গুগ্ল হোক বা মাইক্রোসফ্ট। দুনিয়ার তাবড় প্রযুক্ত সংস্থায় এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) রমরমা। এহেন এআইয়ের তথ্যকেন্দ্রগুলিকে (ডেটা সেন্টার) সর্ব ক্ষণ সচল রাখতে গিয়ে এই সংস্থাগুলির রীতিমতো মাথার চুল ছেঁড়ার দশা। আর তাই পরমাণু শক্তির দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে তারা।
মাইক্রোসফ্ট ও গুগ্ল ইতিমধ্যেই আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে পরমাণু বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি সেরে ফেলেছে। একই পথে হেঁটেছে অ্যামাজ়নও। বিশ্বের বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলির দাবি, এতে যে অতিরিক্ত শক্তি মিলবে, তা অনলাইন তথ্যকেন্দ্রগুলিকে সচল রাখতে ব্যবহার করা হবে।
চলতি বছরের অক্টোবরে এই নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে গুগ্ল। সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, মোটা টাকার বিনিময়ে ‘কায়রস পাওয়ার’ নামের সংস্থা থেকে পরমাণু বিদ্যুৎ কেনা হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতিতে যা ব্যবহার করবে গুগ্ল। উল্লেখ্য, ছোট আকারের পরমাণু চুল্লি নির্মাণকারী আমেরিকান সংস্থাগুলির মধ্যে কায়রস পাওয়ার অন্যতম।
গুগ্লের শক্তি ও জলবায়ু দফতরের সিনিয়র ডিরেক্টর মাইকেল টেরেল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘আমাদের বিদ্যুৎ পরিবাহী গ্রিডের জন্য এই ধরনের পরিষ্কার ও নির্ভরযোগ্য শক্তির উৎসের প্রয়োজন। যা এআইয়ের মতো প্রযুক্তিকে আরও উন্নতমানের করে তুলতে সহায়ক হিসাবে কাজ করবে।’’
এ ব্যাপারে পরমাণু শক্তিই যে একমাত্র বিকল্প, তা কোনও রকম রাখঢাক না করেই স্পষ্ট করেছেন গুগ্লের সিনিয়র ডিরেক্টর। ‘‘আমরা মনে করি যে পরমাণু শক্তি আমাদের চাহিদা মেটানোর ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে যা সময়োপযোগী। তা ছাড়া এটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হাতে পাব আমরা।’’ বলেছেন মাইকেল টেরেল।
গুগ্ল জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে কায়রস পাওয়ারের থেকে প্রথম পারমাণবিক চুল্লি হাতে পাবে তারা। ২০৩৫ সাল নাগাদ যা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর জন্য প্রযুক্তি সংস্থাটি কত টাকার চুক্তি করেছে, তা অবশ্য জানা যায়নি।
কৃত্রিম মেধার জন্য পরমাণু শক্তির দিকে হাঁটার রাস্তায় থাকা প্রযুক্তি সংস্থাগুলির মধ্যে গুগ্লই কিন্তু প্রথম নয়। এ বছরের সেপ্টেম্বরে ‘কনস্টেলেশন’ নামের আমেরিকার আর এক বিদ্যুৎ সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সেরে ফেলেছে মাইক্রসফ্ট।
ওই চুক্তি অনুযায়ী পেনসিলভ্যানিয়ার থ্রি মাইল দ্বীপে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি বন্ধ থাকা চুল্লি নতুন করে চালু করবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। গত পাঁচ বছর ধরে যা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। চুল্লিটি চালু হলে সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ মাইক্রসফ্ট ব্যবহার করবে বলে জানা গিয়েছে।
আমেরিকার থ্রি মাইল দ্বীপটির ওই পরমাণু চুল্লির ইতিহাস মোটেই সুখকর নয়। ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ওই চুল্লি প্রায় গলে গিয়েছিল। সেখান থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণও শুরু হয়েছিল।
ওই সময়ে কারণ হিসাবে ভালভের ত্রুটির কথা বলেছিল আমেরিকার সরকার। যার জেরে চুল্লি ঠান্ডা করার জলের কুলার কাজ করা একরকম বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে, মাত্রাতিরিক্ত তাপে চুল্লির প্রায় গলে যেতে বসেছিল।
এই আবহে পরমাণু শক্তির জন্য ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছে অ্যামাজ়ন। ‘ডোমিনিয়ান এনার্জি’ নামের চুক্তি সেরে ফেলেছে এই অনলাইন ই-কমার্স সংস্থা। কায়রস পাওয়ারের মতো ডোমিনিয়ান এনার্জিও ছোট আকারের পরমাণু চুক্তি তৈরি করে থাকে।
বিশ্বের তাবড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে বর্তমান সময়ে শক্তির উৎস সন্ধানে নেমে প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। কারণ, প্রচলিত শক্তি (তাপ ও জলবিদ্যুৎ) ব্যবহার করলে কার্বণ নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। এগুলিকে জলবায়ু পরিবর্তনের মূল হোতা বলেও চিহ্নিত করা হয়।
অন্য দিকে শক্তির অফুরন্ত জোগান ছাড়া ‘ক্লাউড কম্পিউটিং’ ও ‘এআই অ্যাপ্লিকেশন’-কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন। বহু তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা গুগ্ল, মাইক্রসফ্ট ও অ্যামাজ়নের থেকে ‘গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিটস’-এ সজ্জিত সার্ভার ভাড়া নিয়ে থাকে। যা বেশ ব্যয়বহুল।
এই সার্ভারগুলি চালানোর জন্যেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ‘চ্যাটজ়িপিটি’-র মতো ওপেন এআইয়ের চাহিদা আমজনতার মধ্যে দিন দিন বাড়ছে। এই চাহিদা বৃদ্ধির পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলির উপর। সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা প্রবল ভাবে বেড়ে গিয়েছে।
আন্তর্জাতিক শক্তি সঙ্ঘের (ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি) সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, ডেটা সেন্টার, কৃত্রিম মেধা ও ক্রিপ্টোকারেন্সিকে সচল রাখতে ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ঘণ্টায় ৪৬০ টেরাওয়াট। ২০২৬ সালের মধ্যে যা দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ঘণ্টায় হাজার টেরাওয়াটে গিয়ে পৌঁছবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৩) এপ্রিলে এই সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিভারসাইডের সমীক্ষকেরা। তাতে বলা হয়েছে, চ্যাটজ়িপিটির প্রতি ১০ থেকে ৫০ প্রম্পটের জন্য ৫০০ মিলিলিটার জলের প্রয়োজন হয়। তবে কৃত্রিম মেধা কোথায় এবং কখন ব্যবহার করা হচ্ছে, তার উপর সেটা নির্ভর করবে। অর্থাৎ এটি চালাতে গেলে মোটের উপর ১৬ আউন্সের এক বোতল জল লাগবে।
ওপেন এআইয়ের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের অগস্ট পর্যন্ত চ্যাটবট় ও চ্যাটজিপিটির কাছে প্রতি সপ্তাহে ২০ কোটি ব্যবহারকারী তাঁদের নানা ধরনের প্রশ্ন জমা করেছেন। গত নভেম্বরে যা ছিল ১০ কোটি। অর্থাৎ মাত্র ন’মাসে ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই পরিসংখ্যান থেকেই এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, কৃত্রিম মেধা চালাতে গেলে কতটা জলের প্রয়োজন হবে। তা ছাড়া বিদ্যুৎ ছাড়া এটিকে ব্যবহার করা অসম্ভব। অন্য দিকে পরমাণু শক্তিও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। পরিবেশবিদদের একাংশ তাই এই ধরনের প্রযুক্তি সংস্থাগুলিতে এর সরবরাহের বিরোধিতা করেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে বিজ্ঞানীরা পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির উপর জোর দিচ্ছেন। পরমাণু শক্তিকে অবশ্য সেই তালিকায় রাখেননি তাঁরা। এ প্রসঙ্গে জলবায়ু সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ‘গ্রিনপিস’-এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘‘পরমাণু শক্তি অবিশ্বাস্য রকমের ব্যয়বহুল ও বিপজ্জনক। সেটা সকলকে মাথায় রাখতে হবে।’’
পরমাণু বিদ্যুৎকে ‘পরিষ্কার শক্তি’ হিসাবে মেনে নিতে আপত্তি রয়েছে গ্রিনপিসের। ‘‘এটা ঠিক যে পরমাণুর সাহায্যে বিদ্যুৎ তৈরি করলে, কার্বন ডাই অক্সাইড বা গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হল, এটা মোটাই পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির বিকল্প নয়।’’ নিজেদের ওয়েবসাইটে লিখেছে গ্রিনপিস।
যদি প্রযুক্তিক্ষেত্রের বড় সংস্থাগুলির দাবি, পরমাণু দিয়ে কার্বনমুক্ত বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়। আর তা ছাড়া এটি সৌর বা বায়ুচালিত পুনর্ব্যবহারযোগ্য বিদ্যুতের থেকে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।
সব ছবি: সংগৃহীত।