এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকেই শুরু হয়েছিল তাপপ্রবাহের দাপট। সেই দাপট এখনও অব্যাহত। মে মাসের প্রথম সপ্তাহেও যে তাপপ্রবাহের হাত থেকে নিস্তার মিলবে না, তা জানিয়ে দিয়েছে আবহাওয়া দফতর। এই গরমে খাওয়াদাওয়ার প্রতি যেমন অনীহা জন্মাচ্ছে, তেমনই রান্নাঘরে ঢুকতেও যেন কান্না পাচ্ছে। এই সময় ডায়েটে কিন্তু প্রচুর শাকসব্জি না রাখলে চলবে না।
শরীর চাঙ্গা রাখতে খেতে হবে হালকা খাবার। অনেকের ধারণা, কম মশলা দিয়ে তৈরি রান্নার নাকি স্বাদ হয় না। অথচ দিদিমা-ঠাকুমাদের হাতে তৈরি অল্প মশলা দিয়ে সুস্বাদু সব খাবার তো সকলেই চেটেপুটে খেতেন! তাই ঘোর গরমে কেবল পান্তার ভরসায় না থেকে বানিয়ে ফেলুন সুস্বাদু সব পদ। হেঁশেলে খুব বেশি সময় না কাটিয়েও পেটকে তৃপ্ত করার নানা সুস্বাদু পদের হদিস রইল।
লাউ শুক্তো: গরমে পেট ঠান্ডা রাখতে, শরীরে জলের ঘাটতি মেটাতে লাউয়ের জুড়ি মেলা ভার। তবে লাউয়ের ঘণ্টের বদলে প্রথম পাতে বানিয়ে ফেলতে পারেন লাউয়ের শুক্তো।
কড়াইয়ে সর্ষের তেল গরম করে শুকনো লঙ্কা, পাঁচফোড়ন আর আদা বাটা দিয়ে কুচি করে কেটে রাখা লাউ দিয়ে দিন। এ বার নুন, হলুদ দিয়ে ভাজা ভাজা করে ঢেকে দিন কিছু ক্ষণ। এ বার ঢাকা তুলে দুধ, আগে থেকে ভেজে রাখা করলা আর বড়ি দিয়ে নাড়াচাড়া করে নিন। ঘি ছড়িয়ে নামিয়ে নিন লাউয়ের শুক্তো।
সজনে ডাল: গরমের সময় ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত রোগের প্রকোপ বাড়ে। এই সময় রোজ খাওয়ার পাতে সজনে ডাঁটা রাখা জরুরি। তবে সজনে চচ্চড়ি, সজনে পোস্ত তো হামেশাই খাওয়া হয়। তবে সজনে দিয়ে ডাল কিন্তু খুব সহজেই বানিয়ে ফেলা যায়।
প্রেশার কুকারে মুসুর ডাল, সজনে ডাঁটা, টম্যাটো, নুন, হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করে নিন। এ বার কড়াইয়ে সামান্য রাঁধুনি, শুকনো লঙ্কা আর পেঁয়াজ কুচি ফোড়ন দিয়ে সেদ্ধ ডাল দিয়ে দিন। একটু ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে দিলেই তৈরি সজনে ডাল।
আম দিয়ে আলুর ভাজি: ডালের সঙ্গে একটু ভাজাভুজি না হলে ঠিক জমে না! তবে গরমের সময় ডোবা তেলে ভাজাভুজি না খাওয়াই ভাল। ডালের সঙ্গে আলুভাজা থাকলে আর কী চাই! তবে আলুভাজাতেও থাকুক আমের টুইস্ট।
কড়াইতে সর্ষের তেল গরম করে মোটা মোটা করে কেটে রাখা আলু নুন, হলুদ আর চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে ভেজে নিন। আলু নরম হয়ে এলে লম্বা করে কুচিয়ে রাখা আম আর সামান্য চিনি দিয়ে নাড়াচাড়া করুন। শেষে পোস্ত ছড়িয়ে দিন।
মরিচ ঝোল: গ্রীষ্মকালে বাজারে সব্জির ছড়াছড়ি। এই সময় খুব বেশি তেল-মশলাদার খাবার না খেয়ে পাতলা সব্জির ঝোল খাওয়া কিন্তু পেটের জন্য খুবই ভাল। তবে সাধারণ পাঁচমিশেলি সব্জির বদলে বানিয়ে ফেলুন ঠাকুরবাড়ির মরিচ ঝোল।
তেলে কালো জিরে আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ডুমো করে কেটে রাখা আলু, ঝিঙে, পটল, পেঁপে, কুমড়ো নুন আর সামান্য হলুদ দিয়ে ভেজে নিন। এ বার মিক্সিতে সামান্য কালো জিরে আর কয়েকটি কাঁচালঙ্কা বেটে নিন। এ বার এক কাপ দুধে সেই মিশ্রণটি মিশিয়ে নিয়ে সব্জিতে ঢেলে দিন। ঝোল ফুটে উঠলে স্বাদ মতো চিনি, চেরা কাঁচালঙ্কা আর সামান্য ঘি দিয়ে গ্যাস বন্ধ করে দিন।
কুমড়ো-চিংড়ির ভর্তা: ভাতের সঙ্গে ভর্তা থাকলে আর কিছুই লাগে না। তা দিয়েই এক থালা ভাত খাওয়া হয়ে যায়। চটজলদি বানিয়ে ফেলতে পারেন কুমড়ো-চিংড়ির ভর্তা। গরমে ভাতের সঙ্গে এই ভর্তা পাতে পড়লে জমে যাবে দুপুরের ভোজ।
কড়াইয়ে সর্ষের তেল গরম করে নুন-হলুদ মাখানো কুচো চিংড়ি ভেজে তুলে রাখুন। এ বার ওই তেলেই শুকনো লঙ্কা আর কালোজিরে ফোড়ন দিয়ে লম্বা করে কুচিয়ে রাখা কুমড়ো নুন দিয়ে ভেজে নিন। এ বার কড়াইয়ে অল্প জল দিয়ে কুমড়ো সেদ্ধ করে নিন। জল শুকিয়ে এলে ভাজা চিংড়ি, পেঁয়াজ কুচি, কাঁচালঙ্কা কুচি দিয়ে মিনিট দুয়েক নাড়াচাড়া করে নিন। এ বার মিশ্রণটি থালায় ঢেলে কাঁচা তেল দিয়ে ভাল করে মেখে নিন।
গন্ধরাজ-কাতলা ভাপা: অনেকেরই দুপুরে ভাতের সঙ্গে মাছ চাই-ই-চাই। তবে গরমে তেল-মশলা দিয়ে কষানো মাছ খেতে ভাল লাগে না, আবার কালোজিরের পাতলা ঝোলও সব সময় ভাল লাগে না। তাই বানিয়ে ফেলতে পারেন গন্ধরাজ-কাতলা ভাপা।
একটি পাত্রে জল নিয়ে গন্ধরাজ লেবুর টুকরো আর পাতা ভিজিয়ে রাখুন। এ বার কাতলা মাছে নুন, কাঁচালঙ্কা বাটা, আদা বাটা, গোলমরিচ গুঁড়ো, গন্ধরাজ লেবুর খোসা দিয়ে দিন। এ বার সর্ষের তেলে মাছ হালকা করে ভেজে তুলে রাখুন। একটি পাত্রে দইয়ের সঙ্গে নুন, চিনি, গোলমরিচ গুঁড়ো, লেবুর খোসা, লেবুর রস, লেবুপাতা ভেজানো জল, মাছ, সর্ষের তেল, চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে মিনিট পনেরো ভাপিয়ে নিন।
আম-মৌরলা: গরমের সময় কাঁচা আম রান্নায় পড়লে খেতে বেশ ভালই লাগে। মাছের সঙ্গে আমের যুগলবন্দিটা কিন্তু খেতে চমৎকার। মৌরলা মাছ থাকলে বানিয়ে ফেলতে পারেন আম-মৌরলা।
প্রথমে মৌরলা মাছ নুন, হলুদ গুঁড়ো, সর্ষের তেল আর সর্ষে বাটা মাখিয়ে রাখুন। কড়াইয়ে সর্ষের তেল গরম করে কালোজিরে ফোড়ন দিন। পেঁয়াজ কুচি দিয়ে হালকা ভাজুন। এ বার ম্যারিনেট করে রাখা মৌরলা মাছ ওই তেলে দিয়ে দিন। হালকা নেড়েচেড়ে সামান্য ভেজে নিন। এর পর তাতে একে একে স্বাদ মতো নুন, লঙ্কা গুঁড়ো ও চেরা কাঁচালঙ্কা দিন। কাঁচা আমের টুকরোগুলো দিয়ে নাড়তে থাকুন। সব কিছু এক বার ভাল করে নেড়ে প্রয়োজন মতো জল দিয়ে চাপা দিন। কাঁচা আম সেদ্ধ হয়ে ঝোল ফুটে উঠলে উপর থেকে কাঁচা তেল ছড়িয়ে দিন।
লেবু-কাঁচালঙ্কা মুরগি: মুরগি দিয়ে চটজলদি এই পদটি বানিয়ে ফেলতে পারেন। মুরগির ঝাল, কষা চিংবা ঝোলের বদলে ভিন্ন স্বাদের এই পদ গরমের দিনে আপনার পেটের সমস্যার কারণ হবে না। সামান্য উপকরণেই তৈরিও করে ফেলা যায় এটি।
প্রথমে প্যানে তেল গরম হলে তাতে শুকনো লঙ্কা, ফোড়ন আর রসুন বাটা দিয়ে ভাল ভাবে ভাজুন। সুন্দর গন্ধ বেরোলে তাতে চিকেনের টুকরোগুলো দিন। চিকেন ভাল করে ভাজা হয়ে এলে তুলে নিয়ে ঐ তেলেই পেঁয়াজ বাটা, ধনে গুঁড়ো, গরম মশলা গুঁড়ো, কাঁচালঙ্কা বাটা, টক দই দিয়ে ভাল ভাবে কষান। মশলা থেকে তেল বেরোলে ভাজা চিকেন দিয়ে আবার কষান, যাতে মশলার সঙ্গে চিকেন ভাল ভাবে মিশতে পারে। এ বার নুন, চেরা লঙ্কা আর জল দিয়ে ঢেকে সেদ্ধ করে নিন। রান্না হয়ে এলে গন্ধরাজ লেবুর টুকরো আর কয়েকটি পাতা ঝোলে দিয়ে ঢাকা বন্ধ করে ৫ মিনিট মতো রাখুন।
আম-কলা-খেজুরের চাটনি: শেষ পাতে চাটনি না হলে ভোজ সম্পূর্ণ হয় না। আর আমের মরসুমে আমের চাটনি হবে না, তা আবার হয় নাকি! তবে আমের চাটনিতে দিয়ে দিন পাকা কলা। শুনতে কেমন লাগলেও স্বাদ কিন্তু হয় অনবদ্য।
কাঁচা আমে নুন দিয়ে সেদ্ধ করে নিন। এ বার কড়াই গরম করে চিনি আর পাকা আমের ক্বাথ ভাল করে মিশিয়ে নিন। এ বার সেই মিশ্রণে খেজুর কুচি, পাকা কলার টুকরো, বেদানা, সামান্য লেবুর রস আর ভাজা মশলা দিয়ে নাড়াচাড়া করেই নামিয়ে নিন।
আম দই: মিষ্টি দই খেতে ভালবাসেন না এমন বাঙালি হাতেগোনা। তবে আমের মরসুমে মিষ্টি দইয়ে আমের টুইস্ট দিলে কেমন হয়? ঘরেই বানিয়ে ফেলুন আম দই।
একটি পাত্রে জল ঝরানো টক দই নিয়ে তার সঙ্গে পাকা আমের ক্বাথ দিয়ে খুব ভাল করে ফেটিয়ে নিন। এ বার দুধ গরম করে তাতে চিনি দিয়ে ফুটিয়ে আম-দইয়ের মিশ্রণে ঢেলে খুব ভাল করে মিশিয়ে নিন। ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় দই জমিয়ে নিন। দই জমে গেলে ঠান্ডা করে পরিবেশন করুন।
সব ছবি: সংগৃহীত।