হলদে-বাদামি বা ধূসর রং। কাঁধ থেকে লেজ পর্যন্ত শরীরে ১৫ থেকে ২০টি গাঢ় ডোরাকাটা দাগ। দেখতে কুকুর ও নেকড়ের মাঝামাঝি। একসময় সারা অস্ট্রেলিয়ায় দাপিয়ে বেড়াত এই প্রাণীটি। পশুপালকদের কাছে আতঙ্কের আর এক নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটি।
তাসমানিয়ান বাঘ। প্রায় এক শতাব্দী আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া একটি প্রজাতি। পিঠে ডোরাকাটা দাগের জন্য একে বাঘের তকমা দেওয়া হলেও আদতে এই প্রাণীটির নাম ছিল থাইলাসিন।
এটি আসলে মার্সুপিয়াল গোত্রের এক ধরনের অস্ট্রেলিয়ান স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা নিজেদের থলিতে করে বাচ্চা লালনপালন করে।
প্রায় ৩ হাজার বছর আগে তাসমানিয়ান বাঘেরা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে দাপিয়ে বেড়াত। তাদের দৌরাত্ম্যে ভেড়াদের প্রাণ বাঁচাতে পশুপালকদের রীতিমতো নাজেহাল অবস্থা হত। সে কারণে গবাদি পশুদের রক্ষা করতে নির্বিচারে নিধন করা শুরু হয় তাসমানিয়ান বাঘের।
এর পর এক প্রজাতির অস্ট্রেলিয়ান কুকুর, ডিঙ্গোর আগমনের পর তাদের সংখ্যা আরও হ্রাস পায়। তার পর একসময় শুধু তাসমানিয়ার দ্বীপে এগুলোর দেখা মিলত এবং অবশেষে এগুলি বিলুপ্তই হয়ে যায়।
শেষ তাসমানিয়ান বাঘের দেখা মিলেছিল ১৯৩৬ সালে। তাসমানিয়ার রাজধানী হোবার্টের বিউমারিস চিড়িয়াখানায় শেষ তাসমানিয়ান বাঘটির মৃত্যু হয়। ১৯৮৬ সালে একে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন এই বিলুপ্ত হওয়া প্রাণীটিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু লুপ্ত প্রজাতির প্রাণীদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার পন্থা কী? তবে কি জুরাসিক পার্কের মতো কাল্পনিক জগতের বাস্তবায়ন সম্ভব।
বিজ্ঞানীরা ১১০ বছর ধরে ইথানলে সংরক্ষিত তাসমানিয়ান বাঘের মাথার খুলি-সহ তাদের গবেষণার জন্য বিভিন্ন জাদুঘর থেকে তাসমানিয়ান বাঘের নমুনা সংগ্রহ করছেন। তাসমানিয়ান বাঘ নিয়ে গবেষণাটি মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও টেক্সাসের প্রতিষ্ঠান কলোসাল বায়োসায়েন্সেসের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে ‘থাইলাসিন ইন্টিগ্রেটেড জেনেটিক রিস্টোরেশন রিসার্চ’ নামে একটি গবেষণাগার তৈরির জন্য ৩০ কোটির অনুদান দেওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
তাসমানিয়ান বাঘের সংরক্ষিত ডিএনএ সমগোত্রীয় একটি প্রাণী ডুনার্টের সঙ্গে মিলিয়ে প্রাণীটিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন কলোসাল বায়োসায়েন্সেসের প্রধান বিজ্ঞান কর্মকর্তা বেথ শাপিরো।
ডুনার্ট নামের প্রাণীটি তাসমানিয়ান বাঘের চেয়ে আকারে অনেক ছোট। তবে এদের মধ্যে সাদৃশ্য হল দুটিই তাদের লেজে চর্বি জমা করে এবং মাংসাশী এই প্রাণী দু’টি শিকারের জন্য ধারালো দাঁত ব্যবহার করে।
গবেষকেরা দুই প্রাণীর জিনোম সম্পাদনা করে ডুনার্টের ডিএনএ কোড (জিনোম) যতটা সম্ভব তাসমানিয়ান বাঘের কোডের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। তাতে দু’টি প্রাণীর জিনোমে বেশ মিল দেখা গিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা প্রথমে ইঁদুরের উপর তাসমানিয়ান বাঘের ডিএনএ প্রতিস্থাপন করে দেখেছেন। তাঁরা দেখেছেন ইঁদুরের মাথার আকারটি প্রত্যাশিত ভাবেই পরিবর্তিত হয়েছে।
তাসমানিয়ান বাঘ নিয়ে এই গবেষণাটি পরিচালনা করছেন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যান্ড্রু পাস্ক। তাঁর বিশ্বাস, খুব শীঘ্রই প্রথম থাইলাসাইন শাবকটি পৃথিবীর আলো দেখবে।
তবে এই দাবি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন জীববিজ্ঞানীদের একাংশ। তাঁদের ধারণা, হারিয়ে যাওয়া প্রাণীর পুনরুত্থান কল্পকাহিনির মতো ব্যাপার। অনেকে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করে জানান, কোথায় থামা উচিত তা বুঝতে পারছেন না গবেষকেরা।
কিন্তু গবেষণারত বিজ্ঞানীদের কথায়, তাঁরা থাইলাসিন বা তাসমানিয়ান টাইগার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে চান বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা রাখতে।
তাসমানিয়ান বাঘ ফিরে এলে তাসমানিয়ান ডেভিল নামের একটি প্রাণীর জনসংখ্যার দ্রুত ছড়িয়ে পড়া সমস্যার সমাধান করতে পারে। কারণ এটিও মার্সুপিয়াল গোত্রের প্রাণী যা তাসমানিয়ায় দেখা যায়।
এই প্রাণীটি এমন একটি মুখের ক্যানসারের জীবাণু বহন করে যা অন্য প্রাণীকে কামড়ালে ছড়িয়ে পড়ে। এদের বৃদ্ধি কমাতে তাসমানিয়ান বাঘকে ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় শুরু করেছেন অষ্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।