মাসের পর মাস, দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা জানালার বাইরে তাকিয়ে বসে রয়েছেন হিরোকো। ২১ বছর বয়সি এই তরুণের বাড়ি জাপানের ওসাকায়। গত কয়েক মাস ধরে তাঁর খেতে ভাল লাগছে না, ফোন ঘাঁটতে ভাল লাগছে না, বাড়ি থেকে বেরোতে ভাল লাগছে না, প্রেমিকা হানার সঙ্গে কথা বলতেও ভাল লাগছে না তাঁর। এমনকি, বাড়ির সদস্যদের সঙ্গেও কথাবার্তা প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। সদ্য কলেজ পাশ করেছেন। চাকরির জন্য বেশ কয়েকটি জায়গায় ইন্টারভিউও দিয়েছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। তার পর গত কয়েক মাস ধরে ধীরে ধীরে চার বাই চার কামরার ওই ঘরকেই পুরো জগৎ বানিয়ে নিয়েছেন হিরোকো।
বিশেষজ্ঞরা হিরোকোর এই ‘রোগের’ নাম দিয়েছেন ‘হিকিকোমোরি’। যাতে শুধু হিকোরো নন, তাঁর মতো অন্তত ১৫ লক্ষ জাপানি আক্রান্ত। যার মধ্যে হিরোকোর সমবয়সিরাই বেশি আক্রান্ত।
‘হিকিকোমোরি’ আসলে কী? জাপানের বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন বিভিন্ন কারণে সমাজবিমুখ হয়ে একাকীত্বের চক্রব্যূহে আটকে পড়ারই অপর নাম ‘হিকিকোমোরি’। এবং এই ‘রোগের’ প্রভাব যে কোনও শারীরিক রোগের মতোই মারাত্মক। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী।
জাপানে সম্প্রতি করা এক সরকারি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সে দেশের প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ ‘হিকিকোমোরি’তে আক্রান্ত। যে কারণে তাঁরা সমাজের থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। জীবন কাটাচ্ছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। হারাচ্ছেন কর্মক্ষমতাও।
কিন্তু কেন এই রোগ হয়? কী কারণেই বা এ রকম সমাজবিচ্ছিন্ন হওয়ার পথ ধরেছেন জাপানের লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘হিকিকোমোরি’ নতুন কিছু নয়। অনেক দিন আগে থেকেই জাপানে ছিল। শুধু জাপানে কেন খুঁজলে সব দেশেই এ রকম সমাজবিমুখ যুবক-যুবতীদের অল্পবিস্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু জাপানে সেই সংখ্যা অনেক বেশি। আর এই পরিস্থিতির তৈরির অন্যতম কারণ হিসাবে করোনা অতিমারিকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, জাপানের ‘হিকিকোমোরি’ আক্রান্তদের প্রতি পাঁচ জনে এক জন করোনার কারণে সমাজের থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। করোনা আবহে দীর্ঘ সময় নিভৃতবাসে থাকার কারণেই এমনটা হয়েছে বলেও বিশেষজ্ঞদের দাবি।
জাপানের বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, লকডাউনে দীর্ঘ সময় ঘরবন্দি অবস্থায় কাটাতে হয়েছিল জাপানের মানুষদের। মৃত্যু আতঙ্ক এমনই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, রাস্তায় পা বাড়াতে ভয় পাচ্ছিলেন অনেকে। তবে কোভিড পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হলেও সেই আতঙ্ক এবং ভয় জাপানের সাধারণ মানুষের একাংশের মধ্যে রয়ে গিয়েছে। প্রকট হয়েছে ‘হিকিকোমোরি’।
সমীক্ষায় এ-ও উঠে এসেছে, জাপানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং চাকরির অভাবের কারণেও যুব সমাজের একাংশ হীনম্মন্যতায় ভুগছেন। নামীদামি প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষালাভ করেও বেকার বসে থাকতে হচ্ছে অনেককে। আর তা থেকেই মানসিক অবসাদ গ্রাস করেছে তাঁদের। যার কুপ্রভাব হিসাবে সমাজবিমুখ হয়ে গিয়েছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দিনের পর দিন ঘরে বসে বসে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন ‘হিকিকোমোরি’ আক্রান্তরা। একটা সময় তাঁদের চাকরি দেওয়া হলেও চাকরি করার অনীহা তৈরি হয় তাঁদের মধ্যে।
সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাপানি মনোবিজ্ঞানী তামাকি সাইতো ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘সোশ্যাল উইথড্রয়াল-অ্যাডোলেসেন্স উইদাউট এন্ড’-এ এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতে, কেউ ‘হিকিকোমোরি’ আক্রান্ত কি না বোঝা যায়, যদি সেই ব্যক্তি কমপক্ষে ছ’মাস ধরে সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন এবং যদি এর ফলে ওই ব্যক্তি মানসিক অবসাদে ভোগেন বা কাজ করার ক্ষমতা হারান।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ‘হিকিকোমোরি’তে আক্রান্তদের বাড়ির বাইরে যেতে, স্কুল-কলেজ যেতে, কাজ করতে, অনীহা তৈরি হয়। এমনকি, কোনও কিছু কিনতে বাড়ির নীচের দোকান পর্যন্ত তাঁরা যেতে চান না।
করোনা অতিমারি, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বা বেকারত্বকে দায়ী করলেও ‘হিকিকোমোরি’ ঠিক কী কারণে হয় তা নিয়ে এখনও একশো শতাংশ নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞরা।
অনেক মনোবিজ্ঞানী আবার বর্তমান সমাজব্যবস্থার চাপের কারণে মানুষের মনে এই ‘রোগ’ দানা বাঁধছে বলে মনে করছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে সন্তানদের থেকে বাবা-মার ভয়ঙ্কর প্রত্যাশা এবং প্রতিযোগিতার কারণে অনেকে ছোট থেকেই একাকীত্বে ভুগতে থাকে। যা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়ে। মনের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়। শেষমেশ সমাজের প্রতি অনীহা আসে।
অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক অশান্তির কারণে বা পুরনো কোনও আঘাতের কারণেও প্রকট ভাবে ‘হিকিকোমোরি’ লক্ষ করা যেতে পারে।
গত বছর নভেম্বর মাসে ‘হিকিকোমোরি’ নিয়ে সমীক্ষা শুরু করেছিল জাপান সরকার। ১০ থেকে ৬৯ বছর বয়সি অন্তত ৩০ হাজার মানুষ এই সমীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।
গবেষণায় উঠে এসেছে যে, জাপানের ১৫ থেকে ৬২ বছর বয়সিদের মধ্যে ২ শতাংশ ‘হিকিকোমোরি’তে আক্রান্ত।
সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, টোকিয়োতেই অন্তত ৯ হাজার মানুষ ‘হিকিকোমোরি’ আক্রান্ত। এর মধ্যে অনেক পড়ুয়াও রয়েছে, যারা স্কুল-কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
অনেক পরিবারের দাবি, কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে সমস্যা আরও বাড়ছে। আরও সমাজবিমুখ হয়ে উঠছে ছাত্রযুবদের একাংশ। আগামী জুন মাস থেকে টোকিয়ো প্রশাসন মেটাভার্সে ভার্চুয়ালি সামাজিক জমায়েতের ব্যবস্থা করবে। সেখানে হিকিকোমোরি আক্রান্তরা অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। এর পর ২১ বছর বয়সি হিরোকোর মতো অনেকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন বলেও আশাবাদী প্রশাসন।
সব ছবি: প্রতীকী।