ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।
ই ংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সিস ফোক কলকাতায় তাঁর ভাইপোকে লিখেছিলেন, “তোমার বোন, মার্গারেট তোমার কাছে যাচ্ছেজীবনসঙ্গীর খোঁজে। তার না আছে রূপ, না আছে রুপো, যাতে এখানে বিয়ে হতে পারে তার।”
কেন এই রকম পরিস্থিতি, সে কথাই এখন একটু বিশদে বলতে চলেছি।
বিলিতি মেম নেই, পাত্রী পর্তুগিজ
সময়টা আঠারো শতকের শেষের দিক। ইংল্যান্ডে তখন মেয়েদের বিয়ের সমস্যা তীব্র। বিবাহযোগ্য পুরুষের সংখ্যা মেয়েদের তুলনায় নগণ্য। আঠারো শতকে ইংল্যান্ড বেশ কয়েকটি বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। আমেরিকার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতে হয়েছিল টানা আট বছর। মৃত্যু হয়েছিল হাজার হাজার ব্রিটিশ সেনার। ও দিকে ইংল্যান্ডে, যে কোনও কারণেই হোক, ঘরে ঘরে পুত্রসন্তানের তুলনায় কন্যাসন্তানের আধিক্য। লেডি অগাস্টা এবং রেভারেন্ড করবেটের তেরোটি সন্তানের মধ্যে স্টুয়ার্ট করবেট একমাত্র পুত্রসন্তান। ইংল্যান্ড যখন নারী-সংখ্যার ভারে তাদের বিয়ের সমস্যায় বিব্রত, কলকাতার অবিবাহিত সাহেবরা চাতকের মতো চেয়ে থাকত ইংল্যান্ড থেকে কুমারী মেয়েদের আগমনের আশায়। কলকাতায় শ্বেতাঙ্গীর অভাবে তারা বাধ্য হত ভারতীয় বিবি নিয়ে সংসার করতে।
১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেন, সে বছর জুন মাসে কলকাতায় ইউরোপীয় রমণীর সংখ্যা ছিল মাত্র আশি। চুয়ান্ন বছরের মাথায়, ১৮১০-এ সারা বাংলায় মেমদের সংখ্যা ছিল মাত্র আড়াইশো, সাহেবের সংখ্যা চার হাজার। এই কারণে আঠারো শতকের প্রথমার্ধে সাহেব-মেমের বিয়ের ঘটনা ছিল প্রায় বিরল। ১৭১৩ থেকে ১৭৫৪, এই একচল্লিশ বছরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল মাত্র ৪১৭টি বিয়ে। অর্থাৎ বছরে গড়ে দশটির আশপাশে। অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিবাহ অনুষ্ঠান ছিল হলওয়েলের মেয়ে এলিজ়াবেথের বিয়ে।
কলকাতায় ব্রিটিশ রমণীর আকালের জন্য দায়ী ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালন সমিতি। তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল মেয়েদের ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসার উপর। কিন্তু এক সময় দেখা গেল, ভারতে ইংরেজরা তাদের দেশের মেয়ের অভাবে ঝুঁকে পড়েছে পর্তুগিজ রমণীদের দিকে। পর্তুগিজ রমণীর অভাব ছিল না, কারণ পর্তুগিজরা প্রতি বছর জাহাজভর্তি করে পর্তুগিজ মেয়েদের ভারতে নিয়ে আসত পর্তুগাল থেকে। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে পর্তুগিজ রমণীদের বিয়ে করার প্রবণতা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল কোম্পানির কর্তৃপক্ষ। ইংরেজরা পর্তুগিজদের ঘৃণার চোখে দেখত, কারণ তারা ক্যাথলিক।
সমস্যার সমাধান ‘ফিশিং ফ্লিট’
কোম্পানি তাই বাধ্য হল পর্তুগিজদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে নিজেদের জাহাজে করে ব্রিটিশ মেয়েদের ভারতে আনতে। যে জাহাজে তাদের আনা হত, তার নাম ‘ফিশিং ফ্লিট’। যে মেয়েদের আনা হত, কোম্পানি তাদের দিত এক প্রস্ত পোশাক আর তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিত এক বছরের জন্য। আশা করা হত, এই সময়ের মধ্যে তারা খুঁজে নিতে পারবে উপযুক্ত জীবনসঙ্গী।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংল্যান্ডের সমাজে নারীর অবস্থান ছিল ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থানের মতোই। মেয়েদের শিক্ষালাভে উৎসাহ দেওয়া হত না, কেউ আগ্রহী হলে বাধা দেওয়া হত। মনে করা হত, মেয়েদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত একটা ভাল বিয়ে। এই ধারণা অটুট ছিল বিশ শতকের বিশের দশকেও। ১৯২২-এ আইরিস জেমস জন্মেছিলেন ইংল্যান্ডে। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী, ভবিষ্যৎ ছিল উজ্জ্বল। তবু তাঁর মা তাঁকে ছাড়িয়ে আনেন স্কুল থেকে। হতাশ না হয়ে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান বাড়িতে বসে। ভারতে আসার ইচ্ছে তাঁর ছিল না। তার অন্যতম কারণ, ছোটবেলায় তাঁর ডান পা পোলিয়োতে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। তিনি জানতেন, ভারতে কোনও ইংরেজ সম্মত হবে না তাঁকে বিয়ে করতে। তা সত্ত্বেও তাঁর মা তাঁকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন বিয়ের বাজারে ভাগ্যপরীক্ষার জন্য।
কলকাতায় গিয়ে অতি সাধারণ মেয়ের পক্ষেও পতি জোগাড় করা সম্ভব— এ কথা যত বেশি প্রচারিত হতে থাকল, ভারতে মেয়েদের পাঠানোর একটা তীব্র ঝোঁক দেখা দিল ইংল্যান্ডের অভিভাবকদের মধ্যে। একটি মেয়ে অনূঢ়া হয়ে জীবন কাটাবে, এ ছিল তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন। তাই কলকাতায় এসে পতি খুঁজে পাত্রস্থ হওয়া ছিল ব্রিটিশ তরুণী ও তাদের মা-বাবার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। খুব অবাক হতে হয় একটা কথা ভাবলে। সে সময় ব্রিটেনের অভিভাবকরা তাদের কিশোরী মেয়েদের ছ’মাসের সমুদ্রযাত্রার ঝুঁকি নিয়ে পাঠিয়ে দিত ভারতে, অথচ এই সমুদ্রযাত্রা ছিল অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল, প্রতি মুহূর্তে বিপর্যয় ও মৃত্যুর হাতছানি। এই কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দুঃসাহসের পিছনে ছিল একটাই অভিপ্রায়। নির্বিঘ্নে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যদি এক বার সেই বিবাহযোগ্যা মেয়েরা পা রাখতে পারে কলকাতার মাটিতে, নিশ্চিত ভাবে খুঁজে নিতে পারবে পছন্দের জীবনসঙ্গী।
উপর্যুপরি বিয়ে ও জীবনসঙ্গী
আঠারো শতকে কলকাতায় ‘ফিশিং ফ্লিট’-এর আসা হয়ে উঠেছিল একটি সামাজিক ঘটনা। ফিশিং ফ্লিট-এ আসা তরুণীরা কলকাতায় আসামাত্র পেয়ে যেত একাধিক বিয়ের প্রস্তাব। তারা অবাক হয়ে দেখত, ভারতে বিয়ের বাজার ইংল্যান্ডের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইংল্যান্ডে একটি বিবাহযোগ্যা মেয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও পায় না বিয়ের প্রস্তাব। পেলেও অনেককে পিছিয়ে আসতে হয় পাত্রপক্ষের বিশাল অঙ্কের পণের দাবিতে। আর কলকাতায় এক জন ইংরেজ তরুণীকে বিয়ে করার জন্য ইংরেজদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। ‘হার্টলি হাউস’-এর নায়িকা সোফিয়া গোল্ডবোর্ন বিলেতে তাঁর বন্ধুকে লিখেছিলেন, “সমস্ত ইংরেজ তরুণী পুরনো রীতিতে বিয়ের প্রস্তাব পায় এখানকার তরুণদের কাছ থেকে। পরিচিত, অপরিচিত সমস্ত তরুণীর দিকে তারা হাত বাড়িয়ে দেয় তাদের আসনে বসতে সাহায্য করার জন্য। আমাদের এমন চাহিদা নিঃসন্দেহে এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা।” তিনি লিখেছিলেন, তাঁর প্রতি পুরুষরা যে ভাবে আগ্রহ প্রকাশ করে, তাতে তিনি বিস্মিত। “আমার হাসি যেন একটা অর্থ প্রকাশ করে, কথায় বাজে সুর। এক কথায়, কলকাতায় আয়না অপ্রয়োজনীয়… কারণ তোমার চেহারা প্রতিফলিত হয় তোমাকে যিনি দেখছেন, তাঁর আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে।”
কলকাতায় বিবাহযোগ্য ব্রিটিশ তরুণীর অভাবের জন্য বিধবাদেরও অসুবিধে হত না একাধিক বার বিয়ে করতে। বেগম জনসনের প্রথম বিয়ে হয় বারো বছর বয়সে। উনিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন পঞ্চম বার। এমন ঘটনাও ঘটত যে, অসুস্থ স্বামী বেঁচে থাকতেই তার স্ত্রী বাগ্দান সেরে ফেলত অন্য পুরুষের সঙ্গে এই ভরসায় যে, কলকাতার বিরূপ জল-হাওয়ায় স্বামীর মৃত্যু অনিবার্য। ১৭৬৭ সালে জনৈক স্টারনে, শ্রীমতী এলিজ়া ড্রাপারকে লিখেছিলেন, “বিধবা হওয়ার কথা বলছ এলিজা, আমি প্রার্থনা করি, যদি ও রকম কিছু হয়, নিজেকে কোনও ধনীর হাতে তুলে দেওয়ার কথা চিন্তাও কোরো না। আমি তোমাকে বিয়ে করার কথা ভেবে ফেলেছি। আমার স্ত্রী-ও বেশি দিন বাঁচবেন না।”
আঠারো-উনিশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতার ইংরেজদের মধ্যে বিধবাকে বিয়ে করার প্রবণতার পিছনে ছিল অন্য এক কারণ। এই সময় কোনও সিভিলিয়ানের মৃত্যু হলে তার বিধবা পত্নী বঞ্চিত হত না তার প্রাপ্য বছরে তিনশো পাউন্ড থেকে। এমনকি বিধবা দ্বিতীয় বার বিয়ে করলেও। তাই এক জন বিধবাকে বিয়ে করার অর্থ ছিল একই সঙ্গে পত্নী ও অর্থ লাভ।
অর্থ দেখে পাত্র বিচার
অবিবাহিত পুরুষের বিয়ে করার এমন আকুলতা ও অধৈর্য ভাবের সুযোগ নিয়ে অনেক শ্বেতাঙ্গী মেতে উঠত প্রেমের খেলায়। ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত ইলতুদাস প্রিচার্ড-এর ‘ক্রনিকলস অব বাজপুর, অর স্কেচেস অব লাইফ ইন আপার ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে দেখানো হয়েছিল কুমারী সোফি উইলকিনসনের প্রেমের নাটক। তিনি রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন একের পর এক পুরুষকে গ্রহণ ও বর্জন করে। প্রথমে তাঁর বাগ্দান হয় এক যুবক লেফটেন্যান্টের সঙ্গে। তার পর তাকে ছেড়ে দিয়ে মেতে ওঠেন এক জন সিভিলিয়নকে নিয়ে। সেই সম্পর্কও বাতিল করেন। শেষ পর্যন্ত থিতু হন এক জন কালেক্টরকে বিয়ে করে।
ইংল্যান্ড থেকে মেয়েদের কলকাতায় স্বামীর সন্ধানে পাঠানোর সময় তাদের অভিভাবক ও আত্মীয়স্বজন বার বার খেয়াল করিয়ে দিতেন, কলকাতায় গিয়ে যেন তারা কম্বল-সম্বল কোনও ছেলেকে স্বামী হিসেবে নির্বাচন না করে। তাদের বোঝানো হত, দাম্পত্যসুখের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন রুপোর বাসন, পালকি আর এক দল বেহারা যারা বেড়াতে নিয়ে যাবে বিকেলে। আসলে তারা তাদের জীবনে যে লক্ষ্য গড়ে তুলত, তা প্রকাশ পেয়েছে তৎকালীন একটা কবিতায়— “আমি বিশ্বাস করি পোশাক ও আরামে/ আর কেতাদুরস্ত হালচালে,/ আমি বিশ্বাস করি চকচকে মোহরে/ আর সত্যি সত্যি পুজো করি নগদকে/ আমি বিশ্বাস করি বিবাহে/ কিন্তু করি না সব পুরুষকে,/ আমি বিশ্বাস করি/ সিভিল সার্ভিসের লোককে।” কলকাতায় বিয়ের বাজারে সমস্যায় পড়ত এই সব মেয়েরা। তাদের মধ্যে যারা সুন্দরী হত, কলকাতায় পৌঁছে অতিষ্ঠ হয়ে উঠত অবিবাহিত পুরুষদের তোষামোদে। মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা। অহমিকার বশে কয়েক মাসের মধ্যে বাতিল করত একের পর এক এমন সব পাত্র, ইংল্যান্ডে থাকাকালীন যারা ছিল তাদের কাছে স্বপ্নের রাজপুত্র। শেষ পর্যন্ত মা-মাসিদের পরামর্শমতো বিয়ে করে বসত এক জন বয়স্ক ধনীকে যার পা দুটো নড়বড়ে, যে লিভারের অসুখে আক্রান্ত, যার চোখে নেই প্রেমের ঝিলিক। তাই পরে বাধ্য হয়ে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে চরম হতাশায় জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে হত এক জন সাধারণ ক্যাডেটকে, যার কোনও ভবিষ্যৎ নেই।
কমবয়সি পাত্রীর চাহিদা তুঙ্গে
তা সে সাহেবের বয়স যত বেশিই হোক না কেন! ইউরোপ থেকে নবাগত জনৈক গ্রিফিন উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে লিখেছিলেন, কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজে যে কোনও শ্রেণির অবিবাহিত পুরুষ প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের চেয়ে কমবয়সি মেয়েদের পছন্দ করে পত্নীরূপে পেতে। যদিও এক জন পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যবয়সি পুরুষের উপযুক্ত পাত্রী কম করে পঁচিশ বছরের কুমারী, তথাপি সে পছন্দ করে একটি সতেরো বছরের মেয়ে। কলকাতার অরফ্যান গার্লস স্কুলে প্রত্যেক মাসে বল-নাচের যে আয়োজন করা হত, তাতে যোগ দিত ভারতের বিভিন্ন ইংরেজ বসতি থেকে আগত অবিবাহিত সাহেবরা। সেখানে তারা পছন্দমতো তেরো-চোদ্দো, এমনকি বারো বছরের মেয়েকেও নিয়ে যেত বিয়ে করে। দু’টি অসমবয়স্ক নরনারীর মধ্যে বিয়ে একটুও অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না কলকাতার সাহেব সমাজে। কলকাতার সিভিল আর্কিটেক্ট এডুয়ার্ডো টিয়েটা সাতষট্টি বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন চোদ্দো বছরের ফরাসি মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনাকে। বিয়ের পর অ্যাঞ্জেলিনা স্থান পেয়েছিলেন সমাজের উঁচুতলায়। কিন্তু টিয়েটা তাঁকে সন্তান দিতে পারেননি, যা কোনও নারীর জীবনে অন্যতম চাওয়া।
আসলে, উনিশ শতকে বাঙালি সমাজের মতো ব্রিটিশ সমাজে তেমন বাধ্যবাধকতা না থাকলেও অভিভাবকরা উৎসাহী ছিলেন বাল্যবিবাহে। ব্রিটিশ সমাজের এই প্রবণতাকে ব্যঙ্গ করে টমাস হুড একটা কবিতা লিখেছিলেন, “মা-বাবা বলেন আমি হয়েছি বড়/ বয়স হয়েছে বিয়ের/ যদিও সে বয়স অনেক দূরে/ আমি এখনও ছোট।”
ফের চাহিদা ও জোগানের গরমিল
১৮১৩ থেকে ব্রিটিশ ললনাদের ভারতে আসার জোয়ার ফুলে-ফেঁপে ওঠে। এক সময় যা শুরু হয়েছিল মৃদু স্রোতের আকারে, তখন তা পরিণত হয় প্লাবনে। উনিশ শতকের প্রথম থেকেই কুমারী মেয়েদের শত শত আবেদনপত্র জমা পড়তে থাকল পরিচালন সমিতির দফতরে। সব আবেদনপত্রে একই প্রার্থনা— ভারতে, বিশেষ করে কলকাতায় আসার অনুমতি। তাদের অনেককে স্বপ্ন দেখিয়েছিল এই সময়ে রচিত কয়েকটি উপন্যাস। সেগুলির মধ্যে অন্যতম উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারের ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’। এই উপন্যাসে দেখানো হয়, শ্রীমতী হার্ডিমেন তেরো জন বোন ও এগারো জন মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পেরেছিলেন ভারতে পাঠিয়ে। সাত জন বোনেরই বিয়ে হয় কোম্পানির পদস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে।
তবে, আঠারো-উনিশ শতকে কুমারী মেমের চাহিদা সব সময় এক রকম ছিল না। চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ভর করত ফিশিং ফ্লিট-এর আসার উপর। যে বছর ফিশিং ফ্লিট আসত না কোনও কারণে, কলকাতায় কুমারী মেমদের চাহিদা উঠত তুঙ্গে। আর যে বছর ফিশিং ফ্লিট একাধিক বার এসে উপস্থিত হত, সমস্যায় পড়ে যেত তারা। কারণ মেমদের জোগানের তুলনায় হ্রাস পেত চাহিদা। ১৭৭৫ সালের ২১ নভেম্বর ফিলিপ ফ্রান্সিস কলকাতা থেকে লন্ডনে শ্রীমতী ক্লাইভকে লিখেছিলেন, “যে সুন্দরীদের আমাদের সঙ্গে এনেছিলাম, তাদের সকলকে এখনও পাত্রস্থ করা যায়নি। সম্ভবত বাজারে জোগান বড্ড বেশি। দর দেওয়ার লোকের অভাব। মনে হয়, আমাদের উচিত কুমারী আমদানি আপাতত স্থগিত রাখা, অন্তত যত ক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের যা মজুত আছে তার একটা ব্যবস্থা করতে পারি।” এই চিঠির ভিত্তিতে বলা যাবে না যে, ভারতে কুমারী ইংরেজ তরুণীর চাহিদা হ্রাস পেতে শুরু করেছিল ১৭৭০-এর দশক থেকে। কারণ, ১৮৩৪-এ এশিয়াটিক জার্নাল লিখেছিল, “এখনও জোগান চাহিদার সমান নয়।”
অবশ্য অস্বীকার করা যাবে না যে, আঠারো শতক যত গড়াচ্ছিল, বদলে যাচ্ছিল পরিস্থিতি। উনিশ শতকের বিশের দশকে বাষ্পীয় পোত চালু হয়ে গেলে হ্রাস পায় বিলেত থেকে ভারতে আসার সময়। সমুদ্রযাত্রাও নিরাপদ হয়ে ওঠে অনেকটা। ফলে ফিশিং ফ্লিট-এ যে ভাবে দলে দলে কুমারী মেমরা ভারতে আসছিল, তাতে এ দেশে বিয়ের বাজার ছোট হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। বিগত শতকের মধ্যভাগে কলকাতায় সাহেবের তুলনায় মেমদের সংখ্যা কম থাকায় সাহেবরা বিয়ে করার জন্য বাছাবাছি করতেন না তেমন। বরং সেটা করতেন মেমরা, কারণ সে সুযোগ ছিল তাঁদের।
উনিশ শতকের প্রথম লগ্ন থেকে দেখা গেল, হাওয়া বইছে উল্টো দিকে। মেমদের পছন্দমতো স্বামী খুঁজে নেওয়ার সুযোগ হ্রাস পেয়েছে অনেকটা। এমা রাংহ্যামের মতো অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারী মেমরা হয়তো ঝপ করে নজরে পড়ে যেতেন কোনও পদস্থ সিভিলিয়ানের। এমা স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন সিভিলিয়ান জন ব্রিস্টোকে। তাঁর মতো সুন্দরীর সুযোগ ছিল পছন্দমতো জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার। কিন্তু সে সুযোগ ছিল না সেই সব তরুণীর, পাত্রী হিসেবে যারা নিম্নমানের।
মা-বাবারা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেও অনেক মেয়ে বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকত না মানসিক ভাবে। কিছু অভিভাবক এ দেশে এসে ভাগ্য ফেরাতে পেরেছিলেন, সঞ্চয় করেছিলেন যথেষ্ট পরিমাণ অর্থসম্পদ, তাঁরা চাইতেন বিলেতে ফিরে গিয়ে বাকি জীবন বিলাসে ও আরামে কাটাতে। কিন্তু তাঁদের এই ইচ্ছেপূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াত তাঁদের অবিবাহিত মেয়ে। তাই দায়মুক্ত হওয়ার জন্য মেয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করতেন বিয়ে করার। তাঁরা মেয়ের সঙ্গে আলোচনা না করেই পাত্র ঠিক করে ফেলতেন ভাল-মন্দ বিচার না করে। মেয়েকে বলা হত, একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, তাকে সম্মতি দিতে হবে। পরিস্থিতির চাপে মেয়েটিকে পালন করতে হত এই নির্দেশ। জোসেফ ফোক-এর মেয়ে সোফিয়া আসতে চাননি ভারতে বরের অন্বেষণে। শেষ পর্যন্ত সম্মত হতে বাধ্য হন অভিভাবক ও আত্মীয়স্বজনের চাপে। কিন্তু প্রচণ্ড অভিমানে তাঁর কাকাকে লিখেছিলেন, “এটাই যদি একমাত্র লক্ষ্য মনে করা হয় আমার জীবনে, তবে আমি রাজি। যদি আমার আত্মীয়স্বজন এটাই চায়, আমি বাধিত করব তাদের।”
সমুদ্রের বড় মাছ
ইংল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরাও কলকাতায় আসত বরের খোঁজে। আইসিএস-রা ছিল ভারতে ব্রিটিশ সমাজে অভিজাত শ্রেণি। তাই বিয়ের জালে তাদের ধরার চেষ্টা করা হত ‘বড় সামুদ্রিক মাছ’ হিসেবে। সামরিক অফিসাররাও পাত্র হিসেবে ছিল বেশ ওজনদার। সেনাবিভাগে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল অশ্বারোহী বাহিনীর অফিসাররা। এই সব অফিসার ছিল ইংল্যান্ডের ধনী পরিবারের সন্তান। তাদের পোশাক ছিল জমকালো। কোমরবন্ধ, মাথায় উষ্ণীষ, ব্রিচেস এবং ঝকঝকে চামড়ার বুট পরে তারা যখন সওয়ার হত ঘোড়ার পিঠে, হলুদের উপর ঘন নীল ও সোনালি বর্ডার দেওয়া জ্যাকেট পরা তাদের চেহারা কুমারী মেমদের চোখে বুলিয়ে দিত রোম্যান্সের পালক।
তবে, কলকাতায় আসা ইংল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত রমণীদের কাছে সবচেয়ে লোভনীয় পাত্র ছিল ভাইসরয়ের পার্শ্বচর ও তাঁর ব্যক্তিগত সচিবরা। এমনকি, বড়লাট-ছোটলাটের কাছেও তারা ছিল জামাতা হিসেবে কাঙ্ক্ষিত। মেরি ডু কাউরয় ট্রাইব ইংল্যান্ডে জন্মেছিলেন ১৮৬৫-তে। তিনি ছিলেন রেভারেন্ড ওয়াল্টার ট্রাইবের মেয়ে। তিনি ষোলো বছর বয়সে ভারতে আসেন। সমাজের উঁচুতলার আদব-কায়দা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হলেও অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। উনিশে পা দিতেই চুম্বকে পরিণত হলেন অনেক তরুণের। ১৮৮৬-তে তিনি কলকাতা ছেড়ে বাবার সঙ্গে গেলেন শিমলায়। শিমলা শুধু ধনী ও অভিজাত ইউরোপীয়দের অবসর কাটানোর শৈলাবাসই ছিল না, প্রেম নিবেদনের স্থান বলেও পরিচিত ছিল তাদের কাছে। সেখানে এক পার্টিতে মেরির প্রেমে পড়লেন বড়লাট ডাফরিনের পার্শ্বচর, সাতাশ বছরের লর্ড হারব্রান্ড রাসেল। হারব্রান্ডের কোনও সংশয় ছিল না যে, বড়লাট তাঁকে পার্শ্বচর পদে নিয়োগ করেছেন তাঁর দু’টি অবিবাহিতা কন্যার কথা ভেবে। কিন্তু ডাফরিন-দম্পতিকে হতাশ করে কলকাতায় ফিরে হারব্রান্ড ও মেরি আবদ্ধ হলেন বিবাহবন্ধনে। এর পরিণামে হারব্রান্ডের কী হয়েছিল, তা অবশ্য জানা যায় না।
বিয়ে নয়, লক্ষ্য স্বাধীনতা
বিশ শতকে পা দিয়েও ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ সমাজ উদ্ধার পায়নি মেয়েদের বিয়ের সমস্যা থেকে। কারণ, স্বাধীনতা ভোগের প্রতি মেয়েদের তীব্র স্পৃহা। সেটা প্রকট হয়ে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। কিন্তু তাদের অবাধ স্বাধীনতা ভোগের প্রবণতার পরিণামে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না রক্ষণশীল ব্রিটিশ সমাজ। মার্গারেট লুসি চোলেট ডি জ্যাসি-র ডাক নাম ছিল বেবি। ফ্রান্সে জন্ম। থাকতেন ইংল্যান্ডে। ধনী পিতার সন্তান। তার মা প্রতি গ্রীষ্মে ফ্রান্সের ব্রিটানির সমুদ্রতটে যেতেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে। বেবি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছিলেন অতিরিক্ত স্বাধীনতা পেয়ে। পঁচিশ পেরিয়ে গেলেও বিয়ে হয়নি তাঁর। অথচ তিনি অপরূপ সুন্দরী, স্বর্ণকেশী, মোহময় দু’টি চোখ। কিন্তু বাঁধনছাড়া স্বাধীনতার জন্য কেউ আগ্রহী হয়নি। বাধ্য হয়ে তাঁর মা তাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন বড় মেয়ের কাছে, যদি সেখানে কোনও পাত্র জুটে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত ইংল্যান্ডের মেয়েদের জীবনে একমাত্র লক্ষ্য ছিল জায়া ও জননী হওয়া। তাই অভিভাবকরা মেয়েদের পাঠিয়ে দিতেন কলকাতায়, সে মেয়ে সুন্দরী বা কুৎসিত, শিক্ষিতা বা অশিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী বা বুদ্ধিহীনা— যেমনই হোক। কিন্তু এ দেশে বিয়ের বাজারে মেয়েদের যোগ্যতার মাপকাঠির ক্রমশ পরিবর্তন ঘটছিল ১৮৫০-এর পর থেকেই। সিভিলিয়ানদের চাহিদা ও রুচি বদলে যাচ্ছিল। ইথেল স্যাভি কলকাতায় জন্মেছিলেন মহাবিদ্রোহের পর। তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন, বিশ শতকে মেয়েদের যোগ্যতা হিসেবে পিয়ানো বাজানোকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গা দখল করে নিয়েছিল টেনিস ও গল্ফ খেলা। ইংল্যান্ডের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের সুযোগ ছিল না এই অভিজাত খেলায় দক্ষ হয়ে ওঠা। ফলে দেখা গিয়েছে, ১৯৩৬-এও ফিশিং ফ্লিটে আসা অনেক ব্রিটিশ ললনা নিরাশ হয়ে ‘হোমে’ ফিরে যাচ্ছে বরমাল্য না পেয়ে।