সীমান্ত চোখরাঙানি বন্ধ করছে না চিন। ফের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলএসির কাছে বড় আকারের ফৌজি মহড়া চালাল বেজিং। সেখানে অত্যাধুনিক হাতিয়ার এবং ড্রোন ব্যবহার করেছে ড্রাগনল্যান্ডের পিপল্স লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। পাশাপাশি যুদ্ধের সময়ে দ্রুত রণাঙ্গনে সৈনিকদের কাছে গোলা-বারুদ এবং রসদ পৌঁছে দেওয়ার অভ্যাসও চালিয়েছে তারা।
ফি বছর ১৫ জানুয়ারি ভারতে পালিত হয় স্থলসেনা দিবস (আর্মি ডে)। সূত্রের খবর, এ বার তার কয়েক দিন আগে এলএসিতে যুদ্ধাভ্যাস চালিয়েছে চিনা লালফৌজ। ফলে সময়ের নিরিখে এই মহড়াকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। শুধু তা-ই নয়, লাদাখ সীমান্তের কাছে পিএলএ অফিসার ও জওয়ানেরা গা ঘামিয়েছেন বলে জানা দিয়েছে।
সূত্রের খবর, পিএলএর জিনজিয়াং মিলিটারি কম্যান্ডের তরফে ওই মহড়ার আয়োজন করা হয়েছিল। এতে শুধুমাত্র একটি রেজিমেন্টের সেনা অফিসার এবং জওয়ানেরা যোগ দিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। উঁচু পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধাভ্যাস চালান তাঁরা। মহড়ায় খাড়াই ভূখণ্ডে চলাচলের যানবাহন ব্যবহার করেছে চিনা ফৌজ।
ড্রাগন ফৌজের এই মহড়ার খবর পাওয়ার পর এলএসিতে হাই অ্যালার্টে চলে যায় ভারতীয় সেনা। তবে মহড়া চলাকালীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় কোনও রকমের আগ্রাসন দেখায়নি পিএলএ। এই ধরনের মহড়ার একাধিক তাৎপর্য রয়েছে বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
বিশ্লেষকদের কথায়, লাদাখের উঁচু পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধাভ্যাস চালিয়ে হিমালয় অঞ্চলের লড়াইয়ে নিজেদের ফৌজের শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছে চিন। এই এলাকায় পিএলএর অফিসার এবং জওয়ানেরা যে সমস্ত শারীরিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন, সেটা কাটিয়ে ওঠা ড্রাগনের মূল লক্ষ্য। আগামী দিনে ফের আগ্রাসনের রাস্তায় হাঁটতে পারে বেজিং। তার আগে লালফৌজকে সব রকম ভাবে তৈরি রাখতে এই পদক্ষেপ বলে মনে করেন তাঁরা।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) ১৮ ডিসেম্বর ‘মিলিটারি অ্যান্ড সিকিউরিটি ডেভেলপমেন্টস ইনভলভিং দ্য পিপল্স রিপাবলিক অফ চায়না’ শীর্ষক রিপোর্ট প্রকাশ করে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন। সেখানে বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের গলওয়ান সংঘর্ষের পর এলএসি-তে সৈন্য সমাহার মোটেই হ্রাস করেনি বেজিং। লাদাখ থেকে অরুণাচল পর্যন্ত ৩,৪৮৮ কিলোমিটার বিস্তৃত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় পিপল্স লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) ১ লক্ষ ২০ হাজারের বেশি ফৌজি মোতায়েন রয়েছেন।
এর পাশাপাশি, এলএসি-তে চিনের সেনা কী কী হাতিয়ার জমা করেছে, তারও বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে পেন্টাগনের রিপোর্টে। আমেরিকার দাবি, ওই এলাকায় মোতায়েন থাকা পিএলএ অফিসার ও জওয়ানদের কাছে রয়েছে ট্যাঙ্ক, হাউইৎজ়ার কামান, ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং অন্যান্য উন্নত সামরিক সরঞ্জাম।
পেন্টাগনের রিপোর্টের সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল, পিএলএ-র অন্তত ২০টি সম্মিলিত অস্ত্র ব্রিগেডের (কমবাইন্ড আর্মস ব্রিগেড বা সিএবি) উপস্থিতির উল্লেখ। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার পূর্ব, পশ্চিম এবং মধ্যবর্তী একাধিক কৌশলগত এলাকায় যুদ্ধের জন্য তাদের মজুত রেখেছে ড্রাগন। সংঘর্ষ বাধলে লাদাখ বা অরুণাচলের জমি কব্জা করার ক্ষেত্রে ওই ব্রিগেডকে তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করতে পারে বেজিং।
২০২০ সালে পূর্ব লাদাখের গলওয়ানে আগ্রাসী মনোভাব দেখায় বেজিং। আচমকাই পিএলএ-র আক্রমণে প্রাণ হারান ভারতীয় সেনার বিহার রেজিমেন্টের ১৭ নম্বর ব্যাটেলিয়নের কম্যান্ডিং অফিসার কর্নেল বি সন্তোষ বাবু-সহ মোট ২০ জন সৈনিক। পাল্টা প্রত্যাঘাতে ৪০-৪৫ জন চিনা ফৌজির মৃত্যু হয়েছিল বলে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও চিনের শি জিনপিং সরকার কখনওই তা স্বীকার করেনি।
ওই ঘটনার পর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় বিপুল পরিমাণে বাহিনী মোতায়েন করে নয়াদিল্লি। এলএসি-তে পিএলএর চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে ভারতীয় সেনা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দু’তরফেই চলে ফৌজি অফিসার পর্যায়ে বৈঠক। শেষে গত নভেম্বরে প্রকাশ্যে আসে বরফ গলার খবর। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দেয়, ২০২০ সালে গলওয়ান সংঘর্ষের আগের অবস্থানে ফিরে যেতে রাজি হয়েছে চিনা ফৌজ।
এলএসিতে বরফ গলানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের সঙ্গে একাধিক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন তিনি। পরে সীমান্তের ব্যাপারে সমঝোতায় আসে বেজিং। লাদাখের ডেপসাং এবং ডেমচোকের মতো সংবেদনশীল এলাকায় ফের টহলদারি শুরু করে ভারতীয় সেনা। তবে এই সমঝোতা যে লম্বা সময়ের জন্য ড্রাগন ফৌজ মেনে চলবে এমন নিশ্চয়তা দিচ্ছেন না বেশির ভাগ প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ।
এই পরিস্থিতিতে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে পাল্টা পদক্ষেপ করছে ভারতীয় সেনা। বাহিনীকে যে কোনও পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত রাখতে ফি বছর ‘হিম বিজয়’ নামের মহড়ার আয়োজন করছে ফৌজ। চলে প্যারা ট্রুপিংয়ের মতো কঠোর যুদ্ধাভ্যাস।
এ ছাড়া এলএসিতে নজরদারির জন্য অত্যাধুনিক ড্রোন ব্যবহার করছে ভারতীয় সেনা। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বাহিনীর কাছে যাতে দ্রুত গোলা-বারুদ এবং রসদ পৌঁছে দেওয়া যায়, তার জন্য রাস্তা, সেতু এবং টানেল-সহ সীমান্তে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোর কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করার দিকে নজর দিয়েছে কেন্দ্র।
পেন্টাগনের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, পরমাণু শক্তিও বৃদ্ধি করছে বেজিং। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, গত বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত পিএলএর কাছে আণবিক অপারেশনাল ওয়ারহেডের সংখ্যা ছিল ৬০০। ২০৩০ সালের মধ্যে সংখ্যাটি হাজার ছাড়াবে বলে মনে করছে আমেরিকা।
ওয়াশিংটন জানিয়েছে, দূরপাল্লার আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের (ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম) সংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে চিন। পরমাণু অস্ত্রের হামলা চালানোর ক্ষেত্রে বৈচিত্র রাখার দিকে নজর রয়েছে লালসেনার অফিসারদের। সেই মতো নতুন নতুন সামরিক প্রযুক্তিতে জোর দিচ্ছেন তাঁরা।
এই অবস্থায় লাদাখ থেকে অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত বিভিন্ন কৌশলগত এলাকায় উন্নত হাতিয়ার মোতায়েন করেছে ভারতীয় সেনা। এর মধ্যে রয়েছে কে-৯ বজ্র সেল্ফ প্রপেলড হাউইৎজ়ার (চাকা লাগানো কামান) এবং রুশ বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০।
আমেরিকার জারি করা রিপোর্টকে কেন্দ্র করে বিবৃতি দিয়েছে চিন। বেজিংয়ের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যে ভাল হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের সহ্য হচ্ছে না। আর তাই উস্কানি দিতে এই ধরনের ভুয়ো তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।’’ আমেরিকাকে ‘যুদ্ধবাজ’ দেশ বলে খোঁচা দিতেও ছাড়েননি তিনি। তবে সাম্প্রতিক মহড়া নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেনি জিনপিং প্রশাসন।
আর তাই কোনও রকমের ঝুঁকি নিতে নারাজ নয়াদিল্লি। বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে একাধিক সামরিক মহড়ায় যোগ দিচ্ছে এ দেশের তিন ফৌজ। তালিকায় রয়েছে ফ্রান্স এবং আমেরিকার মতো উন্নত সামরিক রাষ্ট্রও। এই ধরনের যুদ্ধাভ্যাসগুলি ভারতীয় সেনার সক্ষমতা যে অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে, তা বলাই বাহুল্য।
সব ছবি: সংগৃহীত।