পারিবারিক সূত্রের দাবি, বিচারপতির প্রিয় খাবার নাকি বিরিয়ানি এবং কচুরি-আলুর দম। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। অধুনা কলকাতা হাই কোর্ট তথা পশ্চিমবঙ্গে অন্যতম আলোচিত নাম। এসএসসি মামলায় মন্ত্রী-কন্যার চাকরি খোয়ানো থেকে শুরু করে ৭৬ বছরের প্রৌঢ়ার সিকি শতকের বকেয়া বেতন দেওয়ার নির্দেশ— আমজনতার একটা অংশ বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে ‘জনগণের বিচারপতি’ বলে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে।
২০১৮-র ২মে কলকাতা হাই কোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসাবে নিযুক্ত হন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই হাই কোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি। এর আগে ১০ বছর অবশ্য স্কুল সার্ভিস কমিশনের আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছিলেন। তবে পেশাদার জীবনের একেবারে শুরু থেকেই আইন জগতে ছিলেন না তিনি। প্রথমে ছিলেন সরকারি চাকুরে। কিন্তু সেখানে মন না টেকায় আইন পড়া শুরু।
বিচারপতি, আইনজীবী, সরকারি আমলা— এত গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্ব সামলানোর আগে কমবয়সে কিছু দিন সাংবাদিকতাও করেছেন। ৬০ ছুঁয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তবে বয়সের তুলনায় এখনও যথেষ্ট ফিট তিনি। অনেকেরই ধারণা, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত রাশভারী এবং গুরুগম্ভীর। মন্ত্রী থেকে দাপুটে নেতা— যে কাউকেই এক নির্দেশে যিনি সিবিআই দফতরে পাঠিয়ে দেন, কী তাঁর প্রাত্যাহিক রোজনামচা? বিভিন্ন সূত্র মারফত তার খোঁজ নিয়েছে আনন্দবাজার অনলাইন।
সকাল ৯টা নাগাদ ঘুম থেকে ওঠেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তার পর শুরু আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি। আলাদা করে প্রাতরাশ করেন না। আদালতে বেরোনোর আগে রুটি এবং অল্প তেলে রান্না করা বিভিন্ন মরসুমি সব্জি দিয়ে তৈরি তরকারি খেয়ে নেন। ডায়াবিটিস আছে। দু’বেলা ইনসুলিনও নিতে হয়। ফলে ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন সেই ১৯৯৫ সালে! পরিবারের এক সদস্য অবশ্য বললেন, রবিবার অল্প ভাত খান। চা খেতে অসম্ভব ভালবাসেন। সারা দিনে কম করে অন্তত ৩০ কাপ চা চা-ই তাঁর। রাতে খাওয়ার পাতে বিভিন্ন সময় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে থাকে লুচি, পরোটা বা রুটি। পারিবারিক সূত্রের দাবি, বিচারপতির প্রিয় খাবার নাকি বিরিয়ানি এবং কচুরি-আলুর দম।
ঘনিষ্ঠেরা বলেন, ‘ফিট’ থাকতে আলাদা করে কোনও শরীরচর্চা করেন না। মনে করেন, শরীর থাকলে খারাপ হবে। দায়িত্ব সামলাতে হবে বলে আলাদা করে সুস্থ থাকার কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে, এমনটা তিনি মনে করেন না। এ সব অবশ্য তিনি ঠাট্টা করে বন্ধুমহলে বলে থাকেন। আর বন্ধুরা বলেন, তাঁর গম্ভীর মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছেন এক আদ্যোপান্ত রসিক মানুষ।
হাই কোর্টে এত গুরুত্বপূর্ণ মামলা সামলানোর পর রাতে বাড়ি ফিরে ডুব দেন বইয়ে। তবে আইনের বই নয়। ওই সময়টায় ইংরেজি এবং বাংলা সাহিত্যের রসাস্বাদন করেন। একসঙ্গে দু’তিনটে বই পড়েন। যখন যেটা ইচ্ছে হয় পড়েন। তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে জানা গেল, এই মুহূর্তে তিনি পড়ছেন ড্যানিয়েল কাহেনম্যানের ‘নয়েজ’, প্রশান্তকুমার পালের ‘রবিজীবনী’র চতুর্থ খণ্ড, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘যা দেখি যা শুনি একা একা কথা বলি’ এবং নিখিল শূরের ‘সাহেব মেম সমাচার।’ তবে পছন্দের কবি জীবনানন্দ এবং জয় গোস্বামী। সময় পেলেই ডুব দেন তাঁদের কবিতায়।
বই পড়ার পাশাপাশি সিনেমা দেখতেও পছন্দ করেন । বিচারপতির পছন্দের সিনেমার তালিকায় রয়েছে ‘কোনি’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং সদ্যপ্রয়াত তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘দাদার কীর্তি’। এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলে সিনেমা দেখার সুযোগ পান কখন? তাঁর প্রিয়জনেরা জানান, সিনেমা দেখতে এতটাই ভালবাসেন যে, হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও সময়-সুযোগ বার করে নেন। ওটিটি নয়, বড় পর্দাতে সিনেমা দেখাই বেশি পছন্দ তাঁর। কানাঘুষোয় জানা গেল, শেষ ছবি দেখেছেন ‘কাশ্মীর ফাইলস’। বন্ধুমহলে পঙ্কজ ত্রিপাঠী অভিনীত ‘শের দিল’ দেখারও ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন বিচারপতি।
ঘটনাচক্রে, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় কলেজ জীবনে থিয়েটার করেছেন। ‘অমিত্র ছন্দ’ নাট্যদলের হয়ে নিয়মিত অভিনয় করতেন। শেষ বার মঞ্চে উঠেছেন ১৯৮৬ সালে। তার পর পেশাগত জীবনে ঢুকে যাওয়ায় নিয়মিত থিয়েটার করা হয়নি। অভিনেতা সত্তা কি এখনও বেঁচে আছে তাঁর মধ্যে? জানেন স্বয়ং বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
বই পড়া, সিনেমা দেখা ছাড়াও তাঁর অবসর কাটে গান শুনেও। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর সব সময়ের সঙ্গী। তা ছাড়াও লোকগান, পুরনো দিনের বাংলা গানও রয়েছে বিচারপতির পছন্দের তালিকায়।
পর পর এমন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় মানবিক রায় দেওয়ায় সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে তাঁর নাম। এমন জনপ্রিয়তা সাধারণত পর্দার অভিনেতারা পেয়ে থাকেন। তাঁর পাড়ার লোকদের কাছে খবর পাওয়া গেল, জনপ্রিয়তা এই মাত্রায় পৌঁছেছে যে, বাজারে গেলে নাকি লোকজন অটোগ্রাফের জন্য ছেঁকে ধরছে।
মানসিক চাপ দূর করতেই কি নিজেকে বই-সিনেমা-গানে ডুবিয়ে রাখেন বিচারপতি? তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেই নাকি বিচারপতি মুচকি হেসে সুকুমার রায়ের দুটি পংক্তি বলেন—‘খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ/ হাতি লোফেন যখন তখন’!