মারা গেলেন হামাস গোষ্ঠীর নতুন প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ইজ়রায়েলের বিদেশমন্ত্রী কাট্জ়ের দাবি, গাজ়ায় ইজ়রায়েলি সেনার এক অভিযানে মৃত্যু হয়েছে সিনওয়ারের। উল্লেখ্য, মাস কয়েক আগেই নিহত হয়েছিলেন পূর্বতন হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া।
বৃহস্পতিবারই ইজ়রায়েলের সেনা হামলা চালিয়েছিল গাজ়ার একটি ভবনে। ওই ভবনে তিন জনের মৃত্যু হয়েছিল বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছিল। তখন থেকেই ইজ়রায়েলের দাবি ছিল, মৃতদের মধ্যে হামাস প্রধান থাকতে পারেন।
তিন জনের দেহ ইজ়রায়েলে নিয়ে আসা হয়েছিল ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। শেষে ইজ়রায়েলের বিদেশমন্ত্রী কাট্জ় এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, সেনা অভিযানে নিহত হয়েছেন সিনওয়ার।
প্রসঙ্গত, এর আগে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে জল্পনা তৈরি হয়েছিল যে, গাজ়া শহরের একটি স্কুলে রকেট হামলার পর মৃত্যু হয়েছিল সিনওয়ারের। তবে বিষয়টি ইজ়রায়েল তখন নিশ্চিত করতে পারেনি।
কিন্তু এ বার সিনওয়ারের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে ইজ়রায়েল। এর পর থেকেই প্রশ্ন উঠছে কে এই সিনওয়ার? কেনই বা তাঁকে নেতা হিসাবে বেছে নিয়েছিল প্যালেস্টাইনি সশস্ত্র গোষ্ঠী।
ইজ়রায়েল-হামাস চলতি সংঘাতের জন্য নাকি দায়ী ছিলেন সিনওয়ারই। হামাসের হয়ে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে অতর্কিতে হামলা চালানোর নেপথ্যে নাকি তাঁরই মাথা ছিল।
৬১ বছর বয়সে সিনওয়ারের মৃত্যু হয়েছে। তবে তাঁর জীবনের ২৪টি বছরই কেটেছিল ইজ়রায়েলের জেলে। সিনওয়ারকে আগেই ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসাবে ঘোষণা করেছিল আমেরিকা।
দক্ষিণ গাজ়ার খান ইউনিসে জন্ম সিনওয়ারের। হামাসের মৃত প্রধান পরিচিত ছিলেন ‘খান ইউনিসের কসাই’ নামে। ইজ়রায়েলের তরফে তাঁকে ‘প্যালেস্তাইনের ওসামা বিন লাদেন’ নাম দেওয়া হয়।
একাধিক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ধাপে ধাপে প্যালেস্তানীয় সশস্ত্র সংগঠন হামাসের শীর্ষ স্তরে পৌঁছেছিলেন সিনওয়ার। ২০১৭ সালে হামাস অধিকৃত গাজ়া ভূখণ্ডের সর্বোচ্চ শাসকও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
১৯৬২ সালে দক্ষিণ গাজ়ার খান ইউনিসে জন্ম সিনওয়ারের। দক্ষিণ গাজ়া তখন মিশরের অধীন। তাঁর এই জন্মস্থানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেই ইজ়রায়েলি সেনা সিনওয়ারকে ‘খান ইউনিসের কসাই’ বলে কটাক্ষ করে থাকে।
সিনওয়ার-ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ বলে থাকেন, তাঁর পরিবার নাকি আগে বসবাস করত আল মাজদল শহরে। ১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর এই শহর প্যালেস্টাইনের হাতছাড়া হয়। শহরটির নাম বদল করে রাখা হয় অ্যাশকেলন।
অনেকেই মনে করেন, সিনওয়ারের পারিবারিক ইতিহাসের মধ্যেই ইজ়রায়েল-বিরোধিতার বীজ লুকিয়ে ছিল। সিনওয়ার তাঁর কাজকর্মের মাধ্যমে সেই বীজকে কার্যত মহীরুহে পরিণত করেছিলেন।
সিনওয়ার স্নাতক। গাজ়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যারাবিক স্টাডিজ় নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। ছাত্রজীবনেই ইজ়রায়েল-বিরোধী একাধিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। তখন থেকেই নাকি ইজ়রায়েলকে ‘ধূলোয় মিশিয়ে দিতে’ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন।
হামাসে যোগ দেওয়ার আগে ইয়াহিয়া বেশ কয়েক বছর জেলবন্দি ছিলেন। হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে ১৯৮২ সালে প্রথম গ্রেফতার হন সিনওয়ার। তার পর একাধিক বার দফায় দফায় গ্রেফতার হন। থাকতেন ইজ়রায়েলি কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে।
১৯৮৭ সালে একটি গোষ্ঠী হিসাবে হামাস আত্মপ্রকাশ করার পর নিজের সংগঠনকে তার সঙ্গে মিশিয়ে দেন সিনওয়ার। তিনি হামাসে যোগ দেওয়ার পর ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালানোর ঘটনা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আশির দশক থেকেই হামাসের আর এক নেতা সালাহ্ শেহাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইজ়রায়েলি গুপ্তচরদের উপর হামলা চালাতে থাকেন সিনওয়ার।
একাধিক বার গ্রেফতার করেও সিনওয়ারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ইজ়রায়েলি প্রশাসন। বরং তাঁর কাজে বার বার বিপাকে পড়তে হয়েছিল তুলনায় সামরিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত ইজ়রায়েলকে।
১৯৮৮ সালে দু’জন ইজ়রায়েলি সেনাকে হত্যার ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন সিনওয়ার। সেই সঙ্গে চার জন প্যালেস্টাইনি ব্যক্তি ইজ়রায়েলিদের হয়ে কাজ করছেন, এমন অভিযোগে খুন হয়ে যান। এই হত্যাকাণ্ডেও নাম জড়িয়েছিল সিনওয়ারের।
২০০৬ সালে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ইজ়রায়েলে ঢুকেছিল হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জাদ-দিন আল-কাসাম। ইহুদি-প্রধান দেশটিতে ঢুকে তারা দুই ইজ়রায়েলি সেনাকে হত্যা করে, এক জনকে পণবন্দি করেছিল।
পণবন্দি সেনার মুক্তির বিনিময়ে সিনওয়ারকে ছাড়তে বাধ্য হয় ইজ়রায়েল। শুধু সিনওয়ার নয়, আরও বেশ কয়েক জনকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল তেল আভিভ প্রশাসন।
সেই সময় ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন সিনওয়ার। ২০০৮ সালে তিনি মস্তিষ্কের ক্যানসার থেকে সেরে ওঠেন।
২০১১ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে হামাসের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সিনওয়ার। হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া স্বেচ্ছানির্বাসনে যাওয়ার পর থেকে সিনওয়ারই হয়ে উঠেছিলেন হামাসের অলিখিত প্রধান।
সিনওয়ার পরিচিত ছিলেন তাঁর অনমনীয় নীতির জন্যই। ইজ়রায়েল নিয়ে কোনও আপসে যেতে রাজি ছিলেন না তিনি। বরং একাধিক সভায় গরম গরম বক্তৃতা করে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনিদের একজোট করার অভিযোগ বার বার উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে।
তবে হামাসের অন্দরেও সিনওয়ারকে নিয়ে বিতর্ক দেখা গিয়েছিল। হামাস কম্যান্ডার মাহমুদ ইশতিইয়ের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। এর পরে ২০১৫ সালে খুন হয়ে যান মাহমুদ।
অভিযোগ ওঠে যে, হামাসের ঘোষিত নীতির সঙ্গে আপস করবেন না বলে মাহমুদকে মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন সিনওয়ারই।
গত বছরের ৭ অক্টোবর অতর্কিতে ইজ়রায়েলের উপরে হামলা চালায় হামাস বাহিনী। মৃত্যু হয় ১৩০০ ইজ়রায়েলির। ইজ়রায়েলের দাবি অনুসারে, হলোকাস্টের পর থেকে ইহুদিদের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক দিন ছিল ৭ অক্টোবরই। ইজ়রায়েলের বিখ্যাত গুপ্তচর সংস্থাগুলি কেন এই হামলার আগাম খবর পেল না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
ইজ়রায়েলি সেনার দাবি, এই হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন সিনওয়ার। তখন থেকেই সিনওয়ার এবং তাঁর সহযোগীরা ইজ়রায়েলি সেনার নজরে ছিলেন। সিনওয়ারকে যে ইজ়রায়েল ‘উপযুক্ত শিক্ষা’ দিতে চায়, তা-ও অনেক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিল ইজ়রায়েলি সেনা।
তবে ইজ়রায়েলের সঙ্গে হামাসের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই গাজ়ায় আত্মগোপন করে ছিলেন সিনওয়ার। গত ৩১ জুলাই ইরানের রাজধানী তেহরানে খুন হন প্যালেস্টাইনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সর্বেসর্বা হানিয়া। তার পর থেকেই হামাসের দায়িত্ব গিয়ে পড়ে সিনওয়ারের কাঁধে।
সেই সিনওয়ারকে অনেক দিন ধরেই তন্ন তন্ন করে খুঁজছিল ইজ়রায়েলি সেনা। বৃহস্পতিবারই ইজ়রায়েলের সেনার হামলায় গাজ়ার একটি ভবনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে খবর। নিশ্চিত করেছেন ইজ়রায়েলি বিদেশমন্ত্রী।
সব ছবি: সংগৃহীত।