একটা ফোন কল বা ইমেল। কখনও কখনও সমাজমাধ্যমে পোস্ট। যাতে থাকে বোমা বিস্ফোরণের হুমকি। আর সেটা এলেই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের মনে তৈরি হয় আতঙ্ক। উড়ান থামিয়ে চলে চিরুনিতল্লাশি। এমনকি গোটা বিমানবন্দর খালি করে বোমা খোঁজার নজিরও রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এই ধরনের বোমাতঙ্কের খবরে ভারতীয় উড়ান সংস্থাগুলির রীতিমতো নাজেহাল দশা। এর জেরে চলতি বছরের শুধুমাত্র অক্টোবরেই অন্তত ২০টি বিমানের পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই ভুয়ো হুমকি পেয়েছে সংশ্লিষ্ট বিমানবন্দর বা উড়ান সংস্থা। তবে এগুলিকে হালকা ভাবে নিতে নারাজ অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক।
যাত্রীবোঝাই বিমান উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি পেলে উড়ান সংস্থার কী কী করণীয়? কোন কোন পদক্ষেপ করতে হবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে? ইতিমধ্যেই এই সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা জারি করেছেন অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের ডিরেক্টর জেনারেল। অন্য দিকে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলির যোগসূত্র খুঁজে পেতে তদন্তে নেমেছে পুলিশ।
সাধারণত, এই ধরনের হুমকি ফোন বা ইমেল উড়ান সংস্থা বা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অফিসে আসে। অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের তরফে জারি করা নির্দেশিকায় প্রথমেই বলা হয়েছে, বিস্ফোরণের হুমকি আসল না নকল, তা খতিয়ে দেখতে হবে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা আঁটসাঁট করতে বলা হয়েছে।
পাশাপাশি, উড়ান সংস্থাগুলিকে ‘সুনির্দিষ্ট’ ও ‘অনির্দিষ্ট’ বোমাতঙ্কের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বার করতে বলা হয়েছে। প্রথমটিতে বিশেষ একটি বিমানকে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি ফোন পেয়ে থাকে উড়ান সংস্থা বা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। সে ক্ষেত্রে যে বিমানটিকে উড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তার নম্বর, গন্তব্য বা আগমনের সময়, যাত্রীসংখ্যা-সহ যাবতীয় তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অন্য দিকে যে হুমকি ফোন বা ইমেলগুলিতে বিশেষ কোনও বিমানে বিস্ফোরণের উল্লেখ থাকে না, নির্দেশিকায় সেগুলিকে ‘অনির্দিষ্ট’ শ্রেণিতে রাখতে বলা হয়েছে। এতে বিমানের নম্বর, গন্তব্য, যাত্রীসংখ্যা বা উড়ানের সময় জানা সম্ভব নয়। ফলে এই ধরনের হুমকিকে বেশি বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, মাঝ আকাশে থাকাকালীন বিস্ফোরণের হুমকি পেলে কী করবেন পাইলট? উড়ান পরিবহণ মন্ত্রকের জারি করা নির্দেশিকায়, এই ধরনের পরিস্থিতিতে তাঁকেই সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিমানচালক যেখান থেকে উড়েছিলেন সেখানে ফিরে যেতে পারেন। আবার গন্তব্যেও অবতরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে তাঁর।
এ ছাড়া এই ধরনের পরিস্থিতিতে তৃতীয় একটি বিকল্পও বেছে নিতে পারেন চালক। তা হল, নিকটবর্তী কোনও বিমানবন্দরে উড়োজাহাজটিকে নামাতে পারেন তিনি। তবে সবটাই নির্ভর করবে হুমকিটি কী ধরনের, তার উপর। সুনির্দিষ্ট হুমকি হলে তৃতীয় বিকল্প বেছে নেওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে পাইলটের।
উড়ান সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, উড়োজাহাজের ক্যাপ্টেন বোমা বিস্ফোরণের হুমকি পেলেই ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করবেন। এর পর দ্রুত নিকটবর্তী সামরিক বা অসামরিক কোনও বিমানবন্দরের দিকে উড়ানটিকে নিয়ে যাবেন তিনি। সবশেষে সেখানে নিরাপদে অবতরণ করতে চেয়ে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে বার্তা পাঠাবেন তিনি।
ক্যাপ্টেনের থেকে এই ধরনের বার্তা এলেই বাড়তি সতর্কতা নেবে বায়ুসেনার ঘাঁটি বা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। কোন রানওয়েতে বিমানটি অবতরণ করবে, দ্রুত তা ঠিক করে ফেলা হবে। সেই মতো নির্দেশ যাবে পাইলটের কাছে। সম্পূর্ণ খালি রাখা হবে ওই রানওয়ে। পাশাপাশি, রানওয়ের পাশে প্রস্তুত থাকবে দমকল, বম্ব স্কোয়াড থেকে শুরু করে বিমানবন্দরের রক্ষীবাহিনী।
মাঝ আকাশে বিস্ফোরণের আশঙ্কা রয়েছে, এই খবর কানে গেলে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। প্রাণ বাঁচাতে বিমানের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু করতে পারেন তাঁরা। তাতে দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজ। আর তাই এই ধরনের পরিস্থিতিতে যাত্রীদের শান্ত রাখার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে পাইলটকে।
উড়ান সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী, এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিমানের হঠাৎ যাত্রাপথ পরিবর্তন বা অবতরণের কারণ যান্ত্রিক ত্রুটি বলে উল্লেখ করতে পারেন পাইলট। উড়োজাহাজটি মাটি ছুঁলে যাত্রীদের হ্যান্ডব্যাগ-সহ সেখান থেকে নামিয়ে আনা হবে। এর পর শুরু হবে উড়ানে বিস্ফোরক খোঁজার কাজ।
বিমান থেকে নামিয়ে আনার পর যাত্রীদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে যায় সংশ্লিষ্ট উড়ান সংস্থা। তাঁদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে। এমনকি প্রয়োজনে শিশু, প্রবীণ বা গর্ভবতী মহিলাদের জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে হবে। দিতে হবে পর্যাপ্ত পরিস্রুত পানীয় জল।
আবার এই ধরনের পরিস্থিতিতে যাত্রীদের কী কী করণীয়, সেই সংক্রান্তও নির্দেশিকাও রয়েছে। বোমা বিস্ফোরণের হুমকি পেলে তাঁদের উড়ানের ক্রু মেম্বার, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও নিরাপত্তারক্ষীদের সাহায্য করতে বলা হয়েছে। তাঁদের নির্দেশ মতো পদক্ষেপ করতে হবে যাত্রীদের।
বিমান অবতরণের পর শিশু, গর্ভবতী মহিলা ও প্রবীণদের উড়ান থেকে নামার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে। সারিবদ্ধ ভাবে নামার ক্ষেত্রে একে অপরকে সাহায্য করা বাঞ্ছনীয়। ওই সময়ে হ্যান্ডব্যাগ চিনে নিয়ে তা আগে নিজের কাছে নিয়ে রাখা ভাল।
বিমানবন্দরে পৌঁছে বা উড়ানে ওঠার পর কোনও সহযাত্রীর আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে তা কর্তৃপক্ষকে জানাতে বলা হয়েছে। কী কারণে বা কোন আচরণ থেকে বিষয়টি সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছে, তা সংশ্লিষ্ট যাত্রীকে বলতে হবে। এ ক্ষেত্রে মিথ্যা অভিযোগ করলে অভিযোগকারী বিপদে পড়তে পারেন।
মাঝ আকাশে উড়ানের শৌচালয়ে বোমা বিস্ফোরণের হুমকি চিরকুট যাত্রীদের চোখে পড়ার নজিরও রয়েছে ভূরি ভূরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মনে আতঙ্ক তৈরি হয়। ফলে তিনি চিৎকার করে ফেলেন। সেটা না করে এ ক্ষেত্রে বিষয়টি বিমানের ক্রু মেম্বারদের নজরে আনতে বলা হয়েছে।
বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, বিপন্মুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত উড়ানকে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা করা যাবে না। যাত্রীদের সহযোগিতা পেলে যা দ্রুত করতে পারবে সংশ্লিষ্ট বিমান সংস্থা।
সাম্প্রতিক সময়ে বোমাতঙ্কের হুমকি ফোনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইন্ডিগো, এয়ার ইন্ডিয়া, এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস, আকাসা এয়ার, স্পাইসজেট ও অ্যালায়েন্স এয়ারের মতো উড়ান সংস্থা। এগুলির বিমানকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তবে কোনও ঘটনাতেই বিস্ফোরক উদ্ধার হয়নি।
চলতি বছরের ১৪ অক্টোবর মুম্বই বিমানবন্দরে বোমাতঙ্কের ঘটনায় এক নাবালককে গ্রেফতার করে পুলিশ। একই ধরনের ঘটনায় ছ’টি এফআইআর দায়ের করেছে দিল্লি পুলিশ। বার বার মিথ্যা বিস্ফোরণের হুমকি দেওয়ার পিছনে কে বা কারা রয়েছেন, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।