এক দিকে সমুদ্রে শক্তিবৃদ্ধি, অন্য দিকে যুদ্ধরত দুই দেশকে কাছাকাছি নিয়ে আসা। বছর শেষে এক ঢিলে দুই পাখি মারল ভারত। নয়াদিল্লির এই কূটনৈতিক চাল দেখে হতবাক গোটা বিশ্ব। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শেষ করে পূর্ব ইউরোপে শান্তি স্থাপনের পথে আগামী দিনে এই ধরনের পদক্ষেপ দারুণ ভাবে কাজে লাগবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
চলতি বছরের ৯ ডিসেম্বর রুশ বন্দর শহর কালিনিনগ্রাদের ইয়ান্টার শিপইয়ার্ডে নতুন যুদ্ধজাহাজ ভারতীয় নৌসেনার হাতে তুলে দেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। জলযোদ্ধাদের অস্ত্রাগারে এর ‘কমিশনিং’ অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন মস্কোর পদস্থ নৌকর্তারা। নবনির্মিত যুদ্ধজাহাজটির ডেকে দাঁড়িয়ে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাজায় রুশ নৌসৈনিকদের ব্যান্ড। সেই ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে।
ভারতীয় নৌসেনার বড়দিনের উপহার ওই যুদ্ধজাহাজটির পোশাকি নাম ‘আইএনএস তুশিল’। এটি প্রকৃতপক্ষে ক্রিভাক তৃতীয় শ্রেণির ফ্রিগেট। জলযানটি ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম। রণতরীটি হাতে পাওয়ায় এ দেশের জলযোদ্ধাদের শক্তি যে অনেকটাই বৃদ্ধি পেল, তা বলাই বাহুল্য। তুশিলকে ভারতের সমুদ্রশক্তির ‘গর্বিত প্রমাণ’ বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ।
এই রণতরী তৈরিকে কেন্দ্র করে কী ভাবে রণাঙ্গনে রক্ত ঝরানো ইউক্রেন ও রাশিয়াকে পাশাপাশি আনল ভারত? প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনের ইঞ্জিনেই রুশ শিপইয়ার্ডে প্রাণ পেয়েছে আইএনএস তুশিল। এর জন্য অবশ্য নয়াদিল্লিকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। এই ঘটনাকে তাই মস্কোর সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের ‘উল্লেখযোগ্য মাইলফলক’ বলে চিহ্নিত করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
‘তুশিল’ শব্দটি সংস্কৃত থেকে নেওয়া হয়েছে। এর অর্থ ঢাল বা রক্ষক। ‘১১৩৫৬ প্রকল্প’-এর আওতায় চলেছে এই রণতরীর নির্মাণকাজ। যুদ্ধজাহাজটিকে ‘তরোয়াল বাহু’ (সোর্ড আর্ম) গ্রুপে শামিল করেছে ভারতীয় নৌসেনা। বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির শক্তিশালী ফ্রিগেটের মধ্যে তুশিল জায়গা করে নিয়েছে বলে স্পষ্ট করেছে নয়াদিল্লি।
২০১৩ সালের ১২ জুলাই রণতরীটির নীচের ‘কিল’ অংশটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। ২০২১ সালের অক্টোবরে একে জলে নামায় রুশ নৌসেনা। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি থেকে লম্বা সময় ধরে চলে এর সামুদ্রিক ট্রায়াল। প্রতিটা পরীক্ষাতেই সসম্মানে উত্তীর্ণ হয় তুশিল। যুদ্ধজাহাজটি থেকে রুশ হাতিয়ার ছুড়েও এর ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর রণতরীটি ডেলিভারির জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়ে দেয় মস্কো।
‘১১৩৫৬ প্রকল্পে’ তলোয়ার শ্রেণির ফ্রিগেট তৈরি করছে ভারতীয় নৌসেনা। এগুলির নকশা ও নির্মাণকাজ দুটোই করছে মস্কো। আইএনএস তুশিল প্রকৃতপক্ষে রুশ ‘অ্যাডমিরাল গ্রিগোরোভিচ’ শ্রেণির ফ্রিগেটগুলির একটি উন্নত সংস্করণ। ১৯৯৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই ধরনের মোট ছ’টি রণতরী ভারতকে সরবরাহ করেছে রাশিয়া।
২০১৬ সালের অক্টোবরে মস্কোর যুদ্ধজাহাজ নির্মাণকারী সংস্থা ‘জেএসসি রসোবরোনেক্সপোর্ট’কে ফ্রিগেট নির্মাণের বরাত দেয় নয়াদিল্লি। এই ব্যাপারে কোম্পানিটির সঙ্গে একটি চুক্তিও করে ভারতীয় নৌসেনা। ২০২২ সালের শেষে রণতরীটি সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে তা পিছিয়ে যায়। তুশিলের কমিশনিং অনুষ্ঠানে এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন রাশিয়ার ইউনাইটেড শিপবিল্ডিং কর্পোরেশনের ডিরেক্টর জেনারেল আলেক্সি রাখমানভ।
রাখমানভ জানিয়েছেন, তুশিলের ইঞ্জিন সরবরাহে বিলম্বের কারণেই এটির নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা যায়নি। ইউক্রেনের সংস্থা ‘জোরা-ম্যাসপ্রোয়েক্ট’-এর তৈরি ইঞ্জিন এতে বসাতে চুক্তিতে জোর দিয়েছিল ভারত। ২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী দেশটিতে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ শুরু করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইউক্রেনীয় সংস্থা থেকে ওই ইঞ্জিন কালিনিনগ্রাদের শিপইয়ার্ডে এসে পৌঁছয়নি।
যুদ্ধজাহাজের গ্যাস টারবাইন ইঞ্জিন তৈরির ক্ষেত্রে ‘জোরা-ম্যাসপ্রোয়েক্ট’-এর দুনিয়া জোড়া খ্যাতি রয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর অন্তত ৩০টি রণতরীতে এই সংস্থার ইঞ্জিন বসানো রয়েছে। ‘বীর’ শ্রেণির ক্ষেপণাস্ত্রবাহী নৌকা থেকে শুরু করে ‘রাজপুত’ এবং ‘বিশাখাপত্তনম’ শ্রেণির ডেস্ট্রয়ার— ইউক্রেনীয় সংস্থাটির তৈরি ইঞ্জিনে ভর করে ভারত ও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই সমস্ত যুদ্ধজাহাজ।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মস্কোয় পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে কিভ। কিন্তু সংঘর্ষ বাধার আগেই ‘জোরা-ম্যাসপ্রোয়েক্ট’-এর সঙ্গে সরকারি স্তরে একটি চুক্তি সেরে রেখেছিল নয়াদিল্লি। সেই শর্ত অনুযায়ী ফ্রিগেটের ইঞ্জিন এ দেশে পাঠায় ইউক্রেনীয় সংস্থা। তার পর সেটি রুশ শিপইয়ার্ডে পৌঁছে দেওয়া হয়। এ ভাবে হাত ঘুরে ইঞ্জিন পাওয়ায় তুশিল নির্মাণে দেরি হয়েছে বলে জানিয়েছে মস্কো।
ভারতীয় নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ডিকে শর্মা অবশ্য নবনির্মিত এই ফ্রিগেটকে ‘গেম চেঞ্জার’ বলে উল্লেখ করেছেন। ১২৫ মিটার লম্বা ও ৩,৯০০ টন ওজনের আইএনএস তুশিল ঘণ্টায় ৩০ নটিক্যাল মাইলের বেশি গতিতে ছুটতে পারে। এ দেশের জলযোদ্ধাদের বৃহত্তম ডেস্ট্রয়ার ‘আইএনএস কলকাতা’-র দৈর্ঘ্য ও ওজন যথাক্রমে ১৬৩ মিটার ও ৭,৫০০ টন।
নবনির্মিত রণতরীটিতে রয়েছে আটটি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র। এর থেকে উল্লম্ব ভাবে সেগুলিকে ছোড়ার সুবিধা রয়েছে। এ ছাড়া ২৪টি মাঝারি ও ৮টি স্বল্প পাল্লার ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রে (সারফেস টু এয়ার মিসাইল) সাজিয়ে তোলা হয়েছে যুদ্ধজাহাজটির অস্ত্রাগার। রণতরীটির ডেকের উপর বসানো আছে ১০০ মিলিমিটারের কামান। ডিচ প্রতিরক্ষার জন্য রয়েছে আরও দু’টি ‘ক্লোজ় ইন’ হাতিয়ার।
যুদ্ধজাহাজের ‘অ্যান্টিডট’ হল ডুবোজাহাজ। জলের গভীরে থেকে রণতরী ধ্বংস করার ক্ষেত্রে এর জুড়ি মেলা ভার। সেই আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যবস্থাও তুশিলে রাখা হয়েছে। ফ্রিগেটটিতে রয়েছে দু’টি ডাবল টর্পেডো টিউব এবং একটি রকেট লঞ্চার। পাশাপাশি রাডার, নেভিগেশন এডস, সোনার ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট এবং ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেমের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এর রণসাজ।
এ ছাড়া রণতরীটি অ্যান্টি-সাবমেরিন ও এয়ারবর্ন আর্লি ওয়ার্নিং হেলিকপ্টার বহনে সক্ষম। রুশ ‘কামভ ২৮’ এবং ‘কামভ ৩১’ কপ্টার এতে রাখছে নৌসেনা। এগুলির সাহায্যে শত্রু ডুবোজাহাজ খুঁজে তা ধ্বংস করতে আইএনএস তুশিলকে কাজে লাগানো হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কালিনিনগ্রাদের শিপইয়ার্ড থেকে রণসাজে সজ্জিত যুদ্ধজাহাজটিকে নিয়ে এ দেশের নৌঘাঁটির দিকে রওনা হয়েছেন ভারতের জলযোদ্ধারা।
ন্যাশনাল ডিফেন্স ম্যাগাজ়িনের প্রধান সম্পাদক এবং সেন্টার ফর অ্যানালাইসিস অফ ওয়ার্ল্ড আর্মস ট্রেডের ডিরেক্টর ইগর কোরোটচেঙ্কো বলেছেন, ‘‘বিভিন্ন ধরনের অপারেশনে আইএনএস তুশিলকে ব্যবহার করতে পারবে ভারতীয় নৌসেনা। রক্ষণাত্মক এবং আক্রমণ— দুই ধরনের যুদ্ধের কথা ভেবে এটিকে নির্মাণ করা হয়েছে।’’
রুশ সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘স্পুটনিক ইন্ডিয়া’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কোরোটচেঙ্কো আইএনএস তুশিলের ডুবোজাহাজ ধ্বংস ক্ষমতার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, ‘‘এই রণতরী আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে ভারতকে অনেক বেশি এগিয়ে রাখবে। ভূরাজনৈতিক স্বার্থে এবং নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এই যুদ্ধজাহাজকে কাজে লাগাতে পারবে নয়াদিল্লি।’’
ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ক্রমশ শক্তি বাড়াচ্ছে চিন। বিশ্লেষকদের অনুমান, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সমুদ্রশক্তির নিরিখে আমেরিকাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাবে বেজিং। এই পরিস্থিতিতে আইএনএস তুশিলের মতো শক্তিশালী ফ্রিগেট ভারতীয় নৌসেনার হাতে পাওয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই ধরনের আরও দু’টি ফ্রিগেটের নির্মাণকাজ রুশ শিপইয়ার্ডে চালিয়ে যাচ্ছে নয়াদিল্লি।
সব ছবি: সংগৃহীত।