বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের কী প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। — প্রতীকী ছবি।
জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই স্তম্ভ হল বাবা-মা। তাদের সম্পর্ক যখন ভেঙে যায়, তখন সন্তানের উপর তার প্রভাব হয় নানাবিধ। কী ভাবে এই কঠিন অবস্থায় সামলাবেন সন্তানকে, জেনে নিন।
সন্তানের মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব
১) জগতের সঙ্গে শিশুর প্রথম পরিচয়ের মাধ্যম হল বাবা-মা। বাবা এবং মা যে আলাদা হতে পারেন, এই ধারণাই সন্তান স্বাভাবিক ভাবে বুঝে উঠতে পারে না। বাবা-মা দু’জন একসঙ্গেই তার কাছে পরিবারের ধারণা তৈরি করে। এই পরিবারে ভাঙন ধরলে, সেই সন্তানের কাছে পরিবারের, সম্পর্কের ধারণাই এক ধরনের আঘাত পায়। তার বিশ্বাসের ভিত্তি নষ্ট হয়ে যায়। সে সকলের প্রতি একটা অবিশ্বাসের মনোভাব নিয়ে বড় হয়।
২) আমাদের পরিবারই আমাদের মনে নিরাপত্তার ধারণা তৈরি করে। শিশু বুঝতে শেখে, বাইরের জগতে যা-ই হোক, তার বাড়ি, তার পরিবার তার নিশ্চিন্তের আশ্রয়। কিন্তু, সেই পরিবার যখন ভেঙে যায়, সে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
৩) পরিবার ভেঙে গেলে, অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মা শিশুকে বিবাহবিচ্ছেদের প্রকৃত কারণ বোঝাতে পারেন না। তাই শিশু বাবা-মায়ের প্রতি অসম্ভব রাগ নিয়ে বড় হয়। যে রাগ অনেক সময়ে তারা সারা জীবন বহন করে।
৪) এ ক্ষেত্রে, সাধারণত, কোনও এক জন অভিভাবকের কাছে শিশু বড় হয়। সাধারণত দেখা যায়, যে অভিভাবকের কাছে সে বড় হয়, তার প্রতিই তার সবচেয়ে বেশি বিরূপ ভাব তৈরি হয় এবং তাকে নানা ভাবে দোষারোপ করে।
৫) অনেক সময়ে বাবা বা মা, এক পক্ষকে বেছে নিতে শিশুকে আদালতেও হাজিরা দিতে হয়। এই ঘটনা তার মনে ভয়ানক ভীতি-উদ্বেগ তৈরি করে।
বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আপনার সন্তানকে কী ভাবে প্রস্তুত করবেন?
বিবাহবিচ্ছেদ একটি পরিবারের জন্য অত্যন্ত কঠিন অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে যখন সেখানে শিশুরা জড়িত থাকে। তাদের মনে প্রশ্ন, অনিশ্চয়তা, এমনকি, রাগ ও দুঃখ জন্মায়। এই কঠিন সময়ে, বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে সন্তানকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ:
সঠিক সময়: যখন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যায়, তখনই সন্তানকে জানান। তাদের দোলাচলে ফেলবেন না।
সৎ ও স্পষ্ট ভাবে কথা বলুন: তাদের বয়স ও বোঝার মাত্রা অনুযায়ী বিষয়টি ব্যাখ্যা করুন। জটিল আইনি বিষয় এড়িয়ে চলুন।
কাউকে দোষারোপ করবেন না: সন্তানদের মনে তাদের বাবা-মায়ের প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবেন না।
আবেগ প্রকাশ করতে উৎসাহিত করুন: তাদের ভয়, রাগ, দুঃখ প্রকাশ করতে সাহায্য করুন। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তাদের নিশ্চিত করুন যে তারা একা নয়, আপনারা উভয়েই তাদের পাশে আছেন এবং তাদের ভালোবাসেন।
তাদের দৈনন্দিন দিনলিপি বজায় রাখুন: যতটা সম্ভব তাদের দিনলিপি একই বজায় রাখার চেষ্টা করুন। এটি তাদের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
পেশাদার বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন: প্রয়োজনে শিশু-মনোবিদ বা থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না।
কিছু বিষয় মনে রাখবেন:
বয়স অনুযায়ী ভাষা ব্যবহার করুন: শিশুদের সাধারণ শব্দে ব্যাখ্যা করুন। অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সের সন্তানকে সাধারণ বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানান।
তাদের প্রশ্নের উত্তর দিন: ধৈর্য ধরে তাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিন, এড়িয়ে যাবেন না।
তাদের আশ্বস্ত করুন: তাদের বারবার আশ্বস্ত করুন যে, তারা নিরাপদ এবং তারা কারও ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হবে না।
সংঘাত এড়িয়ে চলুন: তাদের সামনে ঝগড়া করবেন না বা একে অপরকে অপমান করবেন না। দরকারে, পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য নিন। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক ও গবেষক ঝুমুর দে-র মতে, “আধুনিক সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা আরও বাড়বে। এই সত্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কিন্তু বাবা-মাকে সন্তানের দিকটা খেয়াল রাখতে হবে। যেন নিজেদের মধ্যে তিক্ততার প্রভাব সন্তানের উপর না পড়ে।”
বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ এক জন সন্তানের কাছে একটি কঠিন অভিজ্ঞতা হলেও, সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আপনি আপনার সন্তানকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে পারেন এবং তাদের এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করতে পারেন। মনে রাখবেন, আপনার সন্তানের মানসিক সুস্থতা এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।