যকৃতে ক্যানসার ধরা পড়েছিল এক বছর আগে। পাঁচ দিন আগে গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় মুম্বইয়ের এক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল অভিনেতাকে। সোমবার হাসপাতালেই মারা যান বলিউডের খ্যাতনামী কৌতুকাভিনেতা অতুল পারচুরে।
প্রায় তিন দশক ধরে অভিনয়জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অতুল। হিন্দি ফিল্মজগতের পাশাপাশি মরাঠি ধারাবাহিকের জগতেও কম সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শাহরুখ খান, সলমন খান, অজয় দেবগনের মতো বলি তারকার সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন অতুল।
১৯৬৬ সালের ৩০ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের মুম্বইয়ে জন্ম অতুলের। সেখানেই স্কুল এবং কলেজের পড়াশোনা শেষ করেছিলেন তিনি। অভিনয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল বরাবর। কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি মরাঠি থিয়েটারে অভিনয় করতে শুরু করেছিলেন।
থিয়েটারে কম সময়ের মধ্যেই নামডাক হয় অতুলের। ‘খিচড়ি’ নামের একটি মরাঠি ছবিতে প্রথম অভিনয় করেছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অজয় দেবগন, উর্মিলা মাতন্ডকর অভিনীত ‘বেদর্দি’ নামের হিন্দি ছবিতে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
সাত বছরের বিরতির পর আবার বড় পর্দায় দেখা গিয়েছিল অতুলকে। ২০০০ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় শাহরুখ খানের ছবি ‘ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’। এই ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অতুল।
তার পর ‘কিঁউ কি… ম্যায় ঝুট নেহি বোলতা’, ‘স্টাইল’, ‘কয়া দিল নে কহা’, ‘চোর মাচায়ে শোর’, ‘গোলমাল’, ‘সালাম-এ-ইশক’, ‘পার্টনার’ এবং ‘বিল্লু বার্বার’-এর মতো একাধিক হিট ছবিতে অভিনয়দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছিলেন অতুল।
‘জাগো মোহন প্যারে’, ‘ভাগো মোহন প্যারে’র মতো ধারাবাহিকে অভিনয় করে ছোট পর্দায় কৌতুকাভিনেতা হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন অতুল। কপিল শর্মার শোয়েও কৌতুক প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। সেখানে বাঙালি অভিনেত্রী সুমনা চক্রবর্তীর বাবার ভূমিকায় অভিনয় করতেন অতুল। কম সময়ের মধ্যেই দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন অভিনেতা।
তবে অসুস্থতার জন্য কপিল শর্মার শো থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল অতুলকে। কানাঘুষো শোনা যায়, কপিল যখন তাঁর দলের সব সদস্যকে নিয়ে বিদেশে অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, তখন অসুস্থ থাকার কারণে বাদ পড়েছিলেন অতুল।
২০২৩ সালে দেওয়া এক পুরনো সাক্ষাৎকারে অতুল জানিয়েছিলেন, ২৫তম বিবাহবার্ষিকী উদ্যাপন করতে পরিবারের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ জ়িল্যান্ড ঘুরতে গিয়েছিলেন অতুল। ঘুরতে গিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ বোধ করছিলেন তিনি। কিন্তু বিদেশ সফর থেকে ফিরে হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়েন অতুল।
স্বাস্থ্যপরীক্ষার পর অতুল জানতে পেরেছিলেন, যকৃতে ক্যানসার হয়েছে তাঁর। ৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের টিউমার রয়েছে তাঁর যকৃতে। অতুল সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর আমি কিছু খেতে পারছিলাম না। শরীর খারাপ থাকত। আমার ভাই কিছু ওষুধ দিয়েছিল। কিন্তু কিছুই কাজ দিচ্ছিল না। পরে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে চিকিৎসক জানান যে, টিউমার ধরা পড়েছে। আমি তাড়াতাড়ি সেরে উঠব সেই আশ্বাসও দিয়েছিলেন তিনি।’’
দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার তাগিদে চিকিৎসা শুরু করাতে চেয়েছিলেন অতুল। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, অস্ত্রোপচারের পর তাঁর যকৃতে জল জমতে পারে। মৃত্যুর আশঙ্কাও রয়েছে। তাই অন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছিলেন অতুল। দ্বিতীয় বার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আবার চিকিৎসার পথে হাঁটা শুরু করেছিলেন তিনি।
অতুল সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘প্রাথমিক স্তরে আমার ভুল চিকিৎসা করা হয়েছিল। আমার অগ্ন্যাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ভুল চিকিৎসার কারণে দিন দিন শারীরিক অবনতি হচ্ছিল। ঠিক মতো হাঁটাচলা করতে পারছিলাম না। কথা বলতে গিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল। আমায় আরও দেড় মাস অপেক্ষা করতে বলেছিলেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা জানিয়েছিলেন, যদি আমার অস্ত্রোপচার করানো হয় তবে যকৃতে জল জমে যাবে। সারা বছর জন্ডিসে ভুগতে পারি আমি। মৃত্যুর আশঙ্কাও রয়েছে। সব শোনার পর আমি চিকিৎসক বদলে ফেলি। কেমোথেরাপি শুরু হয় আমার।’’
ক্যানসার হয়েছে জানার পরেও মৃত্যুভয় জন্মায়নি অতুলের। পুরনো সাক্ষাৎকারে এমনটাই দাবি করেছিলেন তিনি। অতুল বলেছিলেন, ‘‘আমি যখন জানতে পারি যে আমার ক্যানসার হয়েছে তখন আমি জানতে চাইনি তা কোন পর্যায়ে রয়েছে। আমার রাতে ঘুম হত না। তবে তা অসুস্থতার কারণে নয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি ভাবতাম, আবার কবে থেকে কাজ করতে পারব।’’
চিকিৎসা চলাকালীন ২০ কেজি ওজন কমে গিয়েছিল অতুলের। অসুস্থতার সময় তাঁর পাশে বটগাছের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অতুলের স্ত্রী সোনিয়া পারচুরে এবং সন্তান শাখিল পারচুরে। সোনিয়া পেশায় নৃত্যশিল্পী এবং শাখিল মুম্বইয়ে ফ্যাশন স্টাইলিস্ট হিসাবে কাজ করেন।
অতুল সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আমি যে রোগী তা কখনও আমার পরিবার আমাকে বুঝতেই দেয়নি।’’ কাজ না থাকার জন্য চিন্তা হত অতুলের। তিনি জানিয়েছিলেন, উপার্জনের চেয়ে খরচের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাঁর। সংসার কী ভাবে চলবে তা নিয়েই চিন্তা করতেন অভিনেতা।
সুস্থ হয়ে ওঠার পর আবার কাজে ফিরতে চেয়েছিলেন অতুল। করেছিলেনও তাই। মরাঠি ধারাবাহিক এবং থিয়েটারে অভিনয় শুরু করেছিলেন তিনি। চলতি বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি মরাঠি ছবিতেও অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে মরাঠি থিয়েটারে অবদানের জন্য অতুলকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। বলিউডের ‘শাহেনশা’ অমিতাভ বচ্চনের হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছিলেন তিনি। সেপ্টেম্বর মাসে মরাঠি নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি।
অতুলের ছোটবেলার বন্ধু এবং মরাঠি অভিনেতা জয়বন্ত ওয়াড়কার জানান, অতুলের সঙ্গে তিনি কয়েক দিন আগেই নাটকের মহড়া দিয়েছিলেন। হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় অতুলকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। চিকিৎসা চলাকালীন সেখানেই মৃত্যু হয় ৫৭ বছরের কৌতুকাভিনেতার।
সব ছবি: সংগৃহীত।