ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল আইএএস অফিসারের বিরুদ্ধে। আর তার তদন্তে নেমে কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে এল কেউটে। পর্দা ফাঁস হল কোটি কোটি টাকা তছরুপ এবং বিশাল দুর্নীতির।
সেই দুর্নীতির কেন্দ্রে যিনি বসে, তিনি আর কেউ নন, ধর্ষণে অভিযুক্ত বিহারের ওই আইএএস অফিসারই। ওই আইএএস অফিসারের দুর্নীতির বহর দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছেন তদন্তকারীরাই।
বিহারের ওই আইএএস অফিসারের নাম সঞ্জীব হংস। তিনি ১৯৯৭ সালের বিহার ক্যাডারের আইএএস আধিকারিক।
সঞ্জীব এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (আরজেডি) প্রাক্তন নেতা তথা বিধায়ক গুলাব যাদব— দুর্নীতির মামলায় উভয়েই অক্টোবর থেকে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে। এখন নতুন করে আর্থিক দুর্নীতির পর্দা ফাঁস হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে জোরকদমে তদন্ত চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)৷
তবে এ সবের সূত্রপাত ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে, ধর্ষণের অভিযোগের মাধ্যমে। বন্দুক ঠেকিয়ে এক আইনজীবীকে গণধর্ষণের অভিযোগে বিহারের সিনিয়র আইএএস আধিকারিক সঞ্জীব এবং গুলাবের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়। অভিযোগ, মুখ খুললেই গুলি করে মেরে ফেলা হবে, এই ভয় দেখিয়ে আইনজীবীকে গণধর্ষণ করেন ওই দু’জন।
বিহার ক্যাডারের আইএএস আধিকারিক সঞ্জীব রাজ্যের বিদ্যুৎ দফতরের সচিব ছিলেন। অন্য দিকে, গুলাব ছিলেন আরজেডির নেতা তথা বিধায়ক। ২০২২ সালের মার্চে দলবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে ছ’বছরের জন্য গুলাবকে সাসপেন্ড করে তাঁর দল।
ধর্ষণের অভিযোগে দু’জনের বিরুদ্ধেই পটনার একটি থানায় এফআইআর দায়ের হয়েছিল। তবে খবর, প্রথমে অভিযোগের ভিত্তিতে এফআইআর নিতে আপত্তি করে পটনার মহিলা থানা। এর পর আদালতের দ্বারস্থ হন অভিযোগকারিণী। আদালতের হস্তক্ষেপে দায়ের হয় এফআইআর।
নিগৃহীতা আইনজীবীর অভিযোগ ছিল, ২০১৬-য় এক সিনিয়র আইনজীবীর কাছে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই তৎকালীন বিধায়ক গুলাবের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। এর পর আইনজীবীকে রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে আবার বন্দুক দেখিয়ে তাঁকে একাধিক বার ধর্ষণ করেন গুলাব।
গুলাবই ওই আইনজীবীর সঙ্গে ২০১৭ সালে পুণেয় পরিচয় করিয়ে দেন সঞ্জীবের। অভিযোগ, সেখানে মহিলাকে মাদক খাইয়ে বেহুঁশ করে আবার দু’জন মিলে ধর্ষণ করেন। নিগৃহীতার আরও অভিযোগ, সেই ঘটনার ভিডিয়ো বানিয়ে তা প্রকাশ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে বার বার দু’জন মিলে তাঁকে গণধর্ষণ করতেন। এ কথা পাঁচকান করলে গুলি করে তাঁকে খুন করার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।
অভিযোগকারিণীর এ-ও অভিযোগ ছিল, গুলাব এবং সঞ্জীব তাঁকে গর্ভপাত করাতে বাধ্য করেছিলেন। এর পর ২০১৮ সালে এক সন্তানের জন্ম দেন তিনি। সন্তানের পিতৃত্ব প্রমাণের জন্য ডিএনএ পরীক্ষার দাবিও তিনি করেছিলেন।
পটনা হাইকোর্ট সেপ্টেম্বর মাসে সঞ্জীবের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলাটি বাতিল করে দেয়। তবে সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, তত দিনে সঞ্জীবকে নিয়ে তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। আর্থিক দুর্নীতি সংক্রান্ত একের পর এক তথ্য উঠে আসতে শুরু করেছে তদন্তকারীদের হাতে। বিষয়টি নজরে এসেছে ইডিরও।
এর পর অক্টোবরে ইডির একটি দল হানা দিয়েছিল পটনায়। ওই অভিযানেই গ্রেফতার করা হয় বিহারের আমলা সঞ্জীবকে। পাশাপাশি ওই একই মামলায় দিল্লি থেকে গ্রেফতার করা হয় গুলাবকে। ইডির থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর মামলা রুজু করেছিল বিহার পুলিশ। এ ছাড়া ইডিও পৃথক ভাবে এই মামলার তদন্ত চালাচ্ছিল।
আর্থিক দুর্নীতি এবং আয়-বহির্ভূত সম্পত্তির অভিযোগ ওঠে তাঁদের বিরুদ্ধে। এর আগেও একাধিক বার সঞ্জীবের বাসভবনে ইডি হানা দিয়েছিল। ইডির হানার পর গত অগস্টেই সঞ্জীবকে জনপ্রশাসন দফতরে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল।
যাদব ২০১৫-২০২০ পর্যন্ত মধুবনী জেলার ঝাঞ্ঝরপুরের বিধায়ক ছিলেন। হংস বিদ্যুৎ সচিব পদে থাকাকালীন এবং যাদব বিধায়ক থাকাকালীন উভয়েই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ।
ঘুষ হিসাবে নগদ টাকা, বিলাসবহুল গাড়ি নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সঞ্জীবের বিরুদ্ধে। তাঁদের বিরুদ্ধে এই আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগটি প্রথম উঠে আসে অগস্ট মাসে। বিহার পুলিশের স্পেশ্যাল ভিজিল্যান্স ইউনিট (এসভিইউ) আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে এফআইআর দায়ের করেছিল দু’জনের বিরুদ্ধে। তদন্ত চলাকালীন গ্রেফতার হন সঞ্জীব এবং গুলাব।
এর পর গত ৩ ডিসেম্বর ১৩টি জায়গায় অভিযান চালিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি উদ্ধার করেন ইডি আধিকারিকেরা। সঞ্জীবের আর্থিক দুর্নীতির পর্দা আরও ফাঁস হয়।
ইডির বাজেয়াপ্ত সম্পত্তির মধ্যে ছিল সঞ্জীবের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর ডিম্যাট অ্যাকাউন্টও। ওই অ্যাকাউন্টে প্রায় ৬০ কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে বলে সূত্রের খবর।
এ ছাড়াও আর্থিক তছরুপের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৭০টিরও বেশি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং ১৮ কোটি টাকার রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগের নথিও বাজেয়াপ্ত করেছিলেন তদন্তকারী আধিকারিকেরা। পাশাপাশি, বিভিন্ন জায়গা থেকে নগদ মোট ১৬ লক্ষ এবং ২৩ লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয়।
তদন্তে দাবি করা হয়েছে, বিহার সরকারের বিভিন্ন উঁচু পদে থাকাকালীন নিজের পদের অপব্যবহার করেছিলেন সঞ্জীব। প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ উপায়ে কালো টাকার মালিক হয়ে ওঠেন। সেই কালো টাকা সাদা করার দায়িত্ব ছিল প্রাক্তন আরজেডি নেতা গুলাব এবং অন্য সহযোগীদের।
সূত্রের খবর, নগদ টাকার লেনদেনের হদিস যাতে না-পাওয়া যায়, তার জন্য ডিম্যাট অ্যাকাউন্টে অত টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল।
একটি ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত হিসাবে যা শুরু হয়েছিল তা শেষ হয় আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তে। সঞ্জীবের হাওয়ালা লেনদেন, বেহিসাবি সম্পত্তি এবং আর্থিক কেলেঙ্কারির পর্দা উন্মোচন করেন তদন্তকারীরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।