চলতি বছরের নভেম্বরে আমেরিকায় মহারণ। ভোটের ময়দানে মুখোমুখি লড়াইতে নামছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস। বিজয়ী প্রার্থী চার বছরের জন্য বসবেন পরমাণু শক্তিধর ‘সুপার পাওয়ার’ দেশটির প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে। তিনি যে এক রকম আটলান্টিকের পশ্চিম পারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হবেন, তা বলাই বাহুল্য।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছে গোটা বিশ্ব। বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা, এ বারের ভোট বিশ্ব রাজনীতির অনেক কিছুতে প্রভাব ফেলবে। যার মধ্যে রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইজ়রায়েল-হামাস-হিজ়বুল্লা-ইরান এবং চিন-তাইওয়ান সংঘাত।
এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প না হ্যারিস, কোন দেশ কাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায়, তা নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে জোর জল্পনা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের দাবি, এই ভোটের উপর সবচেয়ে বেশি নজর রেখেছে চিন। কারণ, গত কয়েক বছরে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বেজিংয়ের সম্পর্ক প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
এই ইস্যুতে ১৭ অক্টোবর মুখ খোলেন চিনের জাতীয় উপদেষ্টা সংস্থার এক বর্ষীয়ান সদস্য। কোনও রাখঢাক না করে তিনি বলেছেন, ‘‘সাদা-বাড়ির কুর্সিতে (পড়ুন হোয়াইট হাউস, যা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কার্যালয়) কমলা হ্যারিসকে দেখতে চায় বেজিং। কারণ, ট্রাম্পের আমলে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপের দিকে গিয়েছিল। যা সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।’’
আমেরিকার ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত কোনও মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। ফলে চিনের ইচ্ছাপূরণ হলে আলান্টিকের পারের দেশটিতে তৈরি হবে নয়া ইতিহাস। ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা বর্তমানে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে মনোনয়ন জমা করেছেন তিনি। অন্য দিকে, রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ট্রাম্প ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
চিনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) জাতীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য জিয়া কিংগুও অবশ্য প্রকাশ্যে আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘এতে মনে হতে পারে যে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে বেজিং। সেই অভিযোগ আমরা কোনও ভাবেই গায়ে মাখতে চাই না।’’ তবে চিন যে হ্যারিসকেই হোয়াইট হাউসে চাইছে, সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি।
চিনের রাজনীতিতে এই জাতীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর গুরুত্ব অপরিসীম। একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে এটি। অনেকেরই ধারণা, জাতীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সিদ্ধান্ত পায়ে ঠেলার ক্ষমতা নেই স্বয়ং প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়েরও। ফলে আমেরিকার নির্বাচনে হ্যারিসকে জেতাতে পিছন থেকে বেজিং কলকাঠি নাড়তে পারে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
এই ব্রিটিশ সংবাদসংস্থা ‘বিবিসি’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিয়া বলেছেন, ‘‘ট্রাম্প ও হ্যারিসকে নিয়ে চিনের আমজনতা দ্বিধা বিভক্ত। আমি কিন্তু সব সময়ে কমলাকেই বেছে নেব। কারণ, ট্রাম্প জমানায় বেজিং-ওয়াশিংটনের সম্পর্ক তো আর খুব মধুর ছিল না। আমরা আরও এক বার তার স্বাদ পেতে চাই না।’’
চিনা জাতীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর স্থায়ী কমিটির ওই সদস্য আরও জানিয়েছেন, ট্রাম্পের সময় থেকে দুই দেশের সম্পর্ক যে ভাবে খাদের দিকে গিয়েছে, তার আর উন্নতি হয়নি। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকেছেন হ্যারিস। ক্ষমতায় গেলে তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করার দিকে নজর দেবেন বলে মনে করে বেজিং।
‘‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ছিলেন আবেগপ্রবণ মানুষ। চিন সম্পর্কে অনেক বাজে তথ্য ছড়িয়েছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, ট্রাম্প ছিলেন স্বৈরাচারী। ফলে মিথ্যা তথ্য ছড়াতে সুবিধা হয়েছিল তাঁর।’’ বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন চিনা রাজনীতিবিদ জিয়া কিংগুও।
তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আমলে যে সব কিছু ঠিক করা গিয়েছে, এমনটা নয়। চিনের জাতীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যের কথায়, ‘‘বর্তমান আমেরিকার প্রশাসনকে নিয়েও আমাদের সমস্যা রয়েছে। ট্রাম্প বেজিংয়ের বিরুদ্ধে যে সমস্ত কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে তা পেয়েছেন বাইডেন। ফলে আদর্শগত দিক থেকে একেবারে উল্টো রাস্তায় তিনি যে হাঁটতে পারবেন না, তা সকলেরই জানা ছিল।’’
কিন্তু, তা সত্ত্বেও বাইডেনের আমলে বেজিং-ওয়াশিংটনের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে বলে মনে করছে চিন। ‘‘গত চার বছরে আমাদের নিয়ে আমেরিকার নীতি অনেক বেশি স্থিতিশীল ও অনুমানযোগ্য হয়েছে। আমরা ফের একে অপরের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছি। নানা বিষয়ে জড়িত হচ্ছি। আধিকারিক পর্যায়ে বৈঠক হচ্ছে। যা অত্যন্ত ইতিবাচক।’’ বলেছেন চিনা জাতীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য জিয়া।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ চিন সাগর ও তাইওয়ানের উপর দীর্ঘ দিন ধরেই অন্যায্য দাবি জানিয়ে আসছে চিন। যা নিয়ে সরাসরি বেজিংকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে ওয়াশিংটন। পাশাপাশি, বৈদ্যুতিন গাড়ি রফতানির ক্ষেত্রেও চিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় আমেরিকা। এ হেন সংঘাতের পরিস্থিতি সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট শি-র সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। যা উত্তেজনা কমানোর হাতিয়ার বলে মনে করছে ওয়াশিংটন।
২০১৯ সালে চিনা শহর উহান থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে নোভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯। যার সবচেয়ে বড় আঘাত সইতে হয়েছিল আমেরিকাকে। ওই সময়ে ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। যা সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এর পরই বেজিংয়ের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক লড়াইতে নামেন তিনি। দুই দেশের মধ্যে শুরু হয় শুল্ক যুদ্ধ।
ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল, বিশ্বব্যাপী কোভিড অতিমারীর জন্য পুরোপুরি দায়ী চিন। কারণ, উহানের একটি বায়ো-গবেষণাগার থেকে আমজনতার মধ্যে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস। ট্রাম্পের এই অভিযোগকে উড়িয়ে দিতে পাল্টা মিথ্যা প্রচার শুরু করে বেজিং। যা টানা কয়েক মাস ধরে চলেছিল।
এর পরই আমেরিকায় চিনা পণ্যের আমদানি বন্ধ করতে তৎপর হন ট্রাম্প। বেজিং থেকে আসা যাবতীয় সামগ্রীর উপর মোটা অঙ্কের শুল্ক চাপান তিনি। পাশাপাশি, চিনকে আমেরিকান পণ্য ব্যবহারে বাধ্য করার চেষ্টা করেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। চিনা পণ্যের এই শুল্ক নীতি অব্যাহত রেখেছে বাইডেন প্রশাসন। তবে গত বছর (পড়ুন ২০২৩) চিনে পণ্য রফতানির পরিমাণ বাড়াতে পেরেছে ওয়াশিংটন।
নির্বাচনী প্রচারে চিনা পণ্যের উপর ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন ট্রাম্প। যা বেজিংয়ের সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার কারণ। এতে চিনা অর্থনীতির মারাত্মক চাপে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্য দিকে আমেরিকার বাজারে ঢোকার সুযোগ পাবে ভারত-সহ পশ্চিম এশিয়ার একাধিক দেশ।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের আবার দাবি, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য করায় পুরোপুরি জারি হবে নিষেধাজ্ঞা। উল্টে দক্ষিণ চিন সাগর ও তাইওয়ানকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওয়াশিংটন। যা বেজিংয়ের সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ বলে মনে করেন তাঁরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।