টুইটারের দখল নেওয়ার পরই ‘পাখি’ (পড়ুন টুইটার) মুক্ত হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। আর তার পর থেকে টুইটার কর্তাদের একে একে ছেঁটে ফেলেছেন ইলন। সোমবার রাতারাতি টুইটারের পরিচালক বোর্ডও তুলে দেন ইলন। আগেই চাকরি গিয়েছে সিইও পরাগ আগরওয়ালের। কয়েকশো কোটি টাকা দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দিয়েছেন টুইটারের নয়া মালিক। সম্প্রতি চাকরি গিয়েছে আরও এক ভারতীয়ের। তিনি বিজয়া গাড্ডে।
বিজয়া টুইটারের আইন এবং নীতি নির্ধারণ বিষয়ক প্রধান ছিলেন। সম্প্রতি বিজয়াকে টুইটার থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলেও ক্ষতিপূরণ হিসাবে পরাগের মতো বিজয়াও পেয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। চাকরি হারানোর পরেও টুইটারের কাছ থেকে ৬১০ কোটি পেয়েছেন তিনি, যা পরাগের প্রাপ্ত টাকার থেকে অনেক বেশি। ক্ষতিপূরণ হিসাবে পরাগ পেয়েছেন ৫৩৬ কোটি টাকা।
পরাগ-বিজয়ার পাশাপাশি চাকরি গিয়েছে প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা নেড সেগালেরও। ক্ষতিপূরণ বাবদ নেড পেয়েছেন ৫৪৪ কোটি।
সব থেকে বেশি ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন বিজয়াই। সূত্রের খবর, বিজয়া চাকরি খোওয়ানোতে নাকি খুশি হয়েছেন ডানপন্থী মতাদর্শীদের একাংশ।
এর আগেও বহু বার উচ্চবর্ণের ভারতীয় এবং আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের কটাক্ষের মুখে পড়তে হয়েছে বিজয়াকে। ২০১৮ সালে ‘স্ম্যাশ ব্রাহ্মণিক্যাল প্যার্টিয়ার্কি (ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র ভেঙে দাও)’ নামে একটি হ্যাশট্যাগ দিয়ে টুইটারে প্রতিবাদ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন বিজয়া। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের দলিতদের উপর উচ্চবর্ণের মানুষদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করা। ওই হ্যাশট্যাগ লেখা একটি প্ল্যাকার্ড হাতেও দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
প্ল্যাকার্ড হাতে বিজয়ার ছবি প্রকাশ্যে আসতেই তাঁর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন হিন্দু ডানপন্থী এবং উচ্চবর্ণের সদস্যরা। ব্রাহ্মণদের অপমান করার অভিযোগও আনা হয় বিজয়ার বিরুদ্ধে। টুইটারে ক্ষমা চেয়ে নেন তিনি।
এর পর আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটার অ্যাকাউন্টে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে উঠেপড়ে লাগার জন্যও আমেরিকার ডানপন্থীদের রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল বিজয়াকে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কে এই বিজয়া? ভারতের সঙ্গেই বা তাঁর কীসের যোগ?
১৯৭৪ সালে হায়দরাবাদের এক তেলুগু পরিবারে জন্ম বিজয়ার। তাঁর তিন বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে আমেরিকার টেক্সাসে চলে আসেন। তাঁর বাবা সে রকম কোনও কাজ করতেন না বলে বিজয়ার ছোটবেলা কাটে দারিদ্রে।
টেক্সাসেরই এক ছোট শহরে বেড়ে ওঠেন বিজয়া। সেই এলাকায় ভারতীয়দের উপস্থিতি ছিল নামমাত্র। ছোটবেলা থেকেই তাঁকে বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হয়েছিল। আর সেই কারণেই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়তে আইনজীবী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
বিজয়া নিউ ইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড লেবার রিলেশন নিয়ে স্নাতক হন। পরে আইন নিয়ে পড়াশোনার জন্য নিউ ইয়র্কে যান। আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষে তিনি ‘জুনিপার নেটওয়ার্ক’ নামক সংস্থার আইন বিভাগের ডিরেক্টর হিসাবে কাজ শুরু করেন।
২০১১ সালে টুইটারে যোগ দেন বিজয়া। সেখানে তাঁর প্রধান দায়িত্ব ছিল টুইটারে হয়রানিমূলক বার্তা এবং ভুয়ো খবর রুখতে পদক্ষেপ করা।
টুইটারে চাকরি করতে করতেই আইনজীবী রামসে হোমসানিকে বিয়ে করেন বিজয়া। দুই সন্তানও রয়েছে এই দম্পতির।
আমেরিকায় থাকলেও বিজয়া যে মনেপ্রাণে ভারতীয়, তা তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্ট দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। ভারতের যে কোনও উৎসবে টুইট করে শুভেচ্ছাবার্তা দিতে দেখা যায় তাঁকে।
২০১৮ সালের পর থেকে টুইটার বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে যে কড়া নীতি গ্রহণ করেছিল, তা-ও বিজয়ার উদ্যোগেই। টুইটারের তৎকালীন সিইও জ্যাক ডরসি এবং বিজয়া বিশেষ বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন যে, বর্ণবাদে প্ররোচনা দিতে পারে এমন বিষয়বস্তু মাইক্রোব্লগিং সাইটে ঠাঁই পাবে না।
ঘনিষ্ঠ মহলে বামপন্থী হিসাবে পরিচিত হলেও বিজয়ার দাবি যে, তিনি রাজনীতি থেকে শত ক্রোশ দূরে থাকেন।
তবে বিজয়াকে বরখাস্ত করার যে সিদ্ধান্ত টুইটারের নয়া মালিক নিয়েছেন, তা কি খুব অপ্রত্যাশিত ছিল? টুইটার দখলের আগে থেকেই ইলনের দাবি ছিল এই মাইক্রোব্লগিং সাইটের কর্তারা টুইটারে একাধিক ভুয়ো অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন।
টুইটারে বাক্স্বাধীনতা নেই বলেও অভিযোগ এনেছিলেন ইলন। আর তাই মনেই করা হচ্ছিল টুইটারের দখল হাতে পাওয়ার পর পরই পরিচালক দলের সঙ্গে বোঝাপড়ায় নামবেন তিনি। হলও তাই।
টুইটার অধিগ্রহণের পর থেকেই একের পর এক চমক দিচ্ছেন মাস্ক। টুইটারের সিইও পরাগ থেকে শুরু করে বিজয়া, অনেককেই তিনি শুরুতেই ছাঁটাই করেছেন। সম্প্রতি টুইটারের ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া বা ‘ব্লু টিক’ অর্জনের প্রক্রিয়ায় বদল আসতে চলেছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।