সদ্য চিনের সঙ্গে মিটেছে সীমান্ত সংঘাত। কিন্তু তা বলে কি ‘ড্রাগন’কে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়! সে কথা মাথায় রেখেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি)-র কাছে নতুন বায়ুসেনা ঘাঁটি তৈরি করেছে নয়াদিল্লি। যা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মুহূর্তে পাশার দান উল্টে দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, পূর্ব লাদাখের মুধ-নিয়োমাতে নবনির্মিত বিমানঘাঁটির যাবতীয় কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই আনুষ্ঠানিক ভাবে হবে এর উদ্বোধন। আর তখনই দেশের সর্বোচ্চ ‘এয়ারফিল্ড’ হাতে পাবে ভারতীয় বায়ুসেনা। এলএসি লাগোয়া ওই ঘাঁটিতে নিয়মিত ওঠানামা করবে সুখোই, রাফাল বা তেজসের মতো যুদ্ধবিমান।
পূর্ব লাদাখের ওই এয়ারফিল্ডটির উচ্চতা মাটি থেকে আনুমানিক ১৩ হাজার ৭০০ ফুট। এর পোশাকি নাম ‘অ্যাডভান্স ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড’ (এএলজি)। যুদ্ধের সময়ে এর কৌশলগত অবস্থান বাহিনীকে বাড়তি সুবিধা দেবে। পাশাপাশি, লাদাখের মতো পাহাড়ি এলাকায় সংঘর্ষ বাধলে দ্রুত ফৌজকে রণাঙ্গনে নিয়ে যাওয়া বা সৈনিকদের জন্য হাতিয়ার ও গোলা-বারুদের জোগান ঠিক রাখতেও এই ঘাঁটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।
নিয়োমার নবনির্মিত বায়ুসেনা ঘাঁটিতে রয়েছে তিন কিলোমিটার লম্বা রানওয়ে। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে যাবতীয় অপারেশন চালিয়ে যাওয়ার কথা মাথায় রেখে ওই রানওয়ে তৈরি করা হয়েছে। ২০২১ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে এই ঘাঁটি নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্র। এর জন্য আনুমানিক ২১৪ কোটি টাকা খরচ করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার দুর্গম এলাকাগুলিতে নজরদারি চালানো খুবই চ্যালেঞ্জিং। স্থলসেনার সেখানে পৌঁছতে কালঘাম ছুটে যায়। এত দিন পর্যন্ত ওই এলাকায় কোনও বায়ু সেনাঘাঁটি না থাকায় সে ভাবে নজর রাখতে পারছিল না বায়ুসেনা। এ বার স্থলবাহিনীর পাশাপাশি চিন সীমান্তের উপর কড়া নজরদারি করতে পারবে তারাও।
২০২০ সালে পূর্ব লাদাখে আগ্রাসী মনোভাব দেখায় চিন। এলএসি জুড়ে বিপুল সেনা মোতায়েন করে বেজিং। পাল্টা পদক্ষেপ করে নয়াদিল্লিও। রাতারাতি লাদাখ সীমান্তে বাহিনীর পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয় কেন্দ্র। ফলে বেশ কিছু জায়গায় চিনের ‘পিপলস্ লিবারেশন আর্মি’র (পিএলএ) একেবারে মুখোমুখি রণং দেহি মূর্তিতে দাঁড়িয়ে পড়ে ভারতীয় সেনা।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কথায়, এই পরিস্থিতিতে মুধ-নিয়োমাতে এয়ারফিল্ড নির্মাণে সবুজ সঙ্কেত দেওয়া ছিল অন্যতম কঠিন সিদ্ধান্ত। কারণ, সীমান্তের এত কাছে বায়ুসেনা ঘাঁটি তৈরি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল ড্রাগনল্যান্ড। সেই চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করেই দ্রুত গতিতে এয়ারফিল্ড তৈরির কাজ চালিয়ে যায় ভারত।
ওই এলাকায় শুধুমাত্র যে বায়ুসেনা ঘাঁটি তৈরি করা হয়েছে, এমনটা নয়। রাস্তা, সেতু ও পাহাড়ি সুড়ঙ্গের মাধ্যমে লাদাখের একাধিক এলাকার সঙ্গে মুধ-নিয়োমাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। যা সীমান্তে মোতায়েন ফৌজকে গোলা-বারুদ এবং অন্যান্য রসদ সরবরাহে সাহায্য করবে। এগুলির কৌশলগত গুরুত্বও নবনির্মিত এয়ারফিল্ডের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।
এর আগে লাদাখে বায়ুসেনার জন্য আরও একটি ঘাঁটি তৈরি করে নয়াদিল্লি। যা উত্তরে সিয়াচেন হিমবাহের কাছে দৌলত বেগ ওল্ডিতে অবস্থিত। হিমালয়ের কারাকোরাম রেঞ্জের ফৌজি ছাউনির মধ্যে রয়েছে তার এয়ারস্ট্রিপ। এটিরও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অপরিসীম। তবে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে দৌলত বেগের দূরত্ব বেশি হওয়ায় নতুন এয়ারফিল্ড নির্মাণ অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়ে, জানিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা।
উল্লেখ্য, সাড়ে ১৩ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় বায়ুসেনার ঘাঁটি নির্মাণ মোটেই সহজ কাজ ছিল না। এটি তৈরিতে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাই ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই প্রতিকূলতা সয়ে সময়ের মধ্যে কাজ হওয়ায় সরকারের সদিচ্ছার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন প্রাক্তন সেনাকর্তারা। এতে লাদাখের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলির সঙ্গে যোগাযোগের সামরিক ও অসামরিক যোগাযোগ কয়েক গুণ বাড়বে বলে দাবি করেছেন তাঁরা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর ফলে ভবিষ্যতে এই এলাকায় অসামরিক বিমান পরিবহণের সুযোগও বাড়ল। এই এয়ারফিল্ডের হাত ধরে হবে তার সূচনা। ফলে এটি লাদাখ সীমান্তের বাসিন্দাদের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গভীর ছাপ ফেলবে। আগামী দিনে অসামরিক বিমান পরিবহণ শুরু হলে এলাকার আর্থিক চিত্র পাল্টাবে বলেও মন্তব্য করেছেন তাঁরা।
গত কয়েক বছর ধরেই হিমালয়ের সীমান্তে পরিকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে নয়াদিল্লি। দীর্ঘ দিন ধরেই যার দাবি জানিয়ে আসছে ভারতীয় ফৌজ। পাশাপাশি, সেনায় চালু হচ্ছে ‘থিয়েটার কম্যান্ড’। নবনির্মিত এয়ারফিল্ড নর্থ থিয়েটারের আওতায় থাকবে বলে সূত্র মারফৎ খবর মিলেছে। বায়ুসেনার সঙ্গেই যা ব্যবহার করবে স্থলসেনার অ্যাভিয়েশন ইউনিট।
২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় আগ্রাসী পিএলএর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ভারতীয় সেনা। তাতে কর্নেল বি সন্তোষ বাবু-সহ নিহত হন ২০ জন জওয়ান। পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, ওই ঘটনায় ৪০ থেকে ৫০ জন সৈনিক হারিয়েছিল চিনা ফৌজ। যা সরকারি ভাবে কখনই স্বীকার করেনি বেজিং।
ওই ঘটনার পর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় দু’পক্ষই সৈন্য সংখ্যা বাড়াতে শুরু করে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াংয়ে ঢোকার চেষ্টা চালায় পিএলএ। কিন্তু ভারতীয় সেনার প্রত্যাঘাতে পিছু হটতে হয় তাঁদের।
এই আবহে সীমান্তে উত্তেজনা কমাতে আগ্রহী হয় দুই দেশ। শুরু হয় কোর কম্যান্ডার পর্যায়ের বৈঠক। ফলে ধীরে ধীরে এলএসি লাগোয়া একাধিক এলাকা থেকে বাহিনী সরিয়ে নিয়ে বাধ্য হয় বেজিং। যদিও পূর্ব লাদাখের ডেপসাং এবং ডেমচক সীমান্ত ছেড়ে ব্যারাকে ফিরে যেতে নারাজ ছিল পিএলএ।
লালফৌজ ওই সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকায় ডেপসাং এবং ডেমচকে টহল দিতে সমস্যা হচ্ছিল ভারতীয় সেনার। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে পুরনো অবস্থান থেকে সরে আসে বেজিং। ফলে ওই দুই জায়গা থেকেও সৈন্য প্রত্যাহার করছে পিএলএ। যা ২০২০ সালের আগের অবস্থানে ফিরে যেতে সাহায্য করেছে। ধীরে ধীরে ডেপসাং এবং ডেমচকে টহল শুরু করেছে ভারতীয় সেনা।
২৯ অক্টোবর ড্রোন থেকে তোলা এলএসির বেশ কিছু ছবি প্রকাশ্যে আসে। সেখানে দুই দেশের সৈনিকদেরই সীমান্তে অস্থায়ী কাঠামো ভেঙে দিয়ে পিছু হটতে দেখা গিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, চিনকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করার নেপথ্যে নতুন এয়ারফিল্ড নির্মাণও প্রচ্ছন্ন ভাবে চাপ তৈরিতে সাহায্য করেছে।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, তিব্বতের বায়ু সেনাঘাঁটিতে একাধিক যুদ্ধবিমান এবং বোমারু বিমান মোতায়েন করে রেখেছে পিএলএ। ফলে সংঘর্ষের সময়ে অনায়াসে সেখান থেকে এলএসিতে থাকা ভারতীয় সৈনিকদের উপর আক্রমণ শানাতে পারবে বেজিং। সে ক্ষেত্রে নতুন এয়ারফিল্ড থেকে পাল্টা জবাব দেওয়া অনেক সহজ হবে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
তবে বর্তমানে ভারতীয় বায়ুসেনা যুদ্ধবিমানের অভাবে ভুগছে। আর তাই দ্রুত ১১৪টি যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে জোর দিয়েছে নয়াদিল্লি। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ‘তেজস’-এর উন্নত সংস্করণ নির্মাণেও গতি আনার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি, ঘরের মাটিতেই দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ ‘এএমসিএ’ (অ্যাডভান্স মিডিয়াম কমব্যাট এয়ারক্রাফট) যুদ্ধবিমান তৈরির চেষ্টাও চালাচ্ছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
সব ছবি: সংগৃহীত।