সুদের হারে বিরাট লাফ! হঠাৎ করেই তা বেড়ে হল ২১ শতাংশ! রাশিয়ার এই পদক্ষেপে রীতিমতো হতবাক বিশ্বের তাবড় অর্থনীতিবিদেরা। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কুর্সিতে বসার পর পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে সুদের হার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছল বলে জানা গিয়েছে। যার প্রভাব দুনিয়ার অন্য দেশগুলির অর্থনীতিতে পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
চলতি বছরের ২৫ অক্টোবর সুদের হার ২০০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। ২০০৩ সালের পর যা সর্বোচ্চ। এ বছরের ২২ ও ২৩ অক্টোবর রাশিয়ার কাজ়ান শহরে বসেছিল ‘ব্রিকস’ সম্মেলন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল ওই বৈঠক শেষ হতে না হতেই বাদামি ভালুকের দেশে সুদের হারে বেনজির বৃদ্ধি লক্ষ করা গিয়েছে।
সুদের হারের এ হেন অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করেছে মস্কো। রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের দাবি, মূলত সেনাবাহিনীর জন্য সরকারকে মোটা টাকা খরচ করতে হচ্ছে। আর তাই পদক্ষেপ করা ছাড়া অন্য রাস্তা ছিল না। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন ‘বিশেষ ফৌজি অপারেশন’ শুরু করে রাশিয়া। ফলে দু’দেশের মধ্যে বেধে যায় যুদ্ধ। যার খরচ জোগাতে গিয়ে সুদের হার বৃদ্ধি করা হল বলে অবশেষে স্বীকার করল পুতিন প্রশাসন।
রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বলেছে, মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এই সুদের হার বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে মূল্যবৃদ্ধির হার ৮.৪ শতাংশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সুদের হার বৃদ্ধি করা নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর মুদ্রানীতি নিতে হচ্ছে। যা মূল্যবৃদ্ধির হারকে অনেকটাই নীচে নামিয়ে আনবে।’’ উল্লেখ্য, ব্রিকস-ভুক্ত দেশগুলির (চিন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা) মধ্যে মস্কোর সুদের হারই বর্তমানে সবচেয়ে বেশি।
বিজ্ঞপ্তিতে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক আরও জানিয়েছে, মুদ্রানীতি কমিটির পরবর্তী বৈঠকে সুদের হার আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি, ২০২৫ আর্থিক বছরের মুদ্রাস্ফীতির হারের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। আগামী অর্থবর্ষে মূল্যবৃদ্ধির হার ৪.৫ থেকে ৫ শতাংশ নেমে যাবে বলে দাবি করেছেন রুশ আর্থিক বিশ্লেষকেরা। এটিকে ৪ শতাংশে নামাতে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে বলেও জানিয়েছেন তাঁরা।
এই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন রুশ অর্থনীতিবিদ ইভজেনি কোগান। তাঁর কথায়, ‘‘আগামী এক বছরের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির হারকে যে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রায় নামিয়ে আনা যাবে না, তা এক রকম স্বীকার করে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।’’ এই পরিস্থিতিতে সুদের হার বৃদ্ধিকে ‘মুদ্রাস্ফীতির মুখে আত্মসমর্পণ’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
অর্থনীতিবিদদের দাবি, এ বছরের সুদের গড় মূল হার ২০২৪ শেষ হওয়ার আগে আরও ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির জায়গা তৈরি করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে যার পূর্বাভাস দিয়েছে মস্কো। রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নর এলভিরা নাবিউলিনা বলেছেন, ‘‘মূল সুদের হারের স্তরের কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই।’’
রাশিয়ার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিচার করে আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ সুদের হার ১০০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের দাবি, নতুন খসড়া বাজেটকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এ বছরের ক্ষেত্রে যেখানে জিডিপিতে ১.৭ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির নেপথ্যে পুতিন প্রশাসনের শুল্ক নীতিকেও দায়ী করেছে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। যা এ বছর উল্লেখ্যযোগ্য হারে বৃদ্ধি করেছে মস্কো। ১৯৯৮ সালে আর্থিক মন্দার মুখে পড়ে রাশিয়া। ২০০০ সালে ক্ষমতায় এসে মন্দা কাটাতে আর্থিক সংস্কারে জোর দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। যা পূর্ব ইউরোপের দেশটির অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছিল।
পুতিনের আর্থিক সংস্কারের জেরে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের পুনর্অর্থায়নের হার ২০ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত ওই হারে কোনও বদল লক্ষ করা যায়নি।
কিন্তু বর্তমানে ডলারের নিরিখে রাশিয়ান রুবলের দাম অনেকটা পড়ে গিয়েছে। যা মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধির অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এ বছরের অগস্টের শুরু থেকে ডলারের নিরিখে রুশ রুবলের দর কমেছে ১২ শতাংশ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই মস্কোর উপর বিপুল নিষেধাজ্ঞা চাপায় ওয়াশিংটন। রুবলের দামের পতনের ক্ষেত্রে এটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, মত বিশেষজ্ঞদের।
উল্লেখ্য, সুদের হার বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। সাম্প্রতিক অতীতে এই নিয়ে পুতিন প্রশাসনের উপর ব়ড় বড় শিল্পপতিরা চাপ তৈরি করছিলেন। যার প্রথম সারিতে ছিলেন তেল ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা।
মস্কোর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সুদের হার বৃদ্ধি সত্ত্বেও কর্পোরেট ঋণের গতি কমেনি। এ বছরে সেপ্টেম্বরে রাশিয়ায় ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার’-এর (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) একটি প্রতিনিধি দলের আসার কথা ছিল। কিন্তু, একাধিক পশ্চিমি দেশ এই নিয়ে আপত্তি তোলায় সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে আইএমএফ।
আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, আইএমএফের প্রতিনিধি দল মস্কোয় গেলে এই প্রতিষ্ঠানের থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়ার সুযোগ পেত রাশিয়া। যা আপাতত হাতছাড়া হয়েছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের। পূর্বাভাসে আইএমএফ রাশিয়ার আর্থিক বৃদ্ধির হার ০.২ শতাংশ কমিয়েছে। ফলে ২০২৫ আর্থিক বছরে রাশিয়ার জিডিপি বৃদ্ধির হার ৩.৬ শতাংশের বদলে ১.৩ শতাংশ হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
রাশিয়ার বর্তমান আর্থিক অবস্থাকে ‘অতি উত্তপ্ত’ বলে উল্লেখ করেছে আইএমএফ। এ বছর মস্কোর আর্থিক বৃদ্ধিতে আড়াই শতাংশ মন্থর গতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। যা ৩.৯ শতাংশে পৌঁছবে বলে মনে করা হয়েছিল।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বাজারের অস্থিরতা বন্ধ করতে সুদের হার বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করেছিল রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। কিন্তু ওই বছরের এপ্রিলেই তা ১৭ শতাংশে নেমে আসে। দু’বছরের মাথায় ফের তা বৃদ্ধি করল মস্কো।
ডলারভিত্তিক অর্থনীতিতে লাগাম টানতে ব্রিকস সম্মেলনে ‘ডিজিটাল ব্রিকস মুদ্রা’ আনার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ডিসেম্বরে যা আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু, তার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সুদের হার বৃদ্ধি, পুতিনের ওই পরিকল্পনায় জল ঢালতে পারে বলে সতর্ক করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।