তিনি পরিচিত ছিলেন ‘হায়দরাবাদের কোহিনুর’ নামে। নিলোফার ফারহাত বেগম সাহেবাকে বিশ্বের অন্যতম সুন্দরী নারী হিসাবেও বিবেচনা করা হত এক সময়। যদিও তাঁর জীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বরং বার বার বিভিন্ন বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কে ছিলেন এই নিলোফার? কেমন ছিল তাঁর জীবন?
নিলোফার ছিলেন হায়দরাবাদের শেষ নিজ়াম মির ওসমান আলি খানের পূত্রবধূ। ওসমানের দ্বিতীয় পুত্র মোয়াজ্জম জাহের প্রথম স্ত্রী।
তবে নিলোফারের জন্ম ভারতে নয়, তুরস্কে। ১৯১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ইস্তানবুলে তাঁর জন্ম। নিলোফারের মা ছিলেন তুরস্কের অটোমান রাজবংশের মেয়ে। সেই সূত্রে নিলোফার ছিলেন রাজপরিবারের সন্তান।
নিলোফার যখন জন্ম নেন, অটোমান সাম্রাজ্যের দশা বেহাল। একপ্রকার ধুঁকছিল তুরস্কের রাজপরিবার।
নিলোফারের যখন দু’বছর বয়স তখন তাঁর বাবা মারা যান। ১৯২৪ সালে মায়ের সঙ্গে তুরস্ক ছেড়ে ফ্রান্সে আসতে বাধ্য হন তিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান রাজবংশের পতন হয়।
জন্মসূত্রে ধনী এবং রাজপরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ফ্রান্সে এক জন সাধারণ মানুষের মতো জীবন কাটাতেন নিলোফার এবং তাঁর মা। জীবনে অনেক উত্থান-পতনেরও মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে।
অন্য দিকে, হায়দরাবাদের নিজ়াম ওসমানের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল অটোমান রাজপরিবারের। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র মোয়াজ্জম অটোমান রাজবংশে বিয়ে করুক।
সেই মতো ১৯৩১ সালে নিলোফারের সঙ্গে বিয়ে হয় মোয়াজ্জমের। নিলোফার তখন ১৫ বছর বয়সি কিশোরী। উল্লেখ্য, নিলোফারের উচ্চতা মোয়াজ্জমের থেকে সাত ইঞ্চি বেশি ছিল।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সৌন্দর্যের জন্য বিশ্বের সেরা ১০ সুন্দরীর মধ্যে স্থান করে নিয়েছিলেন নিলোফার। নামী পত্রিকার প্রচ্ছদেও স্থান পেয়েছিলেন।
নিলোফারের রূপের চর্চা ছিল বিশ্ব জুড়ে। পশ্চিমি পোশাক হোক বা শাড়ি— সব পোশাকেই সাবলীল ছিলেন নিলোফার। সব পোশাকই নাকি সুন্দর দেখাত তাঁকে। তিনি পরলে নাকি পোশাকের মান বাড়ত। রূপের জন্য ‘হায়দরাবাদের কোহিনুর’ তকমাও পেয়েছিলেন নিলোফার।
বিয়ের পর নিলোফার হায়দরাবাদে চলে আসেন। তখন নিজ়াম পরিবারের মহিলাদের জনসমক্ষে আসার নিয়ম ছিল না। তবে নিলোফার কখনও সেই নিয়মের তোয়াক্কা করেননি। বরং তিনি হায়দরাবাদের নিজ়াম পরিবারের মহিলাদের জন্য জনজীবনের বন্ধ দরজা খুলে দিয়েছিলেন। তিনিই হায়দরাবাদে প্রথম বেগম যিনি রাজপরিবারের বিভিন্ন পার্টি এবং অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শুরু করেন। সমাজকর্মী হিসাবেও পরিচিতি বাড়ে তাঁর।
শীঘ্রই হায়দরাবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন নিলোফার। অভিজাতদের নৈশভোজে স্বামীর সঙ্গে তাঁরও ডাক পড়ত। তবে নিলোফারের শাশুড়ি বেগম দুলহান পাশা নাকি তাঁর পূত্রবধূর বিদেশি আদবকায়দা নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। সেই সময় খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, বেগম নাকি তাঁর পুত্রবধূকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রও করেছিলেন।
সৌন্দর্যের জন্য সে সময় ‘স্টাইল আইকন’-এও পরিণত হয়েছিলেন নিলোফার। তাঁর মতো জনপ্রিয় ছিল তাঁর শাড়িও। যার মধ্যে ৩৪টি নিউ ইয়র্কের ফ্যাশন ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পরে দান করা হয়েছিল।
নিলোফারের ব্যক্তিগত জীবনও অবশ্য কম চোখধাঁধানো ছিল না। ১৯৪৮ সালে ফ্রান্স ভ্রমণে গিয়েছিলেন তিনি। আর হায়দরাবাদে ফিরে আসেননি। প্যারিসেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
তত দিনে নিজ়াম-রাজও শেষের পথে। হায়দরাবাদে ঢুকে পড়েছিল ভারতীয় সেনা। নিজামের পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যই বিদেশে চলে গিয়েছিলেন।
বিয়ের ২১ বছর পর ১৯৫২ সালে মোয়াজ্জমের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায় নিলোফারের। জল্পনা তৈরি হয়েছিল যে, সন্তান না হওয়ার কারণেই নাকি নিলোফারের সঙ্গে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মোয়াজ্জম।
ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, উচ্চতার কারণে স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল নিলোফারের। নিলোফারের উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। অন্য দিকে, মোয়াজ্জমের উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। অনেকের মতে, মোয়াজ্জমের ৫০ জন উপপত্নী ছিলেন। আর সে কারণেই নাকি বিয়ে ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন নিলোফার।
বিচ্ছেদের সময় নিজ়ামের পরিবারের থেকে বহু টাকার খোরপোশ পেয়েছিলেন নিলোফার। যার বেশির ভাগই তিনি হায়দরাবাদে মহিলা এবং শিশুদের জন্য একটি হাসপাতাল তৈরির জন্য দান করেছিলেন। নিলোফারের নামে সেই হাসপাতাল এখনও রয়েছে হায়দরাবাদে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিবাহবিচ্ছেদের পর ফ্রান্সে থাকতে থাকতেই হলিউডে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন নিলোফার। প্রথমে সেই প্রস্তাবে রাজি হলেও পরে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
পরে ১৯৬৩ সালে এডওয়ার্ড পোপ নামে আমেরিকার এক ব্যবসায়ী, লেখক এবং প্রযোজককে বিয়ে করেন নিলোফার। নিলোফারের থেকে এডওয়ার্ড বছর তিনেকের ছোট ছিলেন।
১৯৮৯ সালের ১২ জুন প্যারিসেই মারা যান নিলোফার। ফ্রান্সের ববিগনি কবরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। নিলোফারের মৃত্যুর পর তাঁর শাড়ির সংগ্রহ দান করে দেওয়া হয়। এর পর প্যারিস ছেড়ে ওয়াশিংটনে চলে যান এডওয়ার্ড। সেখানে ১৯৯০ সালে শৈশবের সহপাঠী ইভলিন ম্যাডক্স পোপকে বিয়ে করেন। ১৯৯৫ সালে মারা যান এডওয়ার্ড।
সব ছবি: সংগৃহীত।