যে সিসিএন-৫ জিন সক্রিয় হলে বা যার সক্রিয়তা বাড়লে ক্যানসার কোষগুলির বাড়বৃদ্ধি আর হতে পারে না, সেই জিন ৩/৪ গুণ বেশি সক্রিয় হয়ে উঠছে দু’দল ইঁদুরের দেহেই ইজিসিজি যৌগটি ঢোকানোর ফলে। চার, শুধু ইজিসিজি যৌগ খাওয়ালে ক্যানসারে আক্রান্ত ইঁদুরগুলি যত তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে, তার তিন গুণ তাড়াতাড়ি সেরে উঠছে ফোলিক অ্যাসিডের খাঁচায় পোরা ইজিসিজি-র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলিকে দিয়ে বানানো মিশ্রণটি খাওয়ালে। যার অর্থ, ফোলিক অ্যাসিডের খাঁচা দিয়ে বানানো মিশ্রণে থাকা ইজিসিজি অণুগুলিকে ইঁদুরের দেহ দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে পারছে। সেই ইজিসিজি অণুগুলি রেচনতন্ত্রের মাধ্যমে ইঁদুরের দেহ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে না।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
গবেষণাপত্রটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত বিশেষজ্ঞদের একাংশ। উচ্ছ্বাসের সেই সুর যেমন শোনা গিয়েছে আমেরিকার ওহায়ো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সুজিত বসুর গলায়, তেমনই তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি (আইআইসিবি)’-র অধ্যাপক বিশিষ্ট ক্যানসার গবেষক সুশান্ত রায়চৌধুরীর কথায়।
সুশান্ত বলছেন, “হরমোন দিয়ে যে ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসার নিরাময়ের কথা ভাবা সম্ভব হয়নি, এই গবেষণা সেই অসাধ্যসাধনেরই পথ দেখিয়েছে। তার ফলে ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারের কোষগুলিকে মেরে ফেলে ইজিসিজি শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও এই ভয়ঙ্কর ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে। কারণ, কাছেপিঠে ঘাপটি মেরে থাকা ট্রিপল নেগেটিভ ক্যানসারের কোষগুলিকে বদলে দিয়ে যাবে এস্ট্রোজেন রিসেপ্টর পজিটিভ (বা আলফা) কোষে। যে কোষগুলির ক্যানসার খুব সস্তার ওষুধেও সারিয়ে দেওয়া যায়। কোনও বড় ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই।” সুশান্ত জানাচ্ছেন, ট্যামোক্সিফিনের মতো ক্যানসারের খুব সাধারণ ওষুধেও এ বার সারিয়ে তোলা যেতে পারে ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারের রোগীদের। এটা ভারতীয়দের কাছে অনেক বেশি স্বস্তির খবর। কারণ, পশ্চিমের দেশগুলির চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত ও মৃত্যু হয় ভারতীয় মহিলাদের। গবেষকদের কৃতিত্ব, তাঁরা ইঁদুর ও গবেষণাগারে কালচার করা কোষ— দু’টি ক্ষেত্রেই পরীক্ষায় সফল হয়েছেন। এ বার পরীক্ষা করে দেখতে হবে ইজিসিজি এবং ট্যামোক্সিফিনের ব্যবহার করে মানবদেহেও ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসার কমানো সম্ভব হচ্ছে কি না।
ওহায়ো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সলেশনাল রিসার্চ বিভাগের অধিকর্তা অধ্যাপক চিকিৎসক সুজিত বলছেন, “আক্ষরিক অর্থেই একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা। শুধুই যে মানবশরীরে ইজিসিজি যৌগটিকে অনেক বেশি ক্ষণ ধরে রাখার উপায় দেখিয়েছেন গবেষকরা, তা নয়। তাঁদের পদ্ধতিতে ঘাপটি মেরে থাকা ভয়ঙ্কর ট্রিপল নেগেটিভ ক্যানসার কোষগুলিকে নিরাময়যোগ্য এস্ট্রোজেন আলফা কোষে বদলে দেওয়াও সম্ভব হয়েছে। তার ফলে রোগীদের ফের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই কমানো যাবে। আর সেটা করা যাবে পরে অনেক সস্তার, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন ওষুধ ব্যবহার করেই। এইখানেই গবেষণার অভিনবত্ব।”
তবে কি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর স্তন ক্যানসারের ভয়ে আর কাটাতে হবে না মহিলাদের? এই প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলার জন্য অবশ্য আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতেই হবে। মানবশরীরে পরীক্ষানিরীক্ষা বা হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য।
ছবি ও গ্রাফিক সৌজন্যে: অধ্যাপক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক স্নিগ্ধা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অম্লান দাস।
একটি গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।