পরিপাটি করে কাটা চাপদাড়ি। সঙ্গে লম্বা চুল। গরমকালে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। শীতকালে সংযোজন হয় নেহরু কোটের। কখনও আবার রঙিন বাহারি শালের। সেগুলির বেশিরভাগই স্ত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে উপহার পাওয়া। এই ইস্তক বাংলা তথা সারা দেশের মানুষ এ ভাবেই দেখতে অভ্যস্ত রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
সুদীপের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাঁকে রাজ্য এবং কেন্দ্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখা গিয়েছে। মন্ত্রী হয়েছেন। জেলে গিয়েছেন। তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড হয়েছেন। দল বদলেছেন। তবে তাঁর চুল এবং দাড়ির ছাঁট বিশেষ বদলাননি। টোপা গালের উপর চাপ দাড়ি তাঁর সব সময়ই ছিল। কালের নিয়মে সেই দাড়িতে পাক ধরেছে। কুচকুচে কালো থেকে কাঁচা পাকা হয়ে এখন তা শ্বেতশুভ্র। চুলও তাই। সব সময় চুল ‘ব্যাকব্রাশ’ করে রাখলেও মাঝখানে কিছু দিন কায়দা করে মাঝখানে সিঁথি রেখেছিলেন। তবে এখন আবার ফিরিয়েছেন পুরনো ‘স্টাইল’। সুদীপের চুল-দাড়ির মতো তাঁর অমলিন হাসিও সুপরিচিত।
সুদীপের জন্ম মুর্শিদাবাদে। বহরমপুরের কেএন কলেজ থেকে পড়াশোনা। সেখানেই ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু। সুদীপের দাড়িপ্রীতিও সেই কলেজ জীবন থেকেই। কলেজ জীবন পার করে এসে কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির হাত ধরে কলকাতায় আগমন। প্রিয়রঞ্জনের হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেসের সভাপতিও হন। প্রিয়রঞ্জন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন ১৯৮৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আব্দুল রউফ আনসারির বদলে বৌবাজার কেন্দ্র থেকে সুদীপকে টিকিট দেয় কংগ্রেস। যা নিয়ে যথেষ্ট হইচইও পড়েছিল প্রদেশ কংগ্রেসের অন্দরে। তবে সেই নির্বাচনে বৌবাজার থেকে জিতে বিধায়ক হন সুদীপ। তার পর থেকে টানা বিধায়ক ছিলেন তিনি। সেই সময় মূলত কুচকুচে কালো চাপদাড়ি এবং ‘ব্যাকব্রাশ’ চুলেই দেখা যেত সুদীপকে।
১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল দল গঠন করলে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে আসেন সুদীপ। ওই বছরের লোকসভা নির্বাচনে তাঁকে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম আসন থেকে প্রার্থী করেন মমতা। জিতে সাংসদ হন সুদীপ। বৌবাজারের বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেন। তাঁর বদলে উপনির্বাচনে জিতে বৌবাজারের বিধায়ক হন স্ত্রী নয়না।
১৯৯৯ সালে তৃণমূলের প্রতীকে আবার লোকসভার সাংসদ হন সুদীপ। তখন মমতা কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী। তবে সেই সময় বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে সুদীপের সুসম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত ছিল। আডবাণীর হাত ধরে সুদীপ যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, সে কথাও কারও অজানা ছিল না। তবে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সুদীপের এই ‘অতিসক্রিয়তা’ পছন্দ হয়নি দলনেত্রীর। তাঁদের সম্পর্কে চিড়ও ধরে। মমতা স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, তৃণমূল তাঁর দল। তাঁর দল থেকে কে মন্ত্রী হবেন, সেই সিদ্ধান্তও একান্তই তাঁর। তাই সুদীপকে যেন কোনও ভাবেই মন্ত্রী না করা হয়। তখন আর সুদীপের মন্ত্রী হওয়া হয়নি।
সেই ঘটনার রেশ ধরেই ২০০৪ সালে সুদীপের পরিবর্তে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্রে অধুনা প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে টিকিট দেন মমতা। টিকিট না পেয়ে ক্ষোভে উত্তর-পশ্চিম থেকে জোড়া মোমবাতি প্রতীকে নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়ান সুদীপ। ২০০৪ সালের সেই ভোটে ৮১ হাজার ভোট পান সুদীপ। তবে তিনি এবং সুব্রত দু’জনেই হেরে যান। ভোট কাটাকাটির জন্য জিতে যান সিপিএম প্রার্থী সুধাংশু শীল। জেতা আসন হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় সুদীপকে নিয়ে দলের অন্দরে ক্ষোভ তৈরি হয়। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ানোর কারণে তাঁকে ছ’বছরের জন্য সাসপেন্ড করে তৃণমূল। তখন সুদীপ পাকা রাজনীতিবিদ। তবে তখনও তাঁর দাড়িতে পাক ধরেনি।
এর পর সৌমেন মিত্রের হাত ধরে আবার কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন হয় সুদীপের। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বৌবাজার থেকেই আবার বিধায়ক হন সুদীপ। কিন্তু ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে মমতার সঙ্গে সম্পর্ক শুধরে নিয়ে আবার তৃণমূলে ফেরেন। সুদীপকে নবগঠিত কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করেন মমতা। সেই নির্বাচনে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের জোট প্রার্থী হিসাবে সিপিএমের মহম্মদ সেলিমকে পরাজিত করেন সুদীপ। সংসদে যাওয়ার পর ২০০৯ সালেই তাঁকে লোকসভার দলনেতার দায়িত্ব দেন মমতা।
এর পর ২০১১ সালে বামদুর্গের পতন ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সরকার গড়ে তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা। কেন্দ্রের রেলমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়ায় সেই মন্ত্রকের দায়িত্ব পান দীনেশ ত্রিবেদী। দীনেশ যে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, সেখানে আসেন সুদীপ। তবে তাঁর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদ বেশি দিন থাকেনি। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’ নীতি নিয়ে ইউপিএ সরকারের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ার কারণে জোট ছাড়েন মমতা। মমতার নির্দেশে প্রতিমন্ত্রী পদ থেকে সরে যান সুদীপ। এর পর সুদীপের রাজনৈতিক যাত্রা মোটামুটি বাধাহীনই ছিল। বাধা আসে ২০১৭ সালে।
রোজভ্যালিকাণ্ডে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৭-র জানুয়ারিতে সুদীপকে গ্রেফতার করে সিবিআই। তাঁকে ভুবনেশ্বরে নিয়ে যাওয়া হয়। সুদীপ যখন গ্রেফতার হন, তখন তাঁর চুল, গোঁফ, গাল-গলার দাড়ি কাঁচা থাকলেও, থুতনির দাড়ি পাকা। তাঁর ঘনিষ্ঠদের মতে, ইচ্ছা করেই তখন ওই ‘লুক’ রেখেছিলেন সুদীপ।
এর পর জেল এবং হাসপাতাল মিলিয়ে ভুবনেশ্বরে মোট ১৩৬ দিন কাটে সুদীপের। অবশেষে ওই বছরের ২১ মে জামিনে মুক্তি পান তিনি। তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। কিন্তু যে সুদীপকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তার সঙ্গে জামিনে মুক্তি পাওয়া সুদীপের বিস্তর ফারাক দেখা যায়। চুল কাঁচা-পাকা থাকলেও তাঁর দাড়ি তখন ধবধবে সাদা। শরীরও ভেঙে গিয়েছিল। এর পর থেকে আর কখনও কালো চুল-দাড়িতে দেখা যায়নি সুদীপকে।
সেই সুদীপ ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আবার তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর প্রার্থী হওয়া নিয়ে অনেক জল্পনা তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ এবং সদ্য তৃণমূলত্যাগী প্রবীণ বিধায়ক তাপস রায় উপর্যুপরি সুদীপকে লক্ষ্য করে তোপ দাগা শুরু করার পর। তাপস তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গেলেও কুণাল এবং সুদীপের মধ্যে মিটমাট হয়েছে। ১০ মার্চ তৃণমূলের ‘জনগর্জন’ সভা থেকে তৃণমূলের প্রবীণ রাজনীতিক সুদীপকে উত্তর কলকাতার প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করেছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুদীপের বয়স এখন ৭২। চুল এবং দাড়ি শ্বেতশুভ্র। মাথার সামনের দিকের কিছুটা ফাঁকা হয়েছে। তবে এখনও যে তিনি বাংলার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক, তা প্রমাণ হয়েছে তৃণমূল তাঁকে লোকসভার নির্বাচনে প্রার্থী করার পর।
ছবি: পিটিআই।