চেহারায় একেবারে ছোটখাটো। সাধ্যের মধ্যে মধ্যবিত্তের হাতে গাড়ি তুলে দেওয়ার লক্ষ্যেই তার আবির্ভাব হয়েছিল। তবে জন্মলগ্ন থেকেই তাকে তাড়া করেছে বিতর্ক। রাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণে তার জন্মস্থানেরও পরিবর্তন হয়েছিল। জন্মের পর তেমন সফল হতে পারেনি। ইদানীং, রাস্তায় খুব একটা চলাফেরা করে না সে। তার নাম টাটা ন্যানো।
টাটা গোষ্ঠীর সাধের ছিল গাড়ি এই ন্যানো। শিল্পপতি রতন টাটার ‘স্বপ্নের গাড়ি’তে পরিণত হয় সেটি। এক দশকেরও বেশি সময় আগে দেশে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল এই চারচাকা। ‘এক লাখি’ গাড়ি হিসাবে বাজারে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ন্যানোর।
টাটাদের লক্ষ্য ছিল মধ্যবিত্তের পকেট সহায়ক গাড়ি তৈরির। কিন্তু, সেই লক্ষ্যপূরণ করতে গিয়ে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয় টাটাদের।
২০০৩ সালে সাশ্রয়ী মূল্যে মধ্যবিত্তের হাতে গাড়ি তুলে দেওয়ার সাহসী স্বপ্ন দেখেছিলেন টাটা গোষ্ঠীর সদ্যপ্রয়াত প্রাক্তন চেয়ারম্যান রতন টাটা। আর রতন টাটার সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই জন্ম টাটা ন্যানোর।
কিন্তু কেন এই গাড়ি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রতন টাটা? কোথা থেকে সেই অনুপ্রেরণা পান তিনি?
২০০০ দশকের গোড়ার দিকে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্কক গিয়েছিলেন ভারতীয় শিল্পপতি। সেখানে গিয়ে স্থানীয় পরিবারগুলিকে তাদের সন্তানদের কোলে বসিয়ে স্কুটার চালাতে দেখেন তিনি।
এই দেখে ভারতীয় মধ্যবিত্তের জন্য একটি ছোট, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং নিরাপদ গাড়ি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
দীর্ঘ গবেষণা এবং প্রচেষ্টার পর টাটা মোটরস এমন একটি গাড়ি তৈরি করে যা নিরাপদ। এই গাড়ি কম দামে বিক্রি করা সম্ভব বলেও দাবি করা হয় সংস্থার তরফে।
ওই গাড়িতে চার জন আরাম করে যাতায়াত করতে পারবেন বলেও দাবি করা হয়। এ-ও দাবি করা হয় যে, এই গাড়িতে জ্বালানি কম পুড়বে। গাড়ির নাম দেওয়া হয় ‘ন্যানো’। যার অর্থ ‘ছোট’।
কয়েক বছরের অপেক্ষার পরে নয়াদিল্লির একটি অটো এক্সপোয় জনসমক্ষে আনা হয় ন্যানোকে।
সংস্থার তরফে জানানো হয়, ন্যানোর দাম এক লক্ষ টাকার আশপাশে রাখা হবে। কম দাম এবং নকশার কারণে বিশ্বব্যাপী খবরের শিরোনামে উঠে আসে সেই গাড়ি। রাতারাতি ‘একলাখি গাড়ি’র তকমাও পেয়ে যায়।
মানুষের মধ্যে ন্যানো নিয়ে উত্তেজনা দেখে শুধুমাত্র ভারতে নয়, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও সেই গাড়ি বিক্রি করা হবে বলে পরিকল্পনা করে টাটা গোষ্ঠী।
এর পরেই শুরু হয় জমির খোঁজ। কোথায় ন্যানোর কারখানা খোলা হবে তা নিয়ে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা চলে। ঠিক হয় ন্যানোর কারখানা গড়া হবে বাংলায়।
২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসে হুগলি জেলার সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই মতো রাজ্য সরকার সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করে। কিন্তু, অনেকেই জমি দিতে অস্বীকার করেন।
সেই অনিচ্ছুক চাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলনে নামে সেই সময়কার বিরোধী দল তৃণমূল। ধারাবাহিক সেই আন্দোলনের জেরে অনেক টানাপড়েনের পর টাটা গোষ্ঠী এ রাজ্য থেকে তাদের ন্যানো প্রকল্প তুলে নেয়। ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর ন্যানো প্রকল্প সিঙ্গুর থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন রতন টাটা।
রাজনৈতিক গোলমালের জেরে সিঙ্গুর থেকে গুজরাতের সানন্দে সরেছিল ন্যানো কারখানা। ২০০৮ সালে শুরু হয়েছিল ন্যানোর যাত্রা।
অবশেষে ২০০৯ সালে বাজারে বিক্রির জন্য তৈরি হয়ে যায় টাটা ন্যানো। কম দাম এবং গাড়ির বৈশিষ্ট্য বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করে।
প্রথম প্রথম ‘একলাখি গাড়ি’ বুকিংয়ের হিড়িক পড়ে মানুষের মধ্যে। হাজার হাজার মানুষ এই গাড়ি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে যেমনটা ভাবা হয়েছিল, তেমনটা ঘটেনি। তেমন লাভজনক হয়নি ন্যানোর ব্যবসা। বিক্রির পরে ভারতীয় গাড়িবাজারে তেমন জনপ্রিয়ও হয়ে উঠতে পারেনি এই গাড়ি। গাড়ি সংক্রান্ত অভিযোগও উঠতে থাকে।
এত কম দামে চারচাকার গাড়ি ভারতের বাজারে আগে আসেনি। তবে সাফল্য না পাওয়ায় ধীরে ধীরে মন্দার মুখে পড়েছিল ন্যানোর ব্যবসা। ২০১৮ সালে শেষ বার উৎপাদন হয়েছিল এই গাড়ির। তার পর থেকে ন্যানোর যাত্রাপথ থমকে গিয়েছে। রাস্তায় তাই আজকাল খুব একটা দেখাও পাওয়া যায় না এই গাড়ির।
তবে সেই সব চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ২০১৮ সালের মধ্যে প্রায় তিন লক্ষ ন্যানো বিক্রি করে ফেলে টাটা মোটরস।
বাণিজ্যিক সমস্যার সম্মুখীন হলেও ভারতের বুকে উদ্ভাবনের প্রতীক হিসাবে রয়ে গিয়েছে টাটা ন্যানো। গত বছরে জল্পনা উঠেছিল যে ভোল বদলে ফিরতে পারে টাটা ন্যানো! এই খবর চাউর হতেই গাড়িপ্রেমীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল। এমনটাও শোনা গিয়েছিল যে, ইলেক্ট্রিক গাড়ি হিসাবেও ন্যানোর প্রত্যাবর্তন ঘটাতে পারে টাটা মোটরস। তবে সংস্থার তরফে এখনও এই বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
সব ছবি: সংগৃহীত।