শুক্রবার গভীর রাতে প্রবল ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল মরক্কো। প্রাণ হারালেন অন্তত ৮০০ জন। পরিসংখ্যান দিয়েছে সে দেশেরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মাঝরাতে ঘরছাড়া হাজার হাজার মানুষ। সারা রাত কেটেছে রাস্তায়। চোখের সামনে পরিবারের ১০ জনকে হারিয়ে হতভম্ব এক নাগরিক। তাঁর মতোই হতভম্ব মরক্কোর হাজার হাজার মানুষ।
রিখটার স্কেলে ভূকম্পনের মাত্রা ছিল ৬.৮। আমেরিকার ভূতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্র পর্যটন শহর মারাকাশ থেকে ৭১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে হাই অ্যাটলাস পর্বতে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৮.৫ কিলোমিটার গভীরে রয়েছে সেই কেন্দ্র।
মরক্কোর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, সে দেশের স্থানীয় সময় রাত ১১টা ১১ মিনিটে ভূমিকম্প হয়। ১৯ মিনিট পর হয় আর একটি আফটারশক। সেই কম্পনের মাত্রা ছিল ৪.৯।
মরক্কোর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, মারাকাশ, আল-হাউজ়, ওয়ারজাজাতে, আজ়িলাল, তারুদান্ত এলাকা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সে সব এলকায় বহু মানুষ এখনও আটকে রয়েছেন ভগ্নস্তূপে। মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, অন্তত ৩২৯ জন আহত। তাঁদের মধ্যে ৫১ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাকাশের মেদিনা এলাকা। ১০৭০-৭২ সাল নাগাদ এর পত্তন হয়েছিল। এখানে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্তম্ভ, সৌধ, যা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই মেদিনাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা দিয়েছে ইউনেস্কো।
সরকারি একটি সূত্র বলছে, ধ্বংসস্তূপ সরানো হলে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে। বাড়তে পারে আহতের সংখ্যা। মরক্কো সরকার নাগরিকদের রক্তদানের আবেদন জানিয়েছে।
ভূমিকম্পের বেশ কিছু ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। আনন্দবাজার অনলাইন অবশ্য সেগুলির সত্যতা যাচাই করেনি। ওই ভিডিয়োগুলিতে শোনা যাচ্ছে মরক্কোবাসীর আর্তনাদ। বহু নাগরিক ভগ্নস্তূপের নীচে আটকে রয়েছেন। সেখান থেকে প্রাণরক্ষার জন্য চিৎকার করছেন।
একটি ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, মরক্কোর বহুতলগুলি কাঁপছে। ধুলো উড়ে চারদিক ঢেকে গিয়েছে। তার মধ্যে দিয়েই প্রাণভয়ে ছুটোছুটি করছেন বহু মানুষ। বাঁচতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন তাঁরা। খোলা জায়গায় পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন।
এক্স (সাবেক টুইটার)-এ একটি ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ছে একের পর এক বাড়ি, বহুতল। মরক্কোর কোথায় এ রকম হয়েছে, সংবাদমাধ্যম বিবিসি তা চিহ্নিত করতে পারেনি বলে জানিয়েছে।
আবদেলহাক এল আমরানি নামে এক নাগরিক জানিয়েছেন, শিশু থেকে বৃদ্ধ ভূমিকম্পের ধাক্কায় এখনও সন্ত্রস্ত। তিনি জানিয়েছেন, বহু সময় ধরে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই শহরে।
হুদা উতাস্সাফ নামে মারাকাশের এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘এখনও আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। মনে হচ্ছে সব দুলছে। পরিবারের ১০ জনকে হারিয়েছি।’’ দু’দিন আগে সকলে একসঙ্গে ছিলেন, এখন আর বিশ্বাসও হচ্ছে না হুদার।
কম্পনের কারণে মারাকাশ-সহ আশপাশের এলাকার রাস্তায় ফাটল দেখা দিয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বেশ কিছু এলাকা। ফলে উদ্ধারকাজ ব্যাহত। মোবাইলের টাওয়ার ভেঙে পড়ায়ে পরিষেবা ব্যাহত।
ভূমিকম্পের কেন্দ্র প্রত্যন্ত হাই অ্যাটলাস পর্বতে হলেও তার প্রভাব পড়েছে বহু দূর। ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত মারাকাশ শহর। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে রাজধানী রাবাতেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। কাসাব্লাঙ্কা, ইসাউইরা শহরেও কম্পন অনুভূত হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, ভূকম্পের কেন্দ্র যে হেতু প্রত্যন্ত এলাকায়, তাই দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হতে পারে। বেশ কিছু জায়গায় এখনও পৌঁছতেই পারেনি সরকারি দল। তাদের আশঙ্কা, মৃত্যু বাড়তে পারে।
মরক্কোর ভূমিকম্পে প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। জি২০ সম্মেলন শনিবার থেকে শুরু হয়েছে নয়াদিল্লিতে। তার মাঝেই তিনি এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘‘মরক্কোয় ভূমিকম্পের কারণে প্রাণহানির ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এই বিপদের সময়ে আমি মরক্কোর জনগণের পাশে আছি। যাঁরা তাঁদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁদের প্রতি সমবেদনা। আহতরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। ভারত এই কঠিন সময়ে মরক্কোকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত।’’
সমবেদনা জানিয়ে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেড্রো স্যাঞ্চেজ, ফরাসি প্রধানমন্ত্রী এমানুয়েল ম্যাকরঁ, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জও।
এর আগে মরক্কোয় শেষ বার বড়সড় ভূমিকম্প হয়েছিল ২০০৪ সালে। ভূকম্পনের মাত্রা ছিল ৬.৩। কেন্দ্র ছিল বন্দর শহর আল হোসেইমা।
মরক্কোর ইতিহাসে সব থেকে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছিল ১৯৬০ সালে। দেশের পশ্চিমের শহর আগাদিরে ছিল কেন্দ্র। সে সময় মারা গিয়েছিলেন অন্তত ১২ হাজার মানুষ।
ছবি: রয়টার্স