টানা এক বছর আন্দোলনের পরে মোদী সরকারকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করল
গত সাত বছরে তাঁরা যে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষ কোনও আন্দোলন খাড়া করতে পারেননি, তা মানেন কংগ্রেস-সহ গোটা বিরোধী শিবিরের নেতারাই। বিরোধীরা যা পারেননি, কৃষক সংগঠনগুলি সেটাই করে দেখাল। টানা এক বছর আন্দোলনের পরে মোদী সরকারকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করল। সরকারের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের জয় হল।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ভারতের গণতন্ত্রে এ এক নতুন মাইলফলক। এত দিন নাগরিক সমাজের আন্দোলন বলতে বোঝাত সমাজের শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিবাদ। সিএএ-র বিরুদ্ধে শাহিন বাগের আন্দোলন থেকে দিল্লির সীমানায় কৃষকদের আন্দোলনে দেখা যাচ্ছে, সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবাদ। তথাকথিত নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ, আমজনতার আন্দোলন মিশে সেটাই প্রধান বিরোধীর ভূমিকা নিচ্ছে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পলিটিকাল স্টাডিজ়ের অধ্যাপক দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘নাগরিক সমাজ বলতে এত দিন শহুরে এলিট শ্রেণি বোঝাত। কৃষকদের আন্দোলনে নাগরিক সমাজ শুধু সেখানেই আটকে নেই। তা আরও ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি যখন দুর্বল, তখন প্রচণ্ড কেন্দ্রীভূত এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই মানুষের জোটই প্রধান বিরোধী
হয়ে উঠছে। তারাই সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।’’
শুধু সমাজবিজ্ঞানীরা নন। সনিয়া, রাহুল গাঁধী, সীতারাম ইয়েচুরি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, উদ্ধব ঠাকরেও আজ কৃষকদের কুর্নিশ জানিয়েছেন। সনিয়ার মতে, আশা করা যায় এ থেকে মোদী সরকার শিক্ষা নেবে। কৃষকদের খোলা চিঠি লিখে অভিনন্দন জানিয়ে রাহুল মনে করিয়েছেন, তিনি গত জানুয়ারিতেই বলেছিলেন, কেন্দ্র কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে। ঠাকরের মতে, কৃষি আইন প্রত্যাহার সাধারণ মানুষের ক্ষমতার প্রতীক। রাজনৈতিক শিবির বলছে, আন্দোলনের চাপের মুখে মোদীকেও যে পিছু হঠতে হয়, আজ প্রমাণ হয়ে গেল।
তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পরে গত এক দশকে কৃষক আন্দোলনের সবথেকে বড় জয় বলে মনে করা হচ্ছে। তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রধান অভিযোগ ছিল, গোটা কৃষি ক্ষেত্র কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। অম্বানী-আদানির মতো কর্পোরেট সংস্থাকে ফায়দা পাইয়ে দিতেই এই আইন। পাল্টা মোদী সরকারের মন্ত্রীরা বলে গিয়েছেন, কৃষকরা আইনের খুঁটিনাটি বুঝতে পারছেন না। তাঁদের কোথায় আপত্তি, তা-ও বলতে পারছেন না। কিন্তু কৃষক নেতারা নিজেদের অবস্থান থেকে নড়েননি।
কৃষক নেতাদের সামনে একাধিক চ্যালেঞ্জ ছিল। এক, মোদী সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি। দুই, ৫০০-র বেশি সংগঠনকে এক ছাতার তলায় এনে সমন্বয় বজায় রাখা। তিন, কৃষক আন্দোলনের মঞ্চকে পুরোপুরি অরাজনৈতিক রাখা। চার, কোনও রকম পুলিশি পদক্ষেপ, হিংসার প্ররোচনায় পা না দেওয়া। সিংঘু, টিকরি, গাজিপুর— দিল্লির সীমানায় আন্দোলনে বসার পরে বিজেপি শিবির কৃষক আন্দোলনের পিছনে খলিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা রয়েছে বলে প্রচার করেছে। কৃষকদের মিছিল থেকে লাল কেল্লায় হিংসা ছড়ানোর ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকারীদের হঠানোর চেষ্টা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে কৃষক নেতাদের আন্দোলনজীবী বলে কটাক্ষ করেছেন। তার পরেও অনড় থেকেছেন কৃষক নেতারা। তাঁরা বরং কৃষকদের আন্দোলনে শ্রমিকদের জুড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
আজ কৃষক নেতারা জানিয়েছেন, তাঁরা সংসদে আইন প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তার পরে কী হবে, তা রবিবার বৈঠকে ঠিক হতে পারে। কিসান সভার নেতা হান্নান মোল্লা বলেন, ফসলের এমএসপি-র আইনি গ্যারান্টি দিতে হবে। কয়েকটি কৃষক সংগঠন অবশ্য কৃষি আইন প্রত্যাহারকে জয় মেনে নিয়েই আন্দোলন তুলে নেওয়ার পক্ষে।
মনমোহন সরকারের আমলে অণ্ণা হজারের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে নাগরিক সমাজ অংশ নিয়েছিল। তার ফায়দা তুলেছিল বিজেপি। এ বার মোদী সরকারের বিরুদ্ধে জনতার আন্দোলনের ফায়দা কে পাবেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে সব দলই কৃতিত্ব নিতে মাঠে নামছে।