সীমান্তের রাস্তা এবং রেললাইনের ধার ঘেঁষে কাটা হয়েছে অন্তত দু’টি পরিখা। যেখানে লুকিয়ে থেকে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে সেনা। সেই ছবি প্রকাশ্যে আসতেই গোটা উপদ্বীপ জুড়ে ছড়িয়েছে আতঙ্ক। পাশাপাশি, ফিরে এসেছে বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিও।
সম্প্রতি কোরীয় উপদ্বীপের সীমান্তবর্তী এলাকার একটি উপগ্রহচিত্র প্রকাশ্যে আসে। সেখানে দেখা গিয়েছে সীমান্তের রাস্তা এবং রেললাইনের ধার ঘেঁষে অন্তত দু’টি পরিখা কেটেছে উত্তর কোরিয়ার ফৌজ। যা সম্ভাব্য আক্রমণের প্রস্তুতি কি না, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
সীমান্তে পরিখা কাটার কারণ নিয়ে সরকারি ভাবে কিছুই জানায়নি পিয়ংইয়ং। ফলে এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়। এর মধ্যে একটি পরিখা ১৫০ মিটারের (৪৯২ ফুট) সামান্য বেশি লম্বা বলে অনুমান করা হচ্ছে। এটি পূর্ব দিকে বিস্তৃত। এর এক দিকে সামান্য কিছু জমি ছেড়ে রাখা হয়েছে।
চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর কোরীয় সীমান্তের ওই পরিখার ছবি ফ্রেমবন্দি করে আমেরিকার একটি বেসরকারি সংস্থার উপগ্রহ। যা বিশ্লেষণ করে সংস্থাটির দাবি, সীমান্তের পশ্চিম দিকে অসামরিক এলাকাতেও ওই পরিখা কাটা হয়েছে। যার পাশ দিয়ে রাস্তা এবং রেললাইন চলে গিয়েছে।
বর্তমানে দুই কোরিয়ার মধ্যে সংঘাত চরম পর্যায়ে রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম নেতা কিম জং উন তাঁর পরমাণু হাতিয়ার এবং তা বহণকারী ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করেই চলেছেন। যা নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া এবং আমেরিকার।
এ ব্যাপারে ওয়াশিংটন যে কিমের উপর চাপ তৈরি করেনি এমনটা নয়। কিন্তু তাতে ভয় পাওয়া বা পিছিয়ে আসা তো দূরে থাক, উল্টে আমেরিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একের পর এক পরমাণু এবং দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন উত্তর কোরিয়ার এই কমিউনিস্ট শাসক।
শুধু তাই নয়, দক্ষিণ কোরিয়াকে ‘চিরশত্রু’ তকমা দিতেও ছাড়েননি কিম। ফলে সিওলের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করার কোনও প্রশ্নই যে নেই, তা-ও স্পষ্ট করেছেন তিনি। ফলে রাশিয়াপ্রেমী পিয়ংইয়ংয়ের সুপ্রিম নেতা পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।
গত ১৫ অক্টোবর পশ্চিমের সীমান্তবর্তী কাইসং এলাকার একাধিক রাস্তা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয় কিমের ফৌজ। এর পর পূর্ব সীমান্তের একটি রাস্তা এবং রেলপথ একই ভাবে ধ্বংস করে তাঁরা। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের অনুমান, রাস্তা এবং রেলপথ ওড়ানোর পরই জোড়া পরিখা কেটেছে উত্তর কোরিয়ার সেনা।
আমেরিকার সংস্থা উপগ্রহচিত্র পরীক্ষা করে দেখেছে সংবাদ সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’। তাদের দাবি, ১৭ অক্টোবর প্রথম বার কোরীয় সীমান্তে পরিখা কাটার বিষয়টি জানা যায়। ওই দিনে মেঘ সরে যাওয়ায় স্পষ্ট উপগ্রহচিত্র পাওয়া গিয়েছিল।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিম দিকের পরিখাটি ডোরাসান রেলস্টেশন থেকে ১.৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। উল্লেখ্য, ডোরাসান দক্ষিণ কোরিয়ার দিকের শেষ রেলস্টেশন। একটা সময়ে এখানকার রেললাইন কায়েসং এলাকার একটি কারখানার ভিতর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমানে যা বন্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
দুই কোরিয়ার মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকাকালীন কায়েসং এলাকার কারখানাগুলি দুই দেশ যৌথ ভাবে পরিচালনা করত। কিন্তু, ২০১৬ সালে পিয়ংইয়ং পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা করার পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে। এর পরই সিওল ওই এলাকার সমস্ত কারখানা বন্ধ করে দেয়।
উপগ্রহচিত্রে পরিখার আশপাশে বেশ কয়েকটি যানবাহন ও মাটি কাটার যন্ত্র দেখা গিয়েছে। পরিখা কাটার জন্যেই সেগুলিকে আনা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। একই ধরনের পরিখা কোরীয় উপদ্বীপের পূর্ব দিকের উপকূলে কাটা হয়েছে। সেখানকার সীমান্তবর্তী রাস্তা কেটে পরিখা তৈরি করেছে কিমের ফৌজ। যা আদপে অসামরিক এলাকা।
বিশ্লেষকদের একাংশের আবার দাবি, পশ্চিম দিকের পরিখাটি ১২৫ মিটার (৪১০ ফুট) লম্বা এবং সাত মিটার (২৩ ফুট) চওড়া। এর দু’দিকে ময়লার বিশাল স্তূপ রয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ‘‘এটা দেখে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে ওই পরিখাগুলি কাটা হয়েছে।’’
তবে এর অন্য মতও রয়েছে। কিছু বিশ্লেষক আবার বলেছেন, ‘‘পরিখার পাশের ডাঁই করে রাখা স্তূপকে ময়লার বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। ওই এলাকার কিম ফৌজের বাঙ্কার বা অন্যান্য সামরিক কাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা থাকতে পারে। যার জন্য সামনে ময়লার স্তূপ রাখা হয়েছে।’’
গত ৩১ অক্টোবর আমেরিকার চোখরাঙানিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেন কিম। এ বছর প্রথম বারের জন্য এই পরীক্ষা চালিয়েছে উত্তর কোরিয়া। পিয়ংইয়ংয়ের এই পদক্ষেপকে আমেরিকার মূল ভূখণ্ডের জন্য ‘বড় হুমকি’ বলেই মনে করছে ওয়াশিংটন।
এই পরিস্থিতিতে কিম দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করলে আমেরিকা যে চুপ করে বসে থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য। আর সেটা আঁচ করেই মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে পিয়ংইয়ং। বন্ধুত্বের প্রমাণ হিসাবে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সৈনিক দিয়ে কিম সাহায্য করছেন বলেও জানা গিয়েছে।
এ দিকে আবার দক্ষিণ কোরিয়া দাবি করেছে, সৈনিকের বদলে পিয়ংইয়ংয়ের হাতে উন্নত মানের পরমাণু হাতিয়ার তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে রাশিয়া। যা পেয়ে গেলে আরও ভয়ঙ্কর ক্ষেপণাস্ত্র অনায়াসেই বানিয়ে ফেলবেন কিম। ফলে এই উপদ্বীপে যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সিওল।
বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া সফরে যান তিনি। সেখানে অস্টিন বলেন, সর্বশক্তি দিয়ে সিওলকে রক্ষা করতে ওয়াশিংটন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর জন্য প্রয়োজনে পরমাণু হাতিয়ার ব্যবহার করতেও পিছপা হবে না তারা।
গত জুনে ২৪ বছর পর উত্তর কোরিয়া সফর করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পিয়ংইয়ংয়ে পৌঁছে সুপ্রিম নেতা তথা কমিউনিস্ট কিমের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করেন তিনি। মস্কো জানিয়েছে, সেই চুক্তি মেনেই সৈনিক পাঠিয়েছে উত্তর কোরিয়া। সূত্রের খবর, বিনিময়ে পরমাণু অস্ত্রের প্রযুক্তি কিমকে দিচ্ছেন পুতিন। যা কোরীয় উপদ্বীপকে রক্তাক্ত করতে পারে।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে উন্নত রণকৌশল হিসেবে পরিখার সর্বাধিক ব্যবহার দেখা গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে যুদ্ধকৌশল পাল্টে যাওয়ায় এর ব্যবহার কমে আসে। শত্রুকে ছত্রভঙ্গ করার বহু পুরনো সেই পদ্ধতি নতুন আঙ্গিকে কাজে লাগাতে চাইছে কিমের ফৌজ? এই নিয়েই তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
সব ছবি: সংগৃহীত।