যত দূর চোখ যায়, কোথাও জলের চিহ্নমাত্র নেই। সেই শুষ্ক জমিতেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে আস্ত একটা বন্দর! যা আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া পূর্ব ভারতের অন্যতম রাজ্যটির ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে চলেছে বলে মনে করছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
সমুদ্র বা নদীর থেকে শত যোজন দূরে স্থল পরিবৃত এই ধরনের বন্দরকে অর্থনীতির পরিভাষায় বলা হয় ‘অভ্যন্তরীণ কন্টেনার ডিপো’ (ইনল্যান্ড কন্টেনার ডিপো বা আইসিডি)। তবে ‘শুষ্ক বন্দর’ বা ড্রাই পোর্ট নামেই এগুলি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
চলতি বছরের ২১ অক্টোবর তেমনই একটি শুষ্ক বন্দরের উদ্বোধন করেন বিহারের শিল্পমন্ত্রী নীতীশ মিশ্র। রাজধানী পটনার পশ্চিমে বিহতা এলাকায় যা গড়ে উঠেছে। বৌদ্ধ সংস্কৃতির চারণভূমিতে এই প্রথম কোনও আইসিডি নির্মাণ করল সেখানকার সরকার।
বিহারের সংযুক্ত জনতা দল (জেডি-ইউ) ও বিজেপি জোট সরকারের দাবি, রফতানির বাজারে জোয়ার আনবে এই শুষ্ক বন্দর। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে যা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিহতার আইসিডির মূল নিয়ন্ত্রণ থাকবে বিহারের শিল্প দফতরের হাতে। পিপিপি মডেলে (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) এটি পরিচালনা দায়িত্ব পেয়েছে ‘প্রিস্টেইন মগধ ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রাইভেট লিমিটেড’। সাত একর জমির উপর নির্মিত হয়েছে এই শুষ্ক বন্দর।
সমুদ্র বা বিমানবন্দর থেকে বহু দূরে স্থলভাগের মধ্যে থাকা এই আইসিডিকে মূলত পণ্য আমদানি ও রফতানির সহায়ক স্থান হিসাবে ব্যবহার করবে বিহার সরকার। এখানে বিপুল সামগ্রী মজুত রাখার সুব্যবস্থা রয়েছে।
শুষ্ক বন্দরের দ্বিতীয় সুবিধা হল, এর মধ্যেই থাকে শুল্ক দফতরের কার্যালয়। ফলে সহজেই মেলে পণ্য আমদানি ও রফতারির ছাড়পত্র। সমুদ্র বা বিমানবন্দরে পণ্য পৌঁছনোর পর নতুন করে সেই কাজ করার দরকার পড়বে না। যা অনেকটা সময় বাঁচাবে।
আর্থিক বিশ্লেষকদের কথায়, বিহারের মতো স্থলভাগ দিয়ে ঘেরা রাজ্যের এই ধরনের একটি শুষ্ক বন্দরের খুব প্রয়োজন ছিল। এটিকে কাজে লাগিয়ে কৃষিজাত, বস্ত্র ও চর্মশিল্পের বিভিন্ন সামগ্রী এ বার অনায়াসেই বিদেশের বাজারে পাঠাতে পারবে মৈথিলীভাষীদের ওই রাজ্য।
তা ছাড়া রফতানি পণ্য মজুতের সমস্যায় দীর্ঘ দিন ধরেই ভুগছে বিহার। ফলে ইচ্ছা থাকলেও বহু সামগ্রী বিদেশের বাজারে পাঠাতে পারেন না সেখানকার ব্যবসায়ীরা। বিহতার শুষ্ক বন্দর সেই সমস্যা অনেকটাই মেটাবে বলে দাবি করেছে নীতীশ সরকার।
ফল ও শাকসব্জি উৎপাদনকারী রাজ্যগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে নাম রয়েছে বিহারের। নীতীশের রাজ্যে আলু, টম্যাটো, কলা, লিচু ও মাখানা ফলন যথেষ্ট ভাল। এ ছাড়া ভুট্টা রফতানির ক্ষমতা রয়েছে বিহারের। কারণ এর ৩৮টির মধ্যে ১১টি জেলায় বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হয় ভুট্টা।
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে স্পঞ্জ আয়রন, প্যাকেটজাত খাবার, বর্জ্য কাগজ, সংবাদপত্র ছাপানোর কাগজ, চাল এবং মাংস রফতানির সুযোগ রয়েছে বিহারের। বিশেষজ্ঞদের অবশ্য অনুমান, প্রাথমিক ভাবে বিদেশে ভুট্টা পাঠানোর দিকে বেশি নজর দেবে জেডিএস-বিজেপি সরকার।
মূলত উত্তর বিহারের খাগরিয়া, বেগুসরাই, সহরসা ও পূর্ণিয়া জেলায় ভুট্টা উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। তবে সম্প্রতি মুজফ্ফরপুর, পূর্ব চম্পারন এবং পশ্চিম চম্পারনে বেশ কয়েকটি চামড়া ও পোশাক ইউনিট খুলেছে সেখানকার রাজ্য সরকার।
বিহারের ফলের উৎপাদন যথেষ্ট বেশি। আর তাই খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে বিপুল রপ্তানি সম্ভাবনা রয়েছে। বৈশালী, নালন্দা, পটনা এবং বেগুসরাইয়ে রয়েছে এর কারখানা। শুষ্ক বন্দর খোলায় তাঁরাও উপকৃত হবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
এই বিষয়ে বলতে গিয়ে রাজ্যের চর্ম ও বস্ত্র শিল্পের প্রসঙ্গ টেনেছেন বিহারের শিল্পমন্ত্রী নীতীশ মিশ্র। তাঁর কথায়, ‘‘সম্প্রতি অন্তত ছ’জন বিনিয়োগকারী এখানে চামড়ার কারখানা খুলেছেন। আমাদের রাজ্যের চর্ম ও বস্ত্র শিল্পের পণ্য রফতানির বিপুল সুযোগ রয়েছে।’’
শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারীদের টানতে ‘জমির ব্যাঙ্ক’ বাড়ানো হচ্ছে বলে স্পষ্ট করেছে বিহার সরকার। রাজ্যের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ২০ হাজার কোটি টাকার সামগ্রী বিদেশে পাঠানো গিয়েছে। আইসিডি নির্মাণে যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের রাজস্ব দফতরের পূর্ণ অনুমতি পেয়েছে বিহতার শুষ্ক বন্দর। বাংলার কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের সঙ্গে রেলপথে এটিকে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া রেলের মাধ্যমে ওই আইসিডি যুক্ত রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম, মহারাষ্ট্রের নাভা শেভা এবং গুজরাটের মুন্দ্রা বন্দরের সঙ্গে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, আগামী দিনে প্রতিবেশী রাজ্যগুলির পণ্য রফতানিতে বড় ভূমিকা নেবে বিহারের এই শুষ্ক বন্দর। সেই তালিকায় রয়েছে ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও উত্তরপ্রদেশের নাম।
বিহারের এই আইসিডি থেকে সর্বপ্রথম রাশিয়ায় পণ্য রফতানি করা হয়েছে। শিল্পমন্ত্রী নীতীশ মিশ্র বলেছেন, ‘‘কন্টেনারে ভর্তি করে বাদামি ভালুকের দেশে জুতো পাঠিয়েছি আমরা।’’
সব ছবি: সংগৃহীত ও প্রতিনিধিত্বমূলক।