‘প্রিয় বন্ধু’ ফ্রান্সের উপর বেজায় খাপ্পা ইজ়রায়েল। রাগে অন্ধ হয়ে লেবাননে কর্মরত ফরাসি সংস্থা ‘টোটাল এনার্জি’-র গ্যাস স্টেশন বিমান হামলায় উড়িয়ে দিয়েছে ইহুদি ফৌজ। ভূমধ্যসাগরের তীরের পশ্চিম এশিয়ার দেশটিকে কেন্দ্র করে দুই ‘বন্ধুর’ লড়াই কি এ বার প্রত্যক্ষ করবে গোটা বিশ্ব? ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) ওই আক্রমণের পর এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
ইরান সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে গাজ়া স্ট্রিপে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইহুদি বাহিনী। গত এক বছর ধরে ওই এলাকায় রীতিমতো ‘কার্পেট বম্বিং’ চালিয়েছে আইডিএফের বিমানবাহিনী। আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি স্কুল ও হাসপাতালও।
ইজ়রায়েলের এই আক্রমণ নিয়ে বিশ্ব জুড়ে ওঠে নিন্দার ঝড়। যদিও তাতে এতটুকু আমল না দিয়ে গাজ়ায় গ্রাউন্ড অপারেশন চালাচ্ছে ইহুদি সেনা। প্যালেস্টাইনি এই ভূখণ্ডের প্রায় ৭৫ শতাংশ আইডিএফ দখল করে ফেলেছে বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে।
গাজ়া যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই হামাসকে সমর্থন করে যাচ্ছে ইরান সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী হিজ়বুল্লা। ইজ়রায়েলের প্রতিবেশী দেশ লেবানন জুড়ে রয়েছে যাঁদের অসংখ্য গুপ্ত ঘাঁটি। সেখান থেকে ইহুদি ভূমিতে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে এই শিয়া সন্ত্রাসবাদী সংগঠন।
হিজ়বুল্লার ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশই এত দিন ‘বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ব্যবহার করে আকাশেই ধ্বংস করেছে আইডিএফ। এ ব্যাপারে দুর্দান্ত কাজ করেছে ইহুদি সেনার হাতে থাকা আয়রন ডোম, ডেভিড’স স্লিং ও অ্যারো। গাজ়ায় হামাসের কোমর ভাঙার পর বর্তমানে হিজ়বুল্লাকে উপড়ে ফেলতে লেবাননের দিকে নজর দিয়েছে ইজ়রায়েল।
এ বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে দক্ষিণ লেবাননে আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াতে শুরু করে ইহুদি বায়ুসেনা। রাজধানী বেরুটের একাংশ বিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় আইডিএফ। বর্তমানে সেখানেও গ্রাউন্ড অপারেশন শুরু করেছেন তাঁরা।
ইজ়রায়েলি আক্রমণে গাজ়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে যখন আমেরিকা সোচ্চার হয়েছে, তখনও সে ভাবে ইহুদিদের বিরুদ্ধে কথা বলেনি ফ্রান্স। কিন্তু লেবাননে আইডিএফের আক্রমণ শুরু হতেই ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে সুর চড়াতে শুরু করে প্যারিস। যা নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ইজ়রায়েল প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
গাজ়া ও লেবাননে ফরাসিদের এই দ্বিমুখী নীতির কারণ কী? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভূমধ্যসাগরের তীরের দেশটিতে প্যারিসের আর্থিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ লুকিয়ে রয়েছে। যা কোনও ভাবেই হাতছাড়া করতে রাজি নন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাকরঁ।
বস্তুত, বিশ শতকের প্রথম পর্বে লেবানন বলে কোনও দেশের অস্তিত্বই ছিল না। এই এলাকা ছিল সিরিয়ার অন্তর্গত। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে পশ্চিম এশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড চলে আসে ফ্রান্সের দখলে। যার মধ্যে ছিল আজকের সিরিয়া ও লেবানন।
এর পরেই সিরিয়ার পশ্চিম অংশের খ্রিস্টানবহুল এলাকা নিয়ে আলাদা একটি দেশ তৈরি করে তৎকালীন ফরাসি সরকার। যার শাসন ব্যবস্থা এক রকম নিয়ন্ত্রিত হত প্যারিস থেকেই। জায়গাটি ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী হওয়ায় লেবানন হয়ে ওঠে ফ্রান্সের সমুদ্র বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। এখান থেকেই পশ্চিম এশিয়ার অন্য দেশগুলিতে মালপত্র আনা-নেওয়া করে প্যারিস।
১৯১৮ সালে লেবানন তৈরির সময়ে সেখানকার বাসিন্দাদের ৫০ শতাংশ ছিলেন খ্রিস্টান। বাকি ২৫ শতাংশ করে শিয়া ও সুন্নি মুসলিমরা থাকতেন সেখানে। কিন্তু বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। লেবাননের ঠিক নীচে প্যালেস্তাইন কেটে জন্ম নেয় ইহুদি দেশ ইজ়রায়েল। ফলে সেখানকার মুসলিম বাসিন্দারা দলে দলে লেবাননে আসতে শুরু করেন।
প্যালেস্তাইনি উদ্বাস্তুদের স্রোত লেবাননের জনসংখ্যায় একটা বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বর্তমানে ভূমধ্যসাগরের কোলের দেশটিতে খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু। অন্য দিকে শিয়া ও সুন্নিদের সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও লেবাননের উপর ফরাসি প্রভাব এতটুকু কমেনি।
লেবাননের দ্বিতীয় প্রধান ভাষা হল ফরাসি। সেখানকার ৭০ শতাংশ স্কুলে তা পড়ানো হয়। ফি বছর বিপুল সংখ্যায় ফ্রান্সবাসী পশ্চিম এশিয়ার এই দেশে বেড়াতে যান। এর জন্য লেবানন জুড়ে একাধিক দূতাবাস খুলেছে প্যারিসের সরকার।
বিশেষজ্ঞদের অবশ্য দাবি, লেবানন নিয়ে ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় চিন্তার জায়গা হল সেখানে তাঁদের বিনিয়োগ। সূত্রের খবর, ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৩০০ কোটি ইউরো লগ্নি করেছে প্যারিস। এখান থেকে খনিজ তেল ও গ্যাস উত্তোলন করে একাধিক ফরাসি সংস্থা।
১৯৫১ সালে লেবাননে পা রাখে ফরাসি সংস্থা টোটাল এনার্জি। পরবর্তী সময়ে ভূমধ্যসাগর থেকে তেল উত্তোলনের কাজ শুরু করে এই সংস্থা। ওই এলাকাকে কেন্দ্র করে বেরুট ও তেল আভিভের মধ্যে বিবাদ রয়েছে। ফলে বছর দুই আগে ইহুদিদের সঙ্গে সমঝোতা করে টোটাল এনার্জি।
সেই সমঝোতা অনুযায়ী ফরাসি সংস্থার ভূমধ্যসাগর থেকে খনিজ তেল উত্তোলন মেনে নিয়েছিল ইজ়রায়েল। কিন্তু দু’বছরের মাথাতেই তাঁদের গ্যাস স্টেশন উড়িয়ে দিল আইডিএফ। লেবাননে টোটাল এনার্জির কর্মী সংখ্যা শতাধিক। ইহুদি ফৌজের হামলায় অবশ্য কারও জীবনহানির খবর আসেনি।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, ফ্রান্সের উপর ইজ়রায়েলের এই রাগের নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জে ২১ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন প্রেসিডেন্ট মাকরঁ। যা মানতে পারেননি ইহুদিরা। নেতানিয়াহু সরকারের যুক্তি ছিল, এতে প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাবে হিজ়বুল্লা। আর তাই বেরুটে আক্রমণের ঝাঁজ কমায়নি আইডিএফ।
সূত্রের খবর, লেবানন থেকে লগ্নির সিংহভাগ সরিয়ে নিতে ওই যুদ্ধবিরতি চেয়েছিল ফ্রান্স। কিন্তু ইজ়রায়েল তা মানতে অস্বীকার করায় পাল্টা প্রত্যাঘাতের রাস্তায় যান প্রেসিডেন্ট মাকরঁ। ইহুদি দেশে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার কথা ঘোষণা করেন তিনি।
মুখে অবশ্য অন্য কথা বলেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। ফ্রান্সের একটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘লেবাননকে কোনও ভাবেই গাজ়া হতে দিতে পারি না। আর তাই দু’টি দেশের রাজনৈতিক সমঝোতায় ফেরা উচিত বলেই মনে করি।’’
ফ্রান্সের এই পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করে ৫ অক্টোবর এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। সেখানে সরাসরি নাম করে মাকরেঁর বিরুদ্ধে তোপ দাগেন তিনি। বলেন, ‘‘ফরাসি প্রেসিডেন্ট ও পশ্চিমি দেশের যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতা ইজ়রায়েলের বিপক্ষে কথা বলছেন, তাঁদের লজ্জা পাওয়া উচিত। হামাস ও হিজ়বুল্লাকে লাগাতার হাতিয়ার সরবরাহ করে যাচ্ছে ইরান। ‘শয়তানের অক্ষ’কে এই কাজে আপনারা বাধা দিতে পারছেন না। এটাই সবচেয়ে লজ্জার।’’
ইজ়রায়েলের মূল হাতিয়ার সরবরাহকারী দেশের তালিকায় অবশ্য অনেক নীচে রয়েছে ফ্রান্সের নাম। ফলে প্যারিস হাতিয়ার সরবরাহ বন্ধ করলেও হামাস-হিজ়বুল্লাকে নিকেশ করার রাস্তা থেকে সরে আসছে না ইহুদি ফৌজ। ‘‘কেউ আমাদের অস্ত্র দিক বা না দিক, এই যুদ্ধ আমরা জিতবই। তখন সারা দুনিয়া আপনাদের দেখে লজ্জায় মাথা নত করবে’’— সমাজমাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিয়োয় বলেছেন নেতানিয়াহু।
এই ঘটনার পর ইজ়রায়েলের মানভঞ্জনে সুর বদলেছে প্যারিস। ৭ অক্টোবর ইহুদি ভূমিতে যান ফরাসি বিদেশমন্ত্রী জ়িন-নোয়েল ব্যারট। ইজ়রায়েলি বিদেশমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ়ের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন তিনি। তেল আভিভকে সবচেয়ে ভাল বন্ধু বলে বিবৃতিও দিয়েছে মাকরঁ সরকার। এ বার অস্ত্র সরবরাহের নিষেধাজ্ঞা প্যারিস প্রত্যাহার করে কি না সেটাই দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।