মাঠের মাঝে যন্ত্রণায় ছটফট করছিল একটি গোখরো। কোনও কিছু সেটি গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছিল। সাপটিকে দেখতে পেয়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন এক জন ব্যক্তি। লাঠি দিয়ে সাপটির লেজের গোড়ায় চাপ দিতেই দেখা যায় অদ্ভুত দৃশ্য।
সাপটির মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে আর একটি গোখরো। লম্বায় সেটি প্রায় তার শিকারিরই সমান। প্রজাতিও এক। কেউটে বা গোখরো— এই প্রজাতির সাপ সাধারণত অন্যান্য ছোট সাপকে আক্রমণ করে। কিন্তু নিজের প্রজাতিকেই গিলে খাওয়ার এমন ঘটনা সত্যিই বিরল। তবে বিরল হলেও এই ঘটনা অসম্ভব নয়।
স্বজাতির মাংস খাওয়াকে সাধারণত ‘ক্যানিবলিজ়ম’ বলা হয়। বৈচিত্রময় এই পৃথিবীতে এমন কিছু প্রাণী রয়েছে, যারা নিজের প্রজাতিকেই খেয়ে ফেলে। টিকে থাকার লড়াইয়ে নিজের গোষ্ঠীর সদস্যদেরও শেষ করে দিতে ছাড়ে না তারা। যেমন একই প্রজাতির পুরুষ ব্যাঙকে ধরে খায় স্ত্রী ব্যাঙ। বেল প্রজাতির সবুজ এবং সোনালি রঙের ব্যাঙ, যারা মিলনের পর নিজের সঙ্গীকেই খেয়ে ফেলে।
মনুষ্যজগতেও ছিল মানুষের মাংস খাওয়ার চল। কয়েক বছর আগেই পাপুয়া নিউগিনিতে মিলেছিল এমন এক নরগোষ্ঠীর খোঁজ, যাদের মধ্যে ‘ক্যানিবলিজ়ম’ প্রথা চালু ছিল। নিজের প্রজাতির মধ্যে খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক বজায় ছিল বিংশ শতকেও।
সাপদের মধ্যেও এমন প্রজাতি রয়েছে, যারা নিজের প্রজাতিকে গিলে নিতে কসুর করে না। ছোটখাটো সাপ তো বটেই, নিজের জাতভাইদেরও আক্রমণ করে এরা। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে ‘ওফিয়োফ্যাগি’ বলা হয়ে থাকে।
সবচেয়ে পরিচিত ওফিয়োফ্যাগাস সাপগুলির মধ্যে রয়েছে কিং কোবরা (ওফিয়োফ্যাগাস হ্যানা) বা শঙ্খচূড়। ওফিওফ্যাগাসের অর্থই ‘সাপ ভক্ষণকারী’। ভয়ঙ্কর সেই সাপের একটিই প্রজাতির কথা এত দিন জানা যেত। এদের দেহের রং সবুজ, বাদামি অথবা কালো এবং মাথার পিছনের অংশে একটি বিশেষ চিহ্ন থাকে।
ওফিয়োফ্যাগাস হ্যানার দেখা পাওয়া যায় উত্তর ভারত, পূর্ব পাকিস্তান, চিন এবং তাইল্যান্ডে। এদের শরীরে ৫-৭০টি গোল দাগ দেখতে পাওয়া যায়। ওফিয়োফ্যাগাস বাঙ্গারাসের শরীরে ৭০টির বেশি দাগ রয়েছে। শঙ্খচূড়ের আর এক প্রজাতি ওফিয়োফ্যাগাস সালভাটানার শরীরে কোন দাগ নেই। মূলত দক্ষিণ ফিলিপিন্সে দেখতে পাওয়া যায় এই সাপকে।
শঙ্খচূড়ই হল বিশ্বের দীর্ঘতম বিষধর সাপ। এই সাপকে বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান সাপ বলেও ধরা হয়ে থাকে। শিকার কেমন, তা দেখে এরা শিকারের কৌশল পাল্টে ফেলে। এদের প্রিয় খাদ্যই হল গোখরো, ছোট অজগর, দাঁড়াশ। সেই খাবারের অভাব দেখা দিলে এরা পাখি, টিকটিকি কিংবা মেঠো ইঁদুরও খায়।
কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়ের পর এই তালিকার আর একটি নাম কিং স্নেক। এদের মূলত উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। এই সাপও শঙ্খচূড়ের মতো অন্য সাপ খেয়ে নিজেদের পেট ভরায়৷
এদের একাধিক প্রজাতি এবং উপ-প্রজাতি পাওয়া যায়। র্যাটলস্নেক, কটনমাউথ এবং কপারহেডের মতো বিষাক্ত প্রজাতির সাপ খেতে এরা পছন্দ করে। এই সাপের বিষ তাদের শরীরে বিশেষ প্রভাব ফেলে না, তাই এরা ইচ্ছামতো শিকার বেছে নিতে পারে।
এরা শিকারকে এমন ভাবে পেঁচিয়ে ঘায়েল করে যে, তারা নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে। নিজেদের দেহের মজুবত মাংসপেশি দিয়ে শিকারকে কব্জা করে এরা। শিকারের চোয়ালে কামড় বসিয়ে লড়াই করার ক্ষমতা শেষ করে দেয় কিং স্নক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় শিকার।
ফণার পিছনে গরুর ক্ষুরের মতো দাগ থাকে, যার থেকে এদের ‘গোক্ষুর’ নামটি এসেছে। চলতি কথায় এদের গোখরো বলা হয়। প্রধানত ভারত, দক্ষিণ চিন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে পাওয়া যায় এই ভয়ঙ্কর বিষধর সাপটিকে।
পূর্ণবয়স্ক গোখরো দৈর্ঘ্যে ৪- ৫ ফুট পর্যন্ত বড় হতে পারে। গোখরো বিশ্বের অন্যতম বিষাক্ত সাপ। এর মারাত্মক বিষ শিকারকে সহজেই কাবু করতে পারে। এর বিষে নিউরোটক্সিন থাকে। গোখরোর কামড়ে হৃৎস্পন্দন থেমে যেতে পারে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুও হতে পারে।
ভারতে পাওয়া যায় এমন আর একটি সাপ যা অন্য সাপকে খায়, তা হল ব্যান্ডেড ক্রেট । বাংলায় ক্রেট গোত্রীয় যে যে সাপের দেখা মেলে তা হল কালাচ বা কমন ক্রেট, ব্যান্ডেড ক্রেট বা শাঁখামুটি। এর মধ্যে শাঁখামুটি বাগে পেলে অন্য সাপকে খেয়ে ফেলে।
শাঁখামুটি খুবই ভয়ঙ্কর। সাধারণত শাঁখামুটি লাজুক স্বভাবের। সহজে এরা মানুষকে আক্রমণ করে না। এর বিষে শক্তিশালী নিউরোটক্সিন থাকে, যা সরাসরি স্নায়ুতন্ত্রকে বিকল করে দেয়।
এই দলে আরও এক জন রয়েছে, নাম রক পাইথন। দৈর্ঘ্যে এই সাপ ২০ ফুটেরও বেশি। কখনও শিকারের অভাবে এই সাপ আকারে ছোট সাপকে খেয়ে ফেলে। মূলত বিশাল আকারের কারণেই এই সাপ বাকি সবাইকে পরাজিত করতে পারে।
তবে সাপেরা যে অন্য প্রজাতির সাপকে শুধুই উদরপূর্তির জন্য খেয়ে ফেলে, ব্যাপারটা সব সময় তেমন নয়৷ এর আরও একটা কারণ প্রতিযোগিতা কমানো। খাদ্যের অভাব বা শিকারের অভাব যাতে না ঘটে, তার জন্য আগেভাগেই খাবারে ভাগ বসানোর প্রতিদ্বন্দ্বীকেই নিকেশ করে ফেলা।
সাপের একে অপরকে খাদ্য হিসাবে বেছে নেওয়ার নজির মেলে পুরাণ এবং প্রাচীন মানব সভ্যতার ইতিহাসেও। ওরোবোরোস, যা একটি প্রাচীন প্রতীক বলে ধরা হয়। সেখানে দেখা গিয়েছে একটি সাপ তার নিজের লেজ গিলে নিচ্ছে। এই প্রতীক জীবন, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের চক্রের প্রতিনিধিত্ব করে।
সব ছবি: সংগৃহীত।