অর্চনা নাগ। এই নামটি শোরগোল ফেলে দিয়েছে গোটা ওড়িশায়। রাজ্য রাজনীতিও বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে। কে এই অর্চনা? কেনই বা তাঁকে নিয়ে গোটা ওড়িশায় ডামাডোল চলছে? কী ভাবে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এক মহিলা হয়ে উঠলেন কোটি কোটি টাকার মালিক? অর্চনার কাহিনি যে কোনও বলিউডি ছবিকেও হার মানাবে।
খুবই দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছেন অর্চনা। কালাহান্ডিতে স্কুলজীবন শেষের পর ভুবনেশ্বরে আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে চলে আসেন বলে পুলিশ সূত্রে খবর। আর এখান থেকেই তাঁর জীবন অন্য খাতে বইতে শুরু করে। কালাহান্ডির একটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা অর্চনা অল্প সময়ে বেশি টাকা উপার্জনের রাস্তা খুঁজতে শুরু করেন।
কালাহান্ডির নাম শুনলেই দুর্ভিক্ষ, অনাহার এই ছবিটাই ভেসে ওঠে। ওড়িশার এই জেলারই লানজিগড়ে জন্ম অর্চনার। তবে বড় হয়েছেন ওই জেলারই কেসিঙ্গাতে। এখানেই তাঁর মা কাজ করতেন। যদিও ২০১৫ সালে ভুবনেশ্বরে চলে আসেন অর্চনা।
একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থায় কাজ শুরু করেন অর্চনা। কিছু দিন কাজ করার পর বিউটি পার্লারের কাজে যোগ দেন তিনি। এখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় বালেশ্বরের বাসিন্দা জগবন্ধু চাঁদের। ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৮ সালে তাঁরা বিয়ে করেন।
পুলিশ সূত্রে খবর, অতিরিক্ত টাকা উপার্জন, ধনী হওয়ার নেশা আরও চেপে ধরেছিল অর্চনাকে। পার্লারের আড়ালে শুরু করেন মধুচক্র। আর তার পর থেকেই তাঁর ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে।
পুরনো গাড়ির একটি শোরুম চালাতেন অর্চনার স্বামী জগবন্ধু। আর সেই সুবাদেই বড় বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, প্রোমোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। আর এটাকেই টাকা উপার্জনের একটা রাস্তা হিসাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেন অর্চনা।
পুলিশ সূত্রে খবর, ধনী এবং প্রভাবশালীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেন অর্চনা। তার পর তাঁদের কখনও নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে মহিলাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ করে দিতেন। শুধু তাই নয়, ওই ব্যক্তিদের চাহিদা মতো মহিলাও সরবরাহ করতেন।
শুধু মহিলা সরবরাহ করাই নয়, নিজেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে মোবাইলে ঘনিষ্ঠ কথাবার্তা, বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে তাঁদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতেন বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
আর সেই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি এবং ভিডিয়ো করতেন তাঁর স্বামী জগবন্ধু। তার পর সেই ছবি এবং ভিডিয়ো দেখিয়ে প্রভাবশালীদের ব্ল্যাকমেল করে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন।
ওড়িশার এক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, অর্চনার মধুচক্রের শিকার হয়েছেন ১৮ জন বিধায়ক। রয়েছেন দু’জন মন্ত্রীও। রাজ্য বিজেপির ভুবনেশ্বর শাখার সভাপতি বাবু সিংহও অভিযোগ করেছেন, অর্চনার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ২৫ জন রাজনীতিকের। তাঁদের মধ্যে ১৮ জন বিধায়ক এবং কয়েক জন মন্ত্রীও রয়েছেন। সেই তালিকার বেশির ভাগই আবার বিজেডির বিধায়ক।
পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, ওড়িশার ৫০ জন খ্যাতনামী ব্যক্তির একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন অর্চনা। তাঁদের মধুচক্রের শিকার বানিয়ে ব্ল্যাকমেল করে টাকা হাতানোর পরিকল্পনা ছিল তাঁর।
শুধু তাই নয়, খুব সম্প্রতিই এই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তাঁর শিকার বানানোর ছক কষেছিলেন অর্চনা। নিজেকে আইনজীবী বলে পরিচয় দিতেন। আর সেই সূত্র ধরেই লোকজনকে হুমকি দিতেন।
সময় যত গড়িয়েছে, অর্চনার জীবনযাপনের ধারাও বদলেছে। বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছেন। ভুবনেশ্বরে ৩ কোটি টাকার প্রাসাদোপম বাংলো, নাখারার কাছে একটি সুবিশাল ফার্মহাউস রয়েছে তাঁর।
শুধু বিলাসবহুল বাড়িই নয়, গাড়ির একটি শোরুম আছে অর্চনার। কয়েক লক্ষ টাকার দামি দামি বিলাসবহুল বেশ কয়েকটি গাড়ি, বেশ কয়েকটি এসইউভিও আছে অর্চনার। পুলিশ জানিয়েছে, বেছে বেছে বিত্তশালী লোকেদেরই তাঁর শিকার বানাতেন অর্চনা। তার মধ্যে কয়েক জন চলচ্চিত্র নির্মাতাও রয়েছেন।
সম্প্রতি ওড়িশার এক চলচ্চিত্র প্রযোজক অর্চনার বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেলের অভিযোগ দায়ের করেন। এক মহিলাকে ডেকে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি তুলে প্রযোজককে ব্ল্যাকমেল করতেন বলে অভিযোগ।
নিজেকে আইনজীবী পরিচয় দিয়ে প্রযোজকের কাছ থেকে ৩ কোটি টাকা আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন। অভিযোগ, সেই টাকা না দিলে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি ফাঁস করে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দিয়েছিলেন অর্চনা। তার পরেই প্রযোজক পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন।
সেই অভিযোগ পেয়েই তদন্তে নামে পুলিশ। তদন্তে নেমে অর্চনার নেওয়ার্কের যে হদিস পেয়েছে তারা, তা দেখে তদন্তকারী আধিকারিকরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন। গত ৬ অক্টোবর অর্চনাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সূত্রের খবর, পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পেরেছে, অর্চনা মোট ৩৫ কোটি টাকার সম্পত্তি করেছিলেন ওই মধুচক্র এবং ব্ল্যাকমেলের মাধ্যমে।