মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে প্রথাগত সঞ্চয়ের থেকে কিছুটা সরে এসেছে আমজনতা। মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশই লগ্নি করছেন মিউচুয়াল ফান্ডে। আর্থিক দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এতে লাভের সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। দু’ভাবে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা যায়। একটিকে বলা হয় লাম্পসাম লগ্নি, অপরটির নাম সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান বা এসআইপি।
মিউচুয়াল ফান্ডের লাম্পসাম লগ্নিতে ঝুঁকির মাত্রা অনেকটাই বেশি। এটি পুরোপুরি শেয়ার বাজারের উত্থান-পতনের উপর নির্ভরশীল। অন্য দিকে এসআইপিতে আর্থিক দিক থেকে লোকসানের আশঙ্কা তুলনামূলক ভাবে কম। আর তাই সরকারি তথ্য বলছে, দ্বিতীয় শ্রেণির মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নির পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আগামী দিনে এসআইপিতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
মিউচুয়াল ফান্ডের এসআইপির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, এতে লগ্নি করতে বিরাট অঙ্কের টাকা লাগে, এমনটা নয়। মাত্র ২০ টাকা দিয়েও এতে বিনিয়োগ শুরু করা যেতে পারে। এসআইপিতে প্রাপ্ত সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। ফলে অল্প লগ্নিতে মোটা টাকা লাভের সুযোগ থাকে।
মজার বিষয় হল, দৈনিক ২০ টাকার এসআইপিতে গ্রাহক বছরে ১৪ শতাংশ হারে সুদ পেতে পারেন। এই সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে তাঁর জমা করা অর্থের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকবে। সে ক্ষেত্রে ২০ বছরে ৩৪ লক্ষ টাকার মালিক হতে পারেন তিনি। এসআইপির অত্যন্ত লাভজনক এই ফর্মুলাকে বলা হয় ২০-২০-২০। বর্তমানে মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ এই হিসাব মাথায় রেখে লগ্নি করছেন।
এসআইপিতে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে লগ্নি করলে ২০ বছর পরে ৫০ লক্ষ টাকা পেতে পারেন গ্রাহক। বার্ষিক ১২ শতাংশ সুদের হারে এই পরিমাণ রিটার্ন পেতে পারেন তিনি। সুদের হার বাড়লে আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে মুনাফা। প্রাপ্ত ৫০ লক্ষের মধ্যে ১২ লক্ষ টাকা হল লগ্নিকারীর প্রাথমিক বিনিয়োগ। বাকি টাকা সুদ বাবদ পাবেন তিনি।
এসআইপি গ্রাহকের মাসিক সঞ্চয়ের পরিমাণ ১০ হাজার টাকা হলে বার্ষিক ১২ সুদের হারে ২০ বছর পর সুদেমূলে সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে এক কোটি টাকায়। একই ভাবে ২৫ বছরের জন্য এসআইপিতে টাকা রাখলে বাড়বে মুনাফার সূচক। সে ক্ষেত্রে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা লগ্নিকারী পাবেন ৯৫ লক্ষ টাকা। আর ১০ হাজারের বিনিয়োগকারীর সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১.৯ কোটি।
আর্থিক বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য এসআইপিতে বিনিয়োগ শুরু করার আগে ব্যয়ের হিসাব এবং আর্থিক সঙ্গতির বিষয়টি মাথায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। উদাহরণ হিসাবে সন্তানের শিক্ষার খরচের কথা ভেবে কেউ কেউ এসআইপি করে থাকেন। এতে ২০ বছর পর পর ২৫ লক্ষ টাকা বা ২৫ বছর পর ৩৫ লক্ষ টাকার প্রয়োজন হতে পারে। এসআইপি থেকে ওই টাকা পেতে হলে গ্রাহককে কমপক্ষে ৩০ বছরের জন্য এতে লগ্নি করতে হবে।
৩০ বছরের এসআইপিতে প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা করে লগ্নি করলে মেয়াদপূর্তিতে এক কোটির বেশি টাকা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে গ্রাহক ইচ্ছা করলে ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন। কারণ এতে দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রাস্ফীতি-সমন্বিত মুনাফা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে বিশেষজ্ঞেরা দু’-তিনটি মিউচুয়াল ফান্ড প্রকল্পে এসআইপিতে লগ্নির পরামর্শ দিয়ে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, বিনিয়োগে বৈচিত্র রাখতেও বলেছেন তাঁরা। বিনিয়োগের আগে কোন তহবিল কেমন মুনাফা দিচ্ছে, সে দিকে নজর দিতে বলেছেন বিশ্লেষকেরা।
আর্থিক বিশেষজ্ঞেরা কম বয়স থেকে এসআইপিতে লগ্নি শুরু করার কথা বলেছেন। সে ক্ষেত্রে প্রতি মাসে কম টাকা বিনিয়োগ করে অবসরের পর মোটা অর্থ হাতে পাওয়ার সুযোগ পাবেন গ্রাহক। বেশি বয়সে এসআইপি শুরু করে অনেকটা রিটার্ন পেতে হলে বাড়াতে হবে লগ্নির পরিমাণও।
এসআইপির ২০-২০-২০ ফর্মুলায় প্রথম বছরে গ্রাহককে বিনিয়োগ করতে হবে ৭,৩০০ টাকা। প্রতি বছর ২০ শতাংশ করে লগ্নির পরিমাণ বৃদ্ধি করবেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, সংশ্লিষ্ট এসআইপিতে বছরে প্রায় ১৪ শতাংশ সুদ পাবেন ওই গ্রাহক। লার্জ ক্যাপের মিউচুয়াল ফান্ডগুলি গত এক দশকে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ সুদ প্রদান করেছে।
এই হিসাবে ওই গ্রাহকের ২০ বছরে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩.৪৪ লক্ষ টাকা। মেয়াদ শেষে সংশ্লিষ্ট এসআইপির সুদের মাত্রা ২০.৪৪ লক্ষ টাকায় গিয়ে পৌঁছবে। অর্থাৎ, সুদেমূলে মোট ৩৩.৯৮ লক্ষ টাকা পাবেন লগ্নিকারী।
আর্থিক বিশ্লেষকদের কথায়, শেষ তিন মাস বাদে দু’বছর ধরে যথেষ্ট চাঙ্গা রয়েছে ভারতের শেয়ার বাজার। এর সুফল পাচ্ছেন মিউচুয়াল ফান্ডের লগ্নিকারীরা। এসআইপিতে কম করে হলেও ১২ শতাংশ সুদ মিলছে। বাজার আরও চড়লে এই অঙ্ক ১৫ থেকে ১৬ শতাংশে পৌঁছনোর সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সুদেমূলে প্রাপ্তির পরিমাণ যে আরও বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
দিনে মাত্র ২০ টাকা দিয়ে এসআইপি শুরু করার যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনই ধারাবাহিক ভাবে এতে লগ্নি চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের কথায়, এসআইপি থেকে ভাল লাভ পেতে হলে চাই ধৈর্য। সময়ের আগে মূলধন তুলে নিলে কখনওই সেটা পাবেন না গ্রাহক।
এসআইপি থেকে আবার অবসরের পর মোটা টাকা পেনশন পাওয়ার সুবিধা রয়েছে। এর নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় সংস্থা হল পেনশন ফান্ড রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা পিএফআরডিএ। এই প্রকল্পে যে কেউ লগ্নি করতে পারেন। মূলত নাগরিকদের সামাজিক সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে এই প্রকল্প চালু করেছে সরকার।
অবসরের পর এনপিএসের অ্যাকাউন্ট থেকে গ্রাহকের টাকা তুলে নেওয়ার অনুমতি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে আয়কর ছাড় পাবেন তিনি। অবসরের পর যদি দেখা যায় এনপিএস অ্যাকাউন্টে গ্রাহক পাঁচ লক্ষ টাকার বেশি জমিয়েছেন, তা হলে সম্পূর্ণ অর্থ কর ছাড়া তুলে নিতে পারবেন তিনি।
কিন্তু, টাকার অঙ্ক আরও বেশি হলে এনপিএস অ্যাকাউন্টের ৬০ শতাংশ অর্থ প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে আয়করে ছাড় পাবেন সংশ্লিষ্ট গ্রাহক। বাকি টাকায় অবশ্যই তাঁকে অ্যানুইটি প্ল্যান কিনতে হবে। এনপিএসের এই অংশটি আয়করের আওতাধীন।
অ্যানুইটি থেকে গ্রাহকের কত টাকা আয় হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করবে এনপিএসে করের পরিমাণ। অ্যানুইটি সার্ভিস প্রোভাইডারের (এএসপি) থেকে এই প্রকল্পের লাভের অর্থ সরাসরি অ্যাকাউন্টে পাবেন লগ্নিকারী। এনপিএস অ্যাকাউন্টে সঞ্চিত অর্থের একাংশ ব্যবহার করে এই অ্যানুইটি কিনতে হবে তাঁকে।
সব ছবি: সংগৃহীত।