ভারতে লিথিয়ামের খনি আবিষ্কারের পর থেকে চর্চায় বহুমূল্য এই ধাতু। দেশজুড়ে সকলে উচ্ছ্বাসে মেতেছেন। কিন্তু এই উচ্ছ্বাসের স্বাদ হয়তো মিলতে পারত অনেক আগেই।
ভারতে যে লিথিয়ামের খনি রয়েছে, তা প্রায় ২৬ বছর আগেই আন্দাজ করা গিয়েছিল। ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ বা জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (জিএসআই) এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল ১৯৯৭ সালে।
’৯৭-এর সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বক্সাইটের খনি রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এ দেশে লিথিয়ামের উপস্থিতির সম্ভাবনাও বেশ উজ্জ্বল।
১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত নানা গবেষণা চালায় জিএসআই। তার পরেই এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু রিপোর্টের ভিত্তিতে কাজ এগোয়নি।
অভিযোগ, লিথিয়াম অভিযান এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯৯৭ সালের পর আর কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গড়িমসিকেই এই নেপথ্যে দায়ী করছেন কেউ কেউ।
জম্মু ও কাশ্মীরের রিয়াসি জেলায় ৫৯ লক্ষ টন লিথিয়ামের সন্ধান পেয়েছে জিএসআই। বৃহস্পতিবার বিবৃতি দিয়ে এ কথা জানানোর পরেই সাড়া পড়ে গিয়েছে নানা মহলে। এর আগে ভারতের কোথাও লিথিয়ামের অস্তিত্ব জানা ছিল না কারও।
লিথিয়াম একটি অত্যন্ত মূল্যবান ধাতু। মূলত ব্যাটারি তৈরিতে এই ধাতু কাজে লাগে। লিথিয়ামের ব্যাটারি ছাড়া বৈদ্যুতিন গাড়ি অচল। মোবাইলের ব্যাটারি তৈরিতেও লিথিয়াম ব্যবহৃত হয়।
মোবাইল, গাড়ি ছাড়াও ডিজিটাল ক্যামেরা, ল্যাপটপের ব্যাটারিতে লিথিয়াম প্রয়োজন হয়। বাইপোলার ডিজঅর্ডারের মতো মানসিক রোগের চিকিৎসায় এই ধাতুর ব্যবহার রয়েছে।
বর্তমানে লিথিয়াম বাইরে থেকে আমদানি করে ভারত। আমদানিকৃত লিথিয়াম দিয়ে তৈরি হয় ব্যাটারি। তাই এই ধাতুর দামও ভারতে আকাশছোঁয়া। দেশেই বহুমূল্য এই ধাতুর খনি থাকায় এ বার লিথিয়াম সস্তা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জিএসআই-এর সাম্প্রতিক এই আবিষ্কার অনুযায়ী, ভারতের উত্তর-পশ্চিমের উপত্যকার গভীরে যে পরিমাণ লিথিয়াম সঞ্চিত রয়েছে, তা ভারতকে এই বিরল ধাতুর সপ্তম বৃহত্তম ভান্ডারে পরিণত করতে পারে।
তবে ভারতে লিথিয়াম আবিষ্কারকে স্বাগত জানালেও তা নিয়ে এখনই উচ্ছ্বাসে মাততে রাজি নন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁরা জানাচ্ছেন, লিথিয়াম নিয়ে সাবধানে পা ফেলতে হবে। আগেই উচ্ছ্বাসে মাতলে কার্যসিদ্ধি হবে না।
রাষ্ট্রপুঞ্জের ধাতব উপাদানের শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী, যে কোনও আবিষ্কার, অনুসন্ধানের মোট চারটি ধাপ রয়েছে। লিথিয়াম সংক্রান্ত গবেষণায় জিএসআই বর্তমানে রয়েছে দ্বিতীয় ধাপে। আরও দু’টি ধাপ ডিঙিয়ে উঠতে পারলে এই গবেষণা সম্পূর্ণ হবে।
বর্তমানে লিথিয়ামের খনিতে খননকার্য চালিয়ে আকরিক বার করে আনার প্রযুক্তি ভারতের হাতে নেই। জম্মু ও কাশ্মীর সরকারকে এ ক্ষেত্রে আগে বেসরকারি কোনও সংস্থাকে লিথিয়াম শিল্পের বরাত দিতে হবে। তার পর কাজ এগোবে।
লিথিয়ামের খনি মূলত রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকায়। বিশ্বের সমগ্র লিথিয়াম ভান্ডারের ৫০ শতাংশ পাওয়া যায় ওই মহাদেশের তিনটি দেশ থেকে। আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া এবং চিলিতে প্রচুর পরিমাণে লিথিয়াম রয়েছে।
জম্মু ও কাশ্মীরের অন্যতম প্রাচীন শহর রিয়াসি। যা জম্মু ডিভিশনের অন্তর্গত। ছবির মতো সুন্দর এই জনপদ জম্মু থেকে ৬৪ কিলোমিটার দূরে। এই জেলাতেই রয়েছে বৈষ্ণোদেবী, শিব খোরির মতো তীর্থস্থান। আপাতত লিথিয়ামের খনির কারণে আরও গুরুত্ব বাড়ল জেলাটির।
লিথিয়ামের খনি পেয়ে খুশি উপত্যকার প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পাথর যে এক দিন তাঁদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে, তা আন্দাজ করেননি কেউই। লিথিয়ামে ভর করে বেকারত্ব ঘোচার স্বপ্ন দেখছেন গ্রামবাসীরা।
ভারত সরকারও লিথিয়াম আবিষ্কার নিয়ে উৎসাহী। এই ধাতু দেশের ব্যাটারি শিল্পে জোয়ার আনতে পারে। লিথিয়ামের কাঁধে ভর করে দেশ হয়ে উঠবে ‘আত্মনির্ভর’। প্রধানমন্ত্রীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করবে লিথিয়াম, তেমনটাই মনে করছে সরকার।
ছবি: সংগৃহীত।