প্রেম, ভারী অদ্ভুত শব্দ। কবি-সাহিত্যিক থেকে শুরু করে দার্শনিকদের কাছে এর আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা রয়েছে। পিছিয়ে নেই প্রকৃতিপ্রেমীরাও। পশুপাখি হোক বা কীটপতঙ্গ, জীবজগতের নানান ভালবাসার মুহূর্ত খুঁজে ফেরেন তাঁরা। যা চাক্ষুষ করতে এ বার তাঁদের ভিড় জমাতে দেখা যাবে আমেরিকার কলোরাডোর চারণভূমিতে।
শরৎ এলেই বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ট্যারেন্টুলা মাকড়সার দল। কারণ, অক্টোবর লোমশ আটপেয়ীদের মিলন-মাস। পছন্দের সঙ্গী খুঁজে নেয় তারা। যা চোখে দেখার সুযোগ ছাড়তে নারাজ মাকড়সাপ্রেমীরা। আর তাই কলোরাডোর কৃষিভিত্তিক ছোট্ট মফস্সল লা জুন্টায় ভিড় করছেন তাঁরা। এখানকার চারণভূমিই যৌন মিলনের জন্য সবচেয়ে পছন্দ করে ট্যারেন্টুলা।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, আকারে বড় লোমশ এই আটপেয়ীদের চাক্ষুষ করা নিয়ে আমেরিকাবাসীদের মধ্যে রয়েছে প্রবল উৎসাহ। কীটপতঙ্গের গবেষক, মাকড়সাপ্রেমী ও কলোরাডোর আমজনতাকে এ ক্ষেত্রে এক সারিতে ফেলা যায়। সপ্তাহান্তে সূর্যাস্তের সময়ে বাসে চেপে রীতিমতো গাদাগাদি করে বিস্তীর্ণ চারণভূমিতে পৌঁছে যাচ্ছেন তাঁরা। ট্যারেন্টুলা দেখার জন্য উৎসাহী জনতার ভিড় বেড়েই চলেছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
মিলনের মাসে গোপন ডেরা থেকে বেরিয়ে এসে বিশেষ ধরনের এই মাকড়সাগুলি শুকনো সমতলভূমিতে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। সূর্যাস্তের পর সেগুলিকে দেখতে হলে আলোর প্রয়োজন। ট্যারেন্টুলাপ্রেমীরা এর জন্য মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাশলাইট ও গাড়ির হেডলাইটের আলো ব্যবহার করছেন বলে জানা গিয়েছে।
ট্যারেন্টুলাকে নিয়ে আমেরিকায় এই উৎসাহ আজকের নয়। ১৯৯০ সালে মুক্তি পায় ‘আরাকানোফোবিয়া’ নামের একটি চলচিত্র। যাতে লা জুন্টার মতো ছোট্ট একটি মফস্সলকে দেখানো হয়েছিল। লোমশ আটপেয়ীরা সেই শহর এক রকম দখল করে নিয়েছিল। ঐতিহাসিক ‘ফক্স থিয়েটার’-এ দীর্ঘ দিন চলেছিল ওই সুপারহিট ছবি।
লা জুন্টার বাসিন্দাদের দাবি, ট্যারেন্টুলা মোটেই দুঃস্বপ্নের প্রাণী নয়। বহু বার এটিকে রুপোলি পর্দায় দেখানো হয়েছে। প্রাণীগুলিকে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, এই ট্যারেন্টুলার আকর্ষণে ফি-বছর বহু মানুষ আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে ছুটে আসেন।
আটপেয়ী লোমশ কীটটিকে কেন্দ্র করে লা জুন্টায় চলে উৎসব। এখানকার বাসিন্দারা তাদের নিয়ে গল্প করতে ভালবাসেন। গাড়ির বনেট বা জানলার কাচে ভীমদর্শন মাকড়সা ঘুরে বেড়ানোর কথা ফলাও করে বলেন তাঁরা। এ বার এই ‘ট্যারেন্টুলা উৎসব’ তৃতীয় বর্ষে পা রেখেছে।
এ বছরের মাকড়সা উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা নাথান ভিলারিয়াল। তিনি আবার পেশায় ট্যারেন্টুলা প্রজননকারী। তাঁর কথায়, ‘‘সঙ্গম মরসুমের কথা শুনেছিলাম। তখনই সেই বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’’ ভিলারিয়াল পোষ্য হিসাবে ট্যারেন্টুলা বিক্রি করেন। আর এ ব্যাপারে আমেরিকায় তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে।
লা জুন্টায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ‘কলোরাডো ব্রাউন’ ট্যারেন্টুলা। এখানকার ‘কোমাঞ্চ জাতীয় তৃণভূমি’তে গর্ত তৈরি করে তার মধ্যে বাসা তৈরি করে বিশেষ প্রজাতির এই মাকড়সা। ভূবিজ্ঞানীদের কাছে চারণভূমিটি ‘প্রেইরি’ হিসাবে খ্যাত।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ট্যারেন্টুলারা সঙ্গীর খোঁজে ওই তৃণভূমিতে পাগলের মতো ঘুরে বেড়ায়। স্ত্রী ট্যারেন্টুলার বাসা সাধারণত বোঝা যায় রেশমের জালে। দিনের উত্তাপ কমলে সন্ধ্যা নামার মুখে আটপেয়ীদের সঙ্গী খুঁজে নিতে দেখা যায়। সেই দৃশ্য দেখার জন্য প্রায় এক ঘণ্টা সময় পেয়ে থাকে উৎসবে ভিড়জমানো জনতা।
পূর্ব মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক কারা শিলিংটন জানিয়েছেন, ‘‘পুরুষ ট্যারেন্টুলার প্রজনন ক্ষমতায় পৌঁছতে সাত বছর সময় লাগে। তবে সঙ্গম-সক্ষমতা চলে এলে মাত্র এক বছর বেঁচে থাকে পুরুষ ট্যারেন্টুলা। মহিলাদের ক্ষেত্রে যা ২০ বছর। তবে এই প্রজাতির পুরুষ আটপেয়ীরা সারা জীবন ধরে উপযুক্ত সঙ্গীর সন্ধান চালিয়ে যেতে পারে।
সাধারণত একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ট্যারেন্টুলা পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হয়। তাদের মাথায় থাকে অ্যান্টেনার মতো এক জোড়া শুঁড়। যা দিয়ে স্ত্রী ট্যারেন্টুলাকে মিলনের জন্য ডাকে তারা। স্ত্রী মাকড়সাটি সঙ্গমে ইচ্ছুক হলে হামাগুড়ি দিয়ে বাসার বাইরে বেরিয়ে আসে। আর তখনই পুরুষ আটপেয়ীটি তার পা আটকে দেয়।
ট্যারেন্টুলার মিলন খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়। যা শেষ হলেই সেখান থেকে ছুটে পালায় পুরুষ মাকড়সা। কারণ, তা না করলে স্ত্রী ট্যারেন্টুলাটি তাকে দিয়েই ভোজ সেরে ফেলে। ওই সময়ে স্ত্রী মাকড়সা আকারে বড় হতে শুরু করে। গর্ভাবস্থা বজায় রাখতে তাদের দেহে অতিরিক্ত পুষ্টির প্রয়োজন হয়। আর তাই সঙ্গীকে ভক্ষণ।
জীববিজ্ঞানী শিলিংটনের দাবি, ‘‘ট্যারেন্টুলা অত্যন্ত বিনয়ী প্রাণী। তাদের বিষ মোটেই বিপজ্জনক নয়। এতে মানুষের মৃত্যুর কোনও আশঙ্কা নেই। তবে ট্যারেন্টুলার বিষে দেহে ব্যথা বা জ্বালা হতে পারে।’’
‘‘আপনি যদি ওদের মুখোমুখি হন, তা হলে ট্যারেন্টুলার কামড় খেতে হতে পারে। কারণ, এই মাকড়সাগুলি ভয় পেলেই কামড়ায়। তবে সেই পরিস্থিতি তৈরি না হলে ট্যারেন্টুলা কখনওই মানুষকে আক্রমণ করে না।’’ জানিয়েছেন পূর্ব মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক শিলিংটন।
কলোরাডোর এই ট্যারেন্টুলা উৎসবে ফি-বছর যোগ দেয় এলাকার কচিকাঁচা থেকে স্কুলপড়ুয়ারাও। এটি মাকড়সা নিয়ে তাদের ভয় কাটাতে সাহায্য করছে। অনেকেই মাকড়সার উল্কি করেন। আবার কেউ কেউ ট্যারেন্টুলাকে ‘খুব সুন্দর প্রাণী’ বলে সমাজমাধ্যমে পোস্টও দেন। এই উৎসব জীববিজ্ঞান নিয়ে ছোটদের উৎসাহ বাড়ানোর কাজ করছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
সব ছবি: সংগৃহীত।