ইরানে আরও তীব্র হচ্ছে হিজাব-বিরোধী আন্দোলন। সে দেশের কড়া পোশাকবিধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শুধু অন্তর্বাস পরে ঘোরায় গ্রেফতার হয়েছেন সে দেশের এক তরুণী।
শনিবারের সেই ঘটনায় ইরান-সহ সারা বিশ্বে হইচই পড়েছে। তরুণীর গ্রেফতারির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ শুরু হয়ে গিয়েছে। তরুণীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি উঠছে। পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে রাষ্ট্রপুঞ্জও।
তরুণীকে গ্রেফতারের সময়ে মারধর এবং তাঁর উপর যৌন হেনস্থার কিছু অভিযোগও উঠে এসেছে। সেই অভিযোগগুলিরও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি উঠেছে। ইরানে আন্তর্জাতিক অসরকারি সংস্থা অ্যামনেস্টি ইতিমধ্যে বিবৃতি দিয়ে তরুণীর মুক্তির দাবি জানিয়েছে। সেই সঙ্গে পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন তরুণীর উপর যাতে কোনও রকম অত্যাচার না হয়, তা-ও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
তবে এই প্রথম নয়, গত তিন বছরে ছোটখাটো একাধিক ঘটনার পাশাপাশি হিজাব বিরোধিতা সংক্রান্ত তিনটি বড় ঘটনা নাড়া দিয়েছে বিশ্বকে। হিজাব-বিরোধী আন্দোলনে ইরান দেখেছে শাসকের কড়া দমননীতিও।
ঠিকমতো হিজাব না পরার ‘অপরাধে’ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেফতার হন কুর্দ তরুণী মাহসা আমিনি। পুলিশি হেফাজতে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছিল। যে কাণ্ডের পর ইরানের নানা শহর ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল হিজাব-বিরোধী আন্দোলন।
পশ্চিম ইরানের কুর্দিস্তান প্রদেশের সাক্কেজ শহরের বাসিন্দা ছিলেন মাহসা। ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার কুর্দিস্তান থেকে রাজধানী তেহরানে আসছিলেন তিনি। তেহরানে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মাহশা দেখা করতে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ভাই কিয়ারেশ আমিনিও।
কিয়ারেশ এবং মাহশা হাইওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় তেহরানের কিছু আগে তাঁদের পথ আটকায় টহলে থাকা পুলিশের দল। কিয়ারেশ-মাহশাকে গাড়ির কাচ নামানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
পুলিশের নজরে পড়েন গাড়ির ভিতরে হিজাব না পরে বসে থাকা মাহশা। যেখানে দেশের সর্বোচ্চ নেতা বাড়ির বাইরে গেলে মহিলাদের হিজাব পরার নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে এই তরুণী কী ভাবে হিজাব না পরে বেরিয়েছেন? গর্জে ওঠে পুলিশের দল। শুরু হয় আইনরক্ষকের ‘নীতিপুলিশি’।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাড়ির ভিতরে বসে থাকা ভাইবোনের উপর হম্বিতম্বি শুরু করে দেয় পুলিশ। মাহশা হিজাব কেন পরেননি? বার বার করা হয় একই প্রশ্ন। মাহশার ‘দোষ’, তিনি প্রশ্নের জবাবে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন তাঁর ইচ্ছার কথা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, এর পরই রেগে আগুন হয় পুলিশের দল। হিজাব না পরার ‘শাস্তি’ হিসাবে গাড়ি থেকে হিড়হিড় করে টেনে নামানো হয় মাহশাকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিজেদের গাড়িতে তোলে পুলিশ। ভাই কিয়ারেশকে পুলিশ জানায়, মাহশাকে ‘সহবত’ শেখাতে কিছু সময়ের জন্য আটকে রাখা হবে। কিছু ক্ষণ পরেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
ছাড়া পেয়েছিলেন মাহশা। তবে ছাড়া পেয়ে বাড়ি যাওয়ার পরিবর্তে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় তাঁকে। হাসপাতালে তিন দিন কোমায় থাকার পর তিনি মারা যান।
হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, ‘ব্রেন ডেড’ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল মাহশাকে। হৃৎস্পন্দন থাকলেও নড়াচড়ার ক্ষমতা ছিল না। তাঁকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। এর ৪৮ ঘণ্টা পর মাহশা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
মাহশার মৃত্যুর পরেই সরকার-বিরোধী বিক্ষোভের আগুনে পুড়তে শুরু করেছিল ইরানের রাজধানী তেহরান-সহ কমপক্ষে ৮০টি শহর। মানবাধিকার এবং মৌলিক অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন সে দেশের বহু মানুষ। শুরু হয় হিজাব-বিরোধী আন্দোলন। প্রকাশ্যে হিজাব পুড়িয়ে, মাথার চুল কেটে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ইরানের মেয়েরা। সেই আন্দোলন ইরানের নানা শহর ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল।
তবে ইরানের সরকারও সেই আন্দোলন কড়া হাতে দমন করেছিল। বেশ কয়েক জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত এক আন্দোলনকারীকে প্রকাশ্য ক্রেন থেকে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। এর পর আন্দোলনের তীব্রতা খানিকটা কমে। তবে একেবারে প্রশমিত হয়নি।
এর পর আবার গত বছরের অক্টোবরে হিজাবহীন হওয়ার ‘অপরাধে’ আরও এক ইরানীয় কিশোরীকে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ ওঠার পর ধিক ধিক করে জ্বলতে থাকা হিজাব-বিরোধী আন্দোলনের আগুনে ঘি পড়ে।
অভিযোগ, ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর তেহরানের একটি মেট্রো স্টেশনে মারধরের সময় ওই তরুণীর মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করা হয়। যার জেরে কোমায় চলে যান তিনি। যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করে প্রশাসন।
এই ঘটনায় ইরানের মাটিতে আরও এক বার মাহসা আমিনি-কাণ্ডের ছায়া দেখা যায়। অভিযোগ ওঠে, গত বছরের ১ অক্টোবর তেহরান মেট্রোর শোহাদা স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠার সময় ১৬ বছরের আরমিতা গেরাভান্ডের উপর চড়াও হয়েছিলেন নীতিপুলিশেরা। যার জেরে ট্রেনে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অচৈতন্য হয়ে পড়ে সে।
তেহরানে বসবাস করলেও আদতে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে কুর্দ অধ্যুষিত কারমানশাহের বাসিন্দা ছিলেন আরমিতা। সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর ছিল, আরমিতার মা শাহিন আহমাদিকে ওই হাসপাতালের বাইরে থেকে গ্রেফতার করেছিল নীতিপুলিশ। এমনকি, তাঁর পরিবারের সদস্যদের সব ক’টি মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের কাছে হিজাব-বিরোধী আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন, ‘‘শাহোদা স্টেশনে আরমিতার উপর হামলা চালিয়েছে প্রশাসন।’’ হিজাব পরার বাধ্যতামূলক নির্দেশ না মানায় নীতিপুলিশদের এই হামলা বলে দাবি ছিল তাঁদের।
যদিও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে একে দুর্ঘটনা বলে মনে করেছিলেন অনেকে। আরমিতার মা-ও তা ‘মেনে’ নিয়েছিলেন।
যে মেট্রো স্টেশনে এই হামলা হয়েছিল বলে অভিযোগ, সেই তেহরান মেট্রো কর্তৃপক্ষের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাসুদ দোরোস্তিও মারধরের কথা অস্বীকার করেন। আরমিতার সঙ্গে অন্যান্য যাত্রী বা মেট্রোর কর্মীদেরও কোনও ঝামেলা হয়নি বলেও দাবি করেছিলেন তিনি।
এর পর ২৮ অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরমিতার মৃত্যু হলে আবার সোচ্চার হন হিজাব-বিরোধী আন্দোলনকারীরা। যদিও তা মাহসা-কাণ্ডের পরের আন্দোলনের মতো তীব্র রূপ ধারণ করেনি।
এর পর আবার ২০২৪। শনিবার ইরানের একটি ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে দেখা গিয়েছিল, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে শুধু অন্তর্বাস পরে হাঁটছেন এক তরুণী। হিজাব তো বটেই, পরনের পোশাকের অধিকাংশই তিনি খুলে ফেলেছেন। ওই ভিডিয়োটিতে অন্য যে মহিলাদের দেখা গিয়েছিল, তাঁরা সকলেই আপাদমস্তক হিজাব পরে ছিলেন।
ইরানের শরিয়ত আইন অনুযায়ী, মহিলাদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। এ নিয়ে কড়াকড়ি রয়েছে গোটা দেশে। কড়া পোশাকবিধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তরুণী পোশাক খুলেছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে।
যদিও প্রাথমিক ভাবে পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিলেন, ওই তরুণী মানসিক ভারসাম্যহীন। তাঁকে নিরাপত্তারক্ষীরা আটক করে নিয়ে গিয়েছিল। বলা হয়েছিল, তরুণীকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হতে পারে। কিন্তু পরে জানা যায় তাঁকে গ্রেফতার করেছেন ইরান কর্তৃপক্ষ। তরুণীর হদিস মিলছে না বলেও খবর। যার জেরে ইরান এমনকি সারা বিশ্বে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি, তরুণীর ঘটনাতে ইরানে নতুন করে হিজাব বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে।
ছবি: সংগৃহীত।