খলিস্তানি জঙ্গি গুরপতবন্ত সিংহ পন্নুনকে খুনের চেষ্টার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ ওঠায় খবরের শিরোনামে চলে এসেছেন বিকাশ যাদব। তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা ‘ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’ (এফবিআই)। শুধু তা-ই নয়, অভিযুক্তকে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ (র)-এর অফিসার বলেও দাবি করেছে ওয়াশিংটন।
এ হেন বিকাশকে মাস দশেক আগে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল। তাঁর বিরুদ্ধে রুজু হয় খুনের চেষ্টা ও অপহরণের মামলা। সূত্রের খবর, রাজধানীর এক ব্যবসায়ীর অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করেন তদন্তকারীরা। জিজ্ঞাসাবাদে প্রকাশ্যে আসে মারাত্মক সব তথ্য।
সূত্রের খবর, অভিযোগকারী জানিয়েছেন, ‘গ্যাংস্টার’ লরেন্স বিশ্নোইয়ের হয়ে কাজ করেন বছর ৩৯-এর বিকাশ। যাঁর বিরুদ্ধে জেলে বসেই তোলাবাজি, খুন, হাতিয়ার ও মাদক পাচারের মতো মারাত্মক সমস্ত অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বহু বার বলিউডের ‘ভাইজান’ সলমন খানকে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন বিশ্নোই।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রথম বার পুলিশের খাতায় নাম ওঠে বিকাশের। সেখানে অভিযোগকারী দিল্লির ওই ব্যবসায়ী দাবি করেন, ওই বছরের নভেম্বর মাসে বিকাশের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। তাঁর এক পরিচিত ব্যক্তি দু’জনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বিকাশকে উচ্চ পদে থাকা সরকারি আধিকারিক হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন।
অভিযোগকারী ব্যবসায়ীর একটি সাইবার ক্যাফে রয়েছে। সূত্রের খবর, পশ্চিম এশিয়ার বহু ভারতীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তাঁর। ব্যবসায়ীর দাবি, আলাপ হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই বিকাশের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁর। দু’জনে একে অপরের নম্বর বিনিময়ও করেছিলেন। প্রায়ই তাঁদের মধ্যে ফোনে কথাবার্তা হত।
দিল্লির ব্যবসায়ীর দাবি, বিকাশ যে একজন গুপ্তচর, তা নিজেই জানিয়েছিলেন তিনি। তবে তাঁর কাজ ও অফিসের কোনও তথ্য কখনওই শেয়ার করেননি তিনি। অভিযোগ, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার কথা বলে ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর ওই ব্যবসায়ীকে লোধি রোডে ডেকে পাঠান বিকাশ। সেখান থেকে তাঁকে অপহরণ করে ডিফেন্স কলোনির একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হয়।
অভিযোগকারীর দাবি, অপহরণের সময়ে বিকাশের সঙ্গে আরও এক জন ছিলেন। তাঁর পরিচয় অবশ্য তিনি জানাতে পারেননি। ডিফেন্স কলোনির ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়ার পর নিজের উদ্দেশ্যের বিষয়ে বলেন বিকাশ। ‘গ্যাংস্টার’ লরেন্স বিশ্নোই তাঁকে খুনের বরাত দিয়েছেন বলেও নাকি জানান তিনি।
তদন্তকারীদের ব্যবসায়ী আরও জানিয়েছেন, অপহৃত হওয়ার পর তাঁকে লাঞ্ছিত হতে হয়। তাঁর সোনার চেন ও আংটি ছিনিয়ে নেয় অপহরণকারীরা। পরে ব্যবসায়ীকে তাঁর নিজের ক্যাফেয় নিয়ে যান বিকাশ ও তাঁর সঙ্গী। সেখানকার ক্যাশবাক্সের যাবতীয় টাকা লুট করে চম্পট দেন তাঁরা।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, ক্যাফে ছাড়ার আগে ব্যবসায়ীকে হুমকি দেন বিকাশ ও তাঁর সঙ্গী। এই নিয়ে পুলিশের কাছে গেলে প্রাণে মেরে ফেলার কথাও নাকি বলেন তাঁরা। পরে ব্যবসায়ীকে রাস্তার ধারে ফেলে রেখে চলে যান তাঁরা। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পরই পুলিশের সাহায্য নেওয়ার বিষয় মনস্থ করেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
২০২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর দিল্লি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন ওই ব্যবসায়ী। সঙ্গে সঙ্গেই বিকাশ ও তাঁর সঙ্গীকে গ্রেফতার করেন তদন্তকারীরা। তাঁদের বিরুদ্ধে অপহরণ, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ও খুনের চেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। চলতি বছরের এপ্রিলে জামিন পান বিকাশ।
দিল্লি পুলিশ সূত্রে খবর, জিজ্ঞাসাবাদে বিকাশের সঙ্গী জানিয়েছেন, পুরনো গাড়ি বিক্রি করার ব্যবসা রয়েছে তাঁর। সেখানে আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ায় ব্যবসায়ীকে নিশানা করেন তিনি। অন্য দিকে বিকাশের দাবি, তাঁর বাবা সীমান্ত রক্ষী বাহিনীতে (বিএসএফ) কর্মরত ছিলেন। ২০০৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তার পর থেকেই আর্থিক সমস্যায় পড়েন তিনি। যার জেরে ব্যবসায়ীকে অপহরণের ছক কষেন বিকাশ।
অন্য দিকে এ বছরের ১৭ অক্টোবর বিকাশের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে আমেরিকার বিচার বিভাগ। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে সুপারি কিলার নিয়োগ ও আর্থিক নয়ছয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। ওয়াশিংটনের গোয়েন্দারা বিকাশকে প্রাক্তন ‘র’ অফিসার বলে উল্লেখ করে ছবি প্রকাশ করেছেন। সেখানে তাঁকে হরিয়ানার প্রাণপুরার বাসিন্দা বলে জানিয়েছে এফবিআই।
এ বছরের সেপ্টেম্বরে আমেরিকান তদন্তকারী সংস্থা আদালতে দাবি করে, ‘শিখ ফর জাস্টিস’ (এসএফজে)-এর নেতা পন্নুনকে হত্যার চেষ্টার ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন বিকাশ। এই সংগঠনকে খলিস্তানি জঙ্গিদের আঁতুড়ঘর বলে উল্লেখ করে নিষিদ্ধ করেছে নয়াদিল্লি। মজার বিষয় হল, এফবিআইয়ের ওই পদক্ষেপের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ফের বিকাশকে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশ।
সূত্রের খবর, ১৮ অক্টোবর দ্বিতীয় বার পুলিশের জালে ধরা পড়েন বিকাশ। এ বারও তাঁর বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগে মামলা দায়ের হয়। আমেরিকার আদালতে অবশ্য যে চার্জ গঠন হয়েছে, সেখানে বিকাশের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এফবিআই তাঁকে সহ-ষড়যন্ত্রী বা ‘সিসি-১’ (কো কনস্পিরেটর) বলে উল্লেখ করেছে।
নিউ ইয়র্কের আদালতে তদন্তকারী সংস্থা জানিয়েছে, পন্নুনকে হত্যা করার জন্য বিকাশ ও নিখিল এক ব্যক্তিকে ভাড়াও করেছিলেন। সেই ভাড়াটে ঘাতক আদতে ছিলেন এফবিআইয়ের চর। পরবর্তী কালে চেক প্রজাতন্ত্রে গ্রেফতার হন নিখিল। এ বছরের জুনে তাঁকে আমেরিকায় প্রত্যর্পণ করে ইউরোপের ওই দেশ। ফলে বর্তমানে আমেরিকার জেলে বন্দি রয়েছেন নিখিল।
এফবিআইয়ের দাবি, পন্নুনকে হত্যার জন্য বিকাশেরা ওই ভাড়াটে ঘাতকের সঙ্গে এক লক্ষ ডলারের চুক্তি করেছিলেন। অগ্রিম বাবদ ২০২৩ সালের ৯ জুন তাঁকে ১৫ হাজার ডলার দেওয়া হয়েছিল। আর তাই বিকাশকে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ঘোষণা করেছেন আমেরিকান গোয়েন্দারা।
এ বিষয়ে দেওয়া বিবৃতিতে এফবিআইয়ের ডিরেক্টর ক্রিস্টোফার রে বলেছেন, ‘‘আমেরিকায় যাঁরা বাস করেন, তাঁদের অধিকার রক্ষা আমাদের দায়িত্ব। এফবিআই কোনও রকম হিংসা বরদাস্ত করবে না। দেশের সংবিধান নাগরিকদের যে অধিকার দিয়েছে, তা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।’’
এফবিআইয়েরর প্রেস বিবৃতিতে ‘খলিস্তান’ বা ‘গুরপতবন্ত পন্নুন’ নামের কোনও উল্লেখ নেই। তাঁকে খুনের চেষ্টার ঘটনায় সত্যিই ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-এর ভূমিকা আছে কি না, তা নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাছ থেকে জানতে চেয়েছে কংগ্রেস, তৃণমূল-সহ বিভিন্ন বিরোধী দল।
বিকাশকে নিয়ে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে নয়াদিল্লির বিদেশ মন্ত্রক। সাউথ ব্লক জানিয়েছে, আমেরিকা যে ব্যক্তির কথা বলছে, তিনি বর্তমানে ভারত সরকারের কর্মী নন। তবে তিনি গুপ্তচর সংস্থায় কাজ করতেন কি না, তা স্পষ্ট করা হয়নি।
সব ছবি: সংগৃহীত।