
মাটির গভীরে আস্ত একটা শহর! সে শহরের বুক চিরে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বহু দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে একটা রাস্তা। সুড়ঙ্গপথের দু’পাশে থরে থরে সাজানো ভয়ঙ্কর সব ক্ষেপণাস্ত্র! ভূগর্ভস্থ এই ‘অস্ত্র নগর’-এর ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসতেই পশ্চিম এশিয়ায় ছড়িয়েছে যুদ্ধের আতঙ্ক। শুধু তা-ই নয়, পারস্য উপসাগরের জল রক্তে লাল হওয়ায় আশঙ্কায় প্রমাদ গুনছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।

পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ফের এক বার সম্মুখসমরে ইরান ও আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভূগর্ভস্থ তৃতীয় ‘ক্ষেপণাস্ত্র শহর’-এর ভিডিয়ো প্রকাশ করল তেহরান। শিয়া মুলুকটির ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির অস্ত্রভান্ডার দেখে শিউরে উঠেছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।

চলতি বছরের মার্চে ইরানি ‘ক্ষেপণাস্ত্র শহর’-এর ৮৫ সেকেন্ডের ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হতেই দুনিয়া জুড়ে হইচই পড়ে যায়। ভিডিয়োয় একটি হুডখোলা জিপে আইআরজিসির দুই শীর্ষ অফিসারকে হাতিয়ার পরিদর্শন করতে দেখা গিয়েছে। তাঁরা হলেন, স্থলসেনার মেজর জেনারেল মহম্মদ হুসেন বাঘেরি এবং এরোস্পেস ফোর্সের প্রধান আমির আলি হাজিজ়াদেহ।

ভিডিয়োয় ইরানি সেনার হাতে থাকা অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে দেখা গিয়েছে। সেই তালিকায় আছে, খেইবার-শেকান, গাদর-এইচ, সেজিল এবং পাভেহ ল্যান্ড অ্যাটাক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র। গত দেড় বছর ধরে ইহুদিদের ধ্বংস করতে মূলত এই মারণাস্ত্রগুলি দিয়ে ইজ়রায়েলকে নিশানা করে চলেছে আইআরজিসি।

২০২০ সালের নভেম্বরে প্রথম বার একটি ভূগর্ভস্থ ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সুড়ঙ্গের ছবি প্রকাশ করে ইরান। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কথায়, ওই সময়েই তেহরানের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছিল। ক্ষেপণাস্ত্র পরিবহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সুড়ঙ্গটিতে পাতা হয় রেললাইন। এ ছাড়া সেখানে উৎক্ষেপণের লঞ্চারও রেখেছে শিয়া ফৌজ।

প্রথম সুড়ঙ্গের ছবি প্রকাশের তিন বছরের মাথায়, ২০২৩ সালে দ্বিতীয় ‘ক্ষেপণাস্ত্র-শহর’-এর কথা গোটা দুনিয়াকে সগর্বে জানায় আইআরজিসি। সেখানে ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি যুদ্ধবিমান রাখার আলাদা জায়গা রয়েছে। ভূগর্ভস্থ এলাকাটিকে কৌশলগত দুর্গ হিসাবে শিয়া সেনা ব্যবহার করছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে।

এ বছরের মার্চের গোড়ায় পরমাণু চুক্তি গ্রহণ করতে ইরানকে হুঁশিয়ারি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দু’মাসের মধ্যে তাতে সই করতে তেহরানের উপর মারাত্মক চাপ তৈরি করেছেন তিনি। এক বার এই চুক্তি হয়ে গেলে আণবিক বোমা তৈরি, ইউরেনিয়ামের প্রক্রিয়াকরণ বা দূরপাল্লার অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে পারবে না পারস্য উপসাগরের কোলের শিয়া মুলুক।

কিন্তু ট্রাম্পের এই দাবি পত্রপাঠ খারিজ করে দেয় তেহরান। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুব্ধ ওয়াশিংটনের থেকে আসে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং প্রয়োজনে সামরিক পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি। এই আবহে আইআরজিসির ‘ক্ষেপণাস্ত্র শহর’-এর ভিডিয়ো প্রকাশকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। এর মাধ্যমে শিয়া ফৌজ পাল্টা যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিয়েছে বলেই মনে করছেন তাঁরা।

‘ক্ষেপণাস্ত্র শহর’-এর ভিডিয়ো প্রকাশের পাশাপাশি পারস্য উপসাগরে শক্তি প্রদর্শন করেছে ইরান। মহড়ার নামে সেখানে দাপিয়ে বেড়িয়েছে আইআরজিসির নৌসেনা। শিয়া রণতরীগুলিতে প্যালেস্টাইনের পতাকা দেখা গিয়েছে। যুদ্ধের মোড় ঘোরানোর মতো বড় একটি ড্রোন ফৌজও রয়েছে তেহরানের হাতে।

অন্য দিকে পিছিয়ে নেই আমেরিকাও। ভারতীয় মহাসাগরীয় এলাকার দ্বীপরাষ্ট্র দিয়েগো গার্সিয়ার সেনাঘাঁটিকে মজবুত করেছে ওয়াশিংটন। সেখানে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনা। পাশাপাশি, পরমাণু হামলায় সক্ষম ‘বি-২ স্পিরিট’ স্টেলথ বোমারু বিমানের বহর নামানো হয়েছে সেখানে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের সঙ্গে আসন্ন যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে দিয়েগো গার্সিয়াকে প্রস্তুত করছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সদর দফতর পেন্টাগন। লড়াই শুরু হলে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটিই হবে আমেরিকার মূল সেনাঘাঁটি। সংঘাতের কথা মাথায় রেখে লোহিত সাগরে টহলরত দু’টি বিমানবাহী রণতরী এবং ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজগুলিকে যে কোনও পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য ‘ক্ষেপণাস্ত্র শহর’-এর ভিডিয়ো প্রকাশকে ইরানি কমান্ডারদের ‘নির্বুদ্ধিতা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের যুক্তি, এর মাধ্যমে শক্তি দেখানোর বদলে নিজেদের দুর্বলতা শত্রুর সামনে তুলে ধরেছে তেহরান। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ ওই এলাকার একবার হদিস করতে পারলেই বিপদে পড়বে শিয়া সেনা। তখন ‘হাতিয়ার নগরী’ ধ্বংস করা খুব একটা কঠিন হবে না যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।

দ্বিতীয়ত, ‘ক্ষেপণাস্ত্র শহর’-এ মারাত্মক ধরনের হাতিয়ারগুলিকে খুব গায়ে গায়ে রেখেছেন ইরানি সেনাকর্তারা। ফলে দুর্ঘটনা বা অন্তর্ঘাতের ঘটনা ঘটলে গোটা এলাকাটি উড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। আমেরিকা, রাশিয়া বা চিন, ফৌজিশক্তির দিক থেকে উন্নত দেশগুলি কখনওই এ ভাবে অস্ত্র রাখে না। তাদের গোপন অস্ত্রভান্ডারের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।

যদিও গোটা ব্যাপারটিকে গায়ে মাখছে না ইরান। উল্টে যুক্তরাষ্ট্রকে উস্কানি দিতে তাঁদের ‘অভিন্ন হৃদয় বন্ধু’ ইজ়রায়েলকে ক্রমাগত নিশানা করে চলেছে তেহরান। এই কাজে প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী গাজ়ার হামাস, লেবাননের হিজ়বুল্লা এবং ইয়েমেনের হুথিদের ময়দানে নামিয়েছে শিয়া ফৌজ। তিন শক্তি মিলিত ভাবে ইহুদি রাষ্ট্র এবং লোহিত সাগরের মার্কিন রণতরীগুলিতে রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ইজ়রায়েল এবং আমেরিকার যুদ্ধজাহাজে আক্রমণ শানিয়ে তাদের যুদ্ধের ময়দানে টেনে নামাতে চাইছে তেহরান। সেই লক্ষ্যে হামাস, হিজ়বুল্লা এবং হুথিদের গোপনে হাতিয়ার সরবরাহ করে চলেছেন ইরানি কমান্ডারেরা। অন্য দিকে পাল্টা দাবার চালে ইরানকে প্যাঁচে ফেলতে পাকিস্তানের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি চালাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তেল আভিভ।

ইসলামাবাদের সঙ্গে ইজ়রায়েলের সম্পর্ক সাপে-নেউলে। ইহুদিভূমিকে এখনও রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়নি পাকিস্তান। কিন্তু এ বছরের মার্চে হঠাৎ করেই তেল আভিভ সফরে যায় সেখানকার একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল। সেই ছবি প্রকাশ্যে আসায় চাপে পড়ে পাকিস্তানের শাহবাজ় শরিফ সরকার। অস্বস্তি এড়াতে শেষ পর্যন্ত একে ব্যক্তিগত উদ্যোগের সফর বলে উল্লেখ করে ইসালামাবাদ।

বিশ্লেষকদের অনুমান, ইরানের পিঠে ছুরি বসাতে পাক ফৌজকে ব্যবহার করতে চাইছে আমেরিকা এবং ইজ়রায়েল। আর তাই ইসলামাবাদে পালাবদল চাইছেন ট্রাম্প। জেলবন্দি ইমরান খানকে কুর্সিতে ফেরানোর ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। সাবেক পাক প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনে পেন্টাগনের সামনে সে দেশে ড্রোন ঘাঁটি তৈরির রাস্তা খুলে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

পাকভূমিতে সৈন্য ঘাঁটি তৈরি করতে পারলে ইরানের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে আমেরিকা। তেহরানের পক্ষে কিন্তু সেখানে হামলা চালানো কঠিন হবে। কারণ এতে পরমাণু শক্তিধর ইসলামাবাদকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানো হবে। তা ছাড়া পশ্চিমে ইজ়রায়েল এবং পূর্বে আমেরিকা, দু’দিকে লড়তে হবে শিয়া ফৌজকে। সেই ঝুঁকি অবশ্যই নিতে চাইবেন না আইআরজিসির কমান্ডারেরা।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, ইরানকে প্যাঁচে ফেলার ঘুঁটি ইতিমধ্যেই সাজানো শুরু করে দিয়েছে আমেরিকা। ইমরানকে কুর্সিতে ফেরাতে পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে ওয়াশিংটন। উল্লেখ্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেফতারের নীল নকশা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত বলে মনে করা হয়।

ইরান অবশ্য কোনও কিছুকেই সে ভাবে গুরুত্ব দিতে নারাজ। শিয়া মুলুকটির শীর্ষ ধর্মগুরু আয়াতোল্লাহ আলি খামেনাই আমেরিকাকে ‘গুন্ডা’ বলে সম্বোধন করেছেন। গত কয়েক বছরে রাশিয়া এবং চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে তেহরানের। ফলে যুদ্ধ শুরু হলে এই দুই মহাশক্তিধর হাত খুলে ইরানের পাশে এসে দাঁড়াবে বলে মনে করছে তারা।
সব ছবি: সংগৃহীত।