Bhuban Badyakar

Bhuban Badyakar: এখনও ‘কাঁচা বাদাম’ বিক্রি করেন, তবে স্বপ্ন অভিনয়ের! ভূমিকাও বাছা আছে ভুবন বাদ্যকরের

প্রিয় খাবার থেকে প্রিয় পোশাক, তাঁর জীবনে স্ত্রী আদুরীর অবদান, নতুন বাড়ি— আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি বাদাম কাকু ওরফে ভুবন বাদ্যকর।

Advertisement
রিচা রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২২ ১৫:১৩
গান নিয়ে আরও আগে থেকে চর্চা করার সুযোগ পাননি বলে একটা আপশোস আছে।

গান নিয়ে আরও আগে থেকে চর্চা করার সুযোগ পাননি বলে একটা আপশোস আছে।

এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় তারকা তিনি। ব্যস্ততমও। কাজ চালানোর মতো একটা ছোট মোবাইল আছে বটে তাঁর কাছে। কিন্তু তা অধিকাংশ সময় বেজে যায়। মোবাইল মালিকের অত সময় কোথায়? তাঁর বাঁধা ‘কাঁচা বাদাম’ গানে নাচছে আসমুদ্রহিমাচল। তিনি যে ভুবন বাদ্যকর। সকলের বাদাম কাকু।

কথা বলতে ভালবাসেন তিনি। অনর্গল বলেও যেতে পারেন। ফলে আলাদা করে কোনও প্রশ্ন করার সুযোগই দেননি। আপন গতিতে নদীর মতো বয়ে চলেন ভুবন বাদ্যকর।

Advertisement

বীরভূম জেলার দুবরাজপুরের কুড়ালজুরি গ্রামে কাঁচা বাদাম খ্যাত ভুবনের বেড়ে ওঠা। ছোট থেকেই দারিদ্র্য তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি মেজো। আর্থিক কারণে চতুর্থ শ্রেণির পর আর পড়াশোনা হয়নি। তা নিয়ে কোনও আক্ষেপও নেই অবশ্য তাঁর। বরং গান নিয়ে আরও আগে থেকে চর্চা করার সুযোগ পাননি বলে একটা আফসোস আছে।

দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাঁচা বাদাম বিক্রি করে আসছেন ভুবন। তারও আগে অবশ্য শাকসব্জি বিক্রি করতেন। বাদাম বিক্রি করে দৈনিক যে সামান্য রোজগার তিনি করতেন, তা দিয়েই কোনও মতে চলে যেত। কিন্তু সেই বাদামের হাত ধরেই বর্তমানে তাঁর এত নাম-ডাক, জনপ্রিয়তা, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য। স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে, বউমা, নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসার তাঁর। বড় ছেলে ইউটিউবার। কাঁচা মাটির বাড়ি এখন পরিণত হয়েছে লক্ষাধিক টাকার অট্টালিকায়। বেড়েছে ব্যস্ততাও। ফোন করা মাত্রই কথা বলা যাবে না তাঁর সঙ্গে। কারণ তিনি ব্যস্ত থাকেন নানা রকম ‘মিটিং’য়ে।

৫৩ বছরেও এখনও তিনি যথেষ্ট সুস্থ-সচল।

৫৩ বছরেও এখনও তিনি যথেষ্ট সুস্থ-সচল। ছবি: সংগৃহীত

একাধিক বার চেষ্টা করার পর বিকেল ৪টে নাগাদ সময় পাওয়া গেল তাঁর। গলায় ভরপুর আন্তরিকতা। ফোনে সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে তাঁর গলায় উৎকণ্ঠার আভাস পাওয়া গেল খানিক। সাক্ষাৎকার নয়, আপনার সঙ্গে গল্প করব— এ কথা শুনে অবশ্য আশ্বাস পেলেন। শুরু হল আলাপচারিতা। সারা দিন কী ভাবে কাটে? জিজ্ঞেস করতেই ভুবন গড়গড় করে শুরু করলেন তাঁর রোজের দিনলিপি।

রাত থাকতেই বিছানা ছাড়েন তিনি। স্নান সেরে পুজোয় বসেন। পুজো শেষে মালা জপতে বসেন। মালা জপা শেষ হলে কিছু ক্ষণ সময় দেন গানের পিছনে। নতুন গান লেখেন। গুনগুন করে কিংবা গলা ছেড়েই গান গেয়ে ওঠেন। তার পর একটু বেলা বাড়লেই জলখাবার সারেন মুড়ি আলুভাজায়। জীবনে বদল এলেও খাদ্যাভ্যাসে কিন্তু কোনও পরিবর্তন আসেনি তাঁর।

আজীবন নিরামিষ খান। ভুবন সেই অর্থে খাদ্যরসিক নন। স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই তাঁর কাছে যথেষ্ট। বিখ্যাত হয়ে গিয়েছেন বলে শিকড়কে কিন্তু ভোলেননি ভুবন। এখনও সময় পেলেই বাদাম আর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এখন অবশ্য বাদাম বিক্রি করার জন্য অত হাঁকডাঁক করতে হয় না। তাঁকে দেখলেই ছেঁকে ধরে গ্রামের লোকজন। বাদাম কেনে। গান শোনে। ‘আমাদের ভুবন’ বলে গর্ব করে। বেলা বাড়লে ভুবন বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তিনি ফিরলে রান্না চাপে। ৫৩ বছরেও এখনও তিনি যথেষ্ট সুস্থ-সচল। তাই এখনও সব দায়িত্ব ছেলেদের হাতে তুলে দেননি। নিজেই সামলান সব কিছু।

কথার মাঝেই হঠাৎ ফের উদ্বেগ শোনা গেল ভুবনের কণ্ঠে, ‘‘ম্যাডাম, মেঘ কালো করে আসছে। বিজলি দিচ্ছে (বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে)। এখন ফোন রাখি বুইজলেন। বিজলির সময় ফোনে কথা বললে ফোন ফেটে যেতে পারে। পরে আবার কথা বলব খনে, এখন রাখছি।’’

ভুবন ফোন কেটে দিলেন বটে। কিন্তু কথা তো অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। সেই তাগিদেই ফের তাঁকে ফোন। ‘কলকাতার ম্যাডাম’কে তিনি সময় দিলেন ফের দিন দুয়েক পর, ‘‘আজকাল এত কাজ থাকে বুঝলেন ম্যাডাম যে, নিজের জন্যেই সময় বার করে উঠতে পারি না। কত লোকজন সব দেখা করতে আসে। তবে আমার ভালই লাগে জানেন? এত সব আগে তো দেখিনি। নতুন জীবন পেয়ে আমি খুব খুশি। এখন যদি কেউ আমাকে ভুবন না বলে বাদাম কাকু বলে ডাকে তাতেই আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হই।’’ বাদাম যে ভুবন বাদ্যকরের জীবন একেবারে পাল্টে দিয়েছে তাঁর কথাতেই একেবারে স্পষ্ট। কলকাতা কেমন লেগেছে জানতে চাওয়ায়, ভুবন যেন খানিক উদাসীন হয়ে গেলেন। আবেগ জড়ানো গলায় ভুবন বললেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই কলকাতা শহর দেখার আমার শখ। কিন্তু কখনও যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এত দিন শুধু অত বড় শহরটাকে কল্পনা করতাম মনে মনে। প্রথম যে দিন কলকাতায় গেলাম আমার খুব আনন্দ হয়েছিল। ময়দান দেখলাম। ভিক্টোরিয়ার আশেপাশে ঘুরলাম। আর শহরের মানুষ কিন্তু খুব ভাল। আপন করে নিতে জানে। সবাই সই নেয়। ছেল্ফি তোলে। কাঁধে হাত দিয়ে ছবি তোলে। পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে। ভগবান আর আপনাদের আশীর্বাদ ছাড়া কিছুই হত না।’’ কলকাতা এসে রসগোল্লার স্বাদ নেননি? ভুবনের গলাতে এ বারও দুঃখ ঝড়ে পড়ল,‘‘আমার তো সুগার আছে, ম্যাডাম। মিষ্টি আমি খাই না। কিন্তু কলকাতায় এসে রসগোল্লা খেয়েছি। নিরামিষ খাই তো। অনেক কিছুই খেতে পারি না। সন্ধেবেলায় একটু মুড়ি আর বেগনি হলেই আমার হয়ে যায়। ফুচকা খেতেও ভালবাসি। তবে ফুচকার আলুতে পেঁয়াজ দেওয়া থাকলে আমি খাব না।’’

অনেক দিন হয়ে গেল কলকাতায় দেখা যাচ্ছে না ভুবন বাদ্যকরকে। শহরের প্রতি কোনও অভিমান হল নাকি তাঁর? সন্দেহের অবসান ঘটালেন ভুবন। ‘‘বাদাম ২ আসছে কিছু দিনের মধ্যেই। রেকর্ডিংয়ের সময় গিয়েছিলাম। আবার যাব জুন মাসের ১ তারিখে। দিল্লি, মুম্বই, অসমে পর পর গানের অনুষ্ঠান আছে। তা নিয়েই ব্যস্ত থাকব আগামী দু’মাস।’’

জীবনে কোনও স্বপ্ন আছে কি না জানতে চাওয়ায় তাঁর কণ্ঠে উত্তেজনা ফেটে পড়ল, ‘‘গান তো আছেই। আমি অভিনয়ও করতে চাই। আমাকে কোন রোলে মানাবে বলে আপনার মনে হয়?’’ উল্টে তিনিই প্রশ্ন করে বসলেন। নিজেই বলে উঠলেন ‘‘ভিলেন আমাকে মানাবে না মনে হয়। নায়করা অনেক সুন্দর হয়। আমার মনে হয়, আমায় নায়িকার বাবার রোলেই ভাল মানাবে বুঝলেন।’’

কথায় বলে, সব সফল পুরুষের পিছনে এক জন নারী থাকেন। এহেন আত্মবিশ্বাসী ভুবন বাদ্যকর কি সে কথা বিশ্বাস করেন? ভুবন জানালেন, ‘‘আদুরী, আমার স্ত্রী। পড়াশোনা বিশেষ শেখেনি। সবার সামনে কথা বলতেও লজ্জা পায়। কিন্তু ও অনেক কষ্ট করেছে। কিন্তু কখনও আমাকে মুখ ফুটে কিছু বলেনি। এখন এত কিছু দেখে ও অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। তবে আমি জানি ও মনে মনে খুব খুশি হয়। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না। লাজুক আছে একটু। তবে পাঞ্জাবি পরলেই আমাকে সবচেয়ে ভাল লাগে সেটা বলেছে। তাই এখন সব অনুষ্ঠানে আমি পাঞ্জাবি পরে যাই।’’ ফিক করে হেসে ফোন রাখলেন ভুবন বাদ্যকর। সকলের বাদাম কাকু।

আরও পড়ুন
Advertisement