ভারতের শিল্পজগতে নক্ষত্র পতন। ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছে রতন নাভাল টাটার। যাঁর হাত ধরে টাটা গোষ্ঠীর আয় ১০ হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। অথচ দেশের ধনকুবেরদের তালিকার প্রথম দশে ছিল না তাঁর নাম। এ হেন টাটা সাম্রাজ্যের একদা অধীশ্বরের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে আমজনতার উৎসাহের অন্ত নেই। তাঁর মৃত্যুর পর সেই সংক্রান্ত খবর সামনে এসেছে।
চলতি বছরের অগস্টে প্রকাশিত হয় ভারতীয় ধনকুবেরদের তালিকা। ‘হুরুন ইন্ডিয়া রিচ লিস্ট’ নামের ওই তালিকায় ৩৫০তম নম্বর স্থানে ছিলেন রতন টাটা। এই পার্সি শিল্পপতির সম্পত্তির পরিমাণ ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিরিখে অন্য শিল্পপতিদের থেকে রতন টাটার পিছিয়ে থাকার মূল কারণ হল দান। আয়ের একটি বড় অংশই জনহিতকর কাজে বিলিয়ে দিতেন তিনি। এর জন্য ট্রাস্টও তৈরি করেন ভারতীয় ‘শিল্পের জনক’ জামশেদজি টাটার এই উত্তরসূরি।
এ দেশের ধনকুবেরদের তালিকা নির্মাণকারী সমীক্ষকদের দাবি, টাটা গোষ্ঠীর মূল সংস্থা ‘টাটা সন্স’-এর মাত্র ০.৮৩ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন রতন টাটা। এই সংস্থার নিট লাভের অংশীদারি পেতেন তিনি। যা আবার নতুন নতুন শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে সংস্থাটিকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যান রতন টাটা।
২০১৪ সালে অন্তত ২৫টি সংস্থায় বিনিয়োগ করেন টাটা গোষ্ঠীর তৎকালীন চেয়ারম্যান রতন। যার মধ্যে অ্যাপ ক্যাব সংস্থা ‘ওলা’, ডিজিটাল পেমেন্ট কোম্পানি ‘পেটিএম’, আসবাবপত্রর ই-টেলার ‘আরবান ল্যাডার’ ও চশমা প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘লেন্সকার্ট’-এর নাম ছিল। এ ছাড়াও স্বাস্থ্য ও ফিটনেস প্ল্যাটফর্ম ‘কিয়রফিট’-এ লগ্নি করেছিলেন তিনি।
এই সমস্ত লগ্নি ‘আরএনটি অ্যাসোসিয়েটস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর মাধ্যমে করা হয়েছিল। ব্যক্তিগত ভাবে কোনও জায়গায় বিনিয়োগের জন্য এই সংস্থাটি তৈরি করেন রতন টাটা। ভারত ও ভারতের বাইরে যাবতীয় স্টার্ট আপে লগ্নি এর মাধ্যমে করতেন তিনি।
২০২৩ আর্থিক বছরে আরএনটি অ্যাসোসিয়েটসের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এতে রতন টাটার ১০০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। এখানে তাঁর ২৯৬.৯৬ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। যার মধ্যে বিভিন্ন খাতে লগ্নি রয়েছে ১৮৬ কোটি টাকা।
২০২৩ আর্থিক বছরে আরএনটি অ্যাসোসিয়েটসের আয়ের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬.৩৯ কোটি টাকা। ২০২২ আর্থিক বছরে এই সংস্থার আয়ের পরিমাণ ছিল ১৭ কোটি টাকা। ২০২৩ আর্থিক বছরে রতন টাটার নিজস্ব মালিকানাধীন সংস্থাটি লাভ করে ২৭.৭১ কোটি টাকা। যা তার আগের বছরে ১২.৪৭ কোটি টাকা ছিল।
রতন টাটা বাদে আরএনটি অ্যাসোসিয়েটসের বোর্ডের একমাত্র সদস্য হলেন মেহলি মিস্ত্রি। রতন টাটার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন তিনি। সম্পর্কে মেহলি আবার সাইরাস মিস্ত্রির তুতো বোন। প্রয়াত সাইরাস একটা সময়ে টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। ‘স্যর রতন টাটা ট্রাস্ট’, ‘স্যর দোরাবজি টাটা ট্রাস্ট’ এবং ‘টাটা এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট’-এর সদস্যও তাঁকে করা হয়েছিল।
২০১৭ সালে টাটা গোষ্ঠীর অন্তর্বর্তিকালীন চেয়ারম্যানের পদ থেকে অবসর নেন রতন টাটা। সংস্থা ছাড়ার পরও কখনই প্রকৃত অর্থে অবসরে যাননি তিনি। এর পরই আরএনটি অ্যাসোসিয়েটসের মাধ্যমে বিভিন্ন স্টার্ট আপ সংস্থায় লগ্নি করতে শুরু করেন জামশেদজির উত্তরসূরি। ওই স্টার্ট আপগুলিকে কোম্পানিতে পরিণত করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
টাটা গোষ্ঠী ছেড়ে দেওয়ার পর দু’টি সংস্থা তৈরি করেন রতন টাটা। সেগুলি হল, ‘অবন্তী ফিন্যান্স প্রাইভেট লিমিটেড’ ও ‘ইলেক্ট্রোড্রাইভ পাওয়ারট্রেন সলিউশন প্রাইভেট লিমিটেড’। এর মধ্যে প্রথমটি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
২০১৬ সালে নন্দন নীলকান্তির সঙ্গে নন-ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘অবন্তী ফিন্যান্স’ তৈরি করেন রতন টাটা। এতে তাঁর ১১.২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। অন্য দিকে এই সংস্থার ৮৭ শতাংশ শেয়ার নিজের হাতে রেখেছেন নীলকান্তি। অবন্তী ফিন্যান্স জন্ম নেওয়ার সময়ে এর দুই প্রতিষ্ঠাতা ১৬৫ কোটি টাকার লগ্নি করেছিলেন।
১০ কোটি ভারতবাসীর জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে পথচলা শুরু করেছে অবন্তী ফিন্যান্স। ঋণ দেওয়ার জন্য এর নিজস্ব একটি প্রযুক্তি রয়েছে। যাতে ১০০ শতাংশ নগদহীন লেনদেন হয়ে থাকে।
২০১৭ সালে ইলেক্ট্রোড্রাইভ পাওয়ারট্রেন তৈরি করেন রতন টাটা। বৈদ্যুতিন গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি করে এই সংস্থা। শুধু তা-ই নয়, ‘টাটা এসিই’ মডেলের গাড়ির একমাত্র যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী সংস্থা হল ‘ইলেক্ট্রোড্রাইভ’। এ ছাড়া ‘টাটা টিয়াগোর’ মডেলের ২৫-৩০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে এই সংস্থায়।
আর্থিক সমীক্ষক সংস্থা ‘ক্রিসিল’-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ইলেক্টোড্রাইভ পাওয়ারট্রেনের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১৭৮.৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালের নভেম্বরে আমেরিকার সংস্থা ‘জিইএফ ক্যাপিটাল’-এর থেকে ২ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার সংগ্রহ করে এই সংস্থা।
টাটা সন্স থেকে অবসরের পর ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেশ কয়েকটি বিনিয়োগ তহবিল তৈরি করেন রতন টাটা। যার মধ্যে অন্যতম হল, ‘ইউসি-আরএনটি’। ২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে যা তৈরি করেছিলেন তিনি। এই তহবিল থেকে এমএসওয়াইপ টেকনোলজিস ও নেস্ট অ্যাওয়ের মতো সংস্থায় বিনিয়োগ করেছেন রতন টাটা।
২০১৭ সালে ‘স্পিড প্লাস’ নামের সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি তহবিলের অংশ হন রতন টাটা। এই তহবিল থেকেই বিভিন্ন সংস্থায় বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি।
সব ছবি: সংগৃহীত।