চা আড্ডারও আছে উপকারিতা। প্রতীকী ছবি।
লকডাউনে পাড়ার দোকান থেকে চা খেতে বেরিয়ে বিশ্ব জোড়া ট্রোলিংয়ের শিকার হয়েছিলেন চার নিরীহ বঙ্গজ। সচেতনতা আর সুরক্ষাবিধির কথা উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু খবরের কাগজ নিয়ে সকাল সকাল চায়ের কাপে ঠোঁট না ঠেকানোর যন্ত্রণাটা বোঝেননি অনেকেই। তবে এ বার বাঙালির সেই চা-আ্ড্ডা কালচারেই পড়ল গবেষণার সিলমোহর। জানা গেল, চায়ের কাপে তুফানি আড্ডা শুধু মন ভাল রাখে না, বাড়ায় আমাদের ‘কগনিটিভ স্কিল’ অর্থাৎ মেধা ক্ষমতাকেও।
বিশেষ করে যাঁরা বয়স্ক, একাকীত্বে ভুগছেন। তাঁদের কাছে দিনে কয়েক কাপ চা আর তার সঙ্গে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা হয়ে উঠতে পারে বিশল্যকরণী। তাঁদের ভাবনাচিন্তা, যুক্তি, মনসংযোগ— সবেতেই আসতে পারে ইতিবাচক পরিবর্তন। এমনকি যে কোনও বিষয়ে তাঁদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াতেও দ্রুততা আনতে পারে নিয়মিত চা-পান।
গবেষণা যা বলছে
২০০৬ সাল থেকে এই বিষয়ে গবেষণা করছে নিউ কাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান নিউট্রিশন রিসার্চ সেন্টার প্রজেক্ট। গবেষণার প্রধান, চিকিৎসক এডওয়ার্ড ওকেলো জানাচ্ছেন, গত ১৫ বছর ধরে ৮৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন তাঁরা। আর তা থেকে সামনে এসেছে চা-পান সংক্রান্ত অভিনব সব তথ্য। দেখা গিয়েছে, এই বয়সি যে সমস্ত ব্যক্তি চা-প্রেমী ও নিয়মিত অন্তত পাঁচ কাপ করে চা পান করেন, তাঁরা মেধা আর মননে সমবয়সিদের থেকে অনেকটা এগিয়ে।
যদিও এর নেপথ্যে চায়ের উপাদান সংক্রান্ত উপকারিতা যত না কাজ করছে, তার চেয়ে চা বানানো আর চা নিয়ে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে গল্প-আড্ডা দেওয়ার অভ্যাসই বেশি প্রভাব ফেলেছে বলে মত চিকিৎসক ওকেলোর। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, নিয়মিত চা-পানকারীদের মনসংযোগ যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে গতি। এমনকি গাড়ি চালানো, শব্দছক, সুদোকুর সমাধানের ক্ষেত্রেও চা-প্রেমীদের দক্ষতা বাকিদের তুলনায় বেড়েছে বলে জানিয়েছে নিউ কাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা।
মনোবিদ বলছেন
মনোবিদ জয়িতা সাহার কথায়, যে কোনও সামাজিক মেলামেশাই আমাদের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। চায়ের আড্ডা নিঃসন্দেহে সেই সামাজিক মেলামেশার অনেকটা সুযোগ করে দেয়। অতিমারিতে আমরা দেখেছি, অনেকেই বাড়ি-বন্দি হয়ে পড়ায়, একা হয়ে পড়ায় মানসিক উদ্বেগের শিকার হচ্ছিলেন, হতাশায় ভুগছিলেন। এখনও অনেকেই বাড়ি থেকে বেরতে ভয় পাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে দিনে বার কয়েক যদি চা-খাওয়ার সূত্র ধরেই দু’একজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়, সে বন্ধুবান্ধব হোক বা সম্পূর্ণ অচেনা কেউ— তা হলেও তার পজিটিভ এফেক্ট আছে। এটা আমাদের ভাল থাকায় প্রভাব ফেলে। আমাদের ভাল থাকতে সাহায্য করে। আর আমাদের মেধা, দক্ষতা, সার্বিক ক্ষিপ্রতা, মনসংযোগ— সবই নির্ভর করে এই ভাল থাকার উপর।
পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্র বিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শ্রীময়ী তরফদার। কগনিটিভি স্কিল বা মেধা সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মনোবিদ তিনি। জানাচ্ছেন, যে কোনও বৌদ্ধিক কার্যকলাপকে আমরা কগনিটিভ স্কিল বলি। এই কগনিটিভ স্কিল নানা কারণে বাড়তে পারে। ‘‘স্কুলে যে শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে আমাদের পছন্দ হত, তাঁদের বিষয়টি আমরা বেশি ভাল করে পড়তাম। এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই। চা তো আমরা অচেনা অজানা মানুষের সঙ্গে খেতে যাই না। আমাদের কাছের বন্ধুদের সঙ্গে, যাদের সঙ্গে একটু গল্প করা যায়, মনের কথা বলতে ভাল লাগে, তাদের সঙ্গেই বসে চা-খাই আমরা।’ শ্রীময়ীর মতে, এই ভাল লাগাটাই আমাদের মনে প্রভাব ফেলে। একটা পজিটিভিটি তৈরি করে। আর এই ইতিবাচক পরিবেশই আমাদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
আরও একটা বিষয় আছে। শ্রীময়ীর মতে, ‘‘চা বানানোর প্রক্রিয়াও, এখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চা হল একটা ‘পারসোনালাইজড ড্রিঙ্ক’। সবাই এক রকম চা খান না। কেউ আদা দিয়ে, কেউ চিনি ছাড়া, কেউ দুধ-চিনি দিয়ে, কেউ স্রেফ ব্ল্যাক টি। এই যে যত্ন করে এক একজনের জন্য পছন্দ মাফিক চা বানিয়ে দেওয়া, এরও তৃপ্তি আছে। আবার কেউ আপনাকে আপনার পছন্দ অনুযায়ী চা বানিয়ে দিচ্ছে, এই ভাবনাতেও একটা ভাল লাগা আছে। ‘আমাদের ফুচকা খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে ব্যাপারটার।’’ বলছেন শ্রীময়ী। ফুচকায় পারফেক্ট টেস্ট পেতে আমরা একের পর এক পছন্দের কথা বলতেই থাকি। কারও ঝাল বেশি, কারও টক বেশি। কারও নুন চাই, কেউ চান মিষ্টি জল দিয়ে... সেই সব অনুরোধ মেনে তৈরি হওয়া বস্তুটি যখন হাতে আসে, অনাবিল আনন্দ বোধ হয়। চায়ের ক্ষেত্রেও সেই আনন্দ বোধ তৃপ্ত করে আমাদের। চায়ের আড্ডা তৈরি করে পজিটিভ পরিবেশ। আর এই পজিটিভিটিই আমাদের ধীর গতিকে কাটিয়ে দেয়। চটপটে করে তুলতে পারে।
পুষ্টিবিদের কথায়
‘‘এই চা কিন্তু, ব্ল্যাক টি। কালো চা-এ থাকে প্রচুর পরিমাণে পলিফেনলস। যা এক ধরনের জোরালো অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এই অ্যান্টি অক্সিডেন্টের কাজ হল ক্ষতিগ্রস্ত কোষকে মেরামত করা বা ক্ষতি প্রতিরোধ করা।’’ বলছিলেন পুষ্টিবিদ ইন্দ্রাণী ঘোষ। তাঁর কথায় চায়ে এমন অনেক উপাদান আছে, যা আমাদের খারাপ কোলেস্টেরলেক দূরে রাখে। হার্ট ভাল রাখে। রক্তে শর্করা কোলেস্টেরল কমিয়ে পুরনো রোগকেও দূরে রাখে। পেট সংক্রান্ত সমস্যাও কমায় বলে জানাচ্ছে গবেষণা। ইন্দ্রাণীর কথায়, শরীর ভাল থাকার একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে মনের উপরও। সেই ভাল থাকাই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে।