বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী-মুখ বলে ঘোষণা করেনি বিজেপি।
বয়স ৪৯ বছর। আমেরিকান অভিনেতা মার্ক সিনক্লেয়ারের সঙ্গে মুখাবয়বের আশ্চর্য সাদৃশ্য। মার্ক সিনক্লেয়ার, যাঁকে সারা বিশ্ব চেনে ভিন ডিজেল নামে। তবে যোগী আদিত্যনাথের চেয়ে তিনি বছর পাঁচেকের বড়। উচ্চতাও খানিক বেশি।
ভিন ডিজেল ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস’ সিরিজের ছবিতে অভিনয়ের জন্য প্রসিদ্ধ। আর যোগী উত্তরপ্রদেশে প্রসিদ্ধ তাঁর ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস’ কর্মপদ্ধতির জন্য। গত পাঁচ বছরে উত্তরপ্রদেশের মুণ্ডিতমস্তক, গেরুয়াধারী এবং দু’কানে সোনার স্বাস্থ্যবান দুল পরিহিত মুখ্যমন্ত্রী যা যা করেছেন, সেই কর্মপদ্ধতিকে ‘দ্রুত এবং ক্রুদ্ধ’ বলা যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, ‘অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড’ বা ১০০ জন পুলিশ অফিসারকে সাসপেন্ড করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত হেলাফেলায় নিয়েছেন আদিত্যনাথ।
পূর্বাশ্রমের নাম অজয় মোহন বিস্ত। বাবা ছিলেন ফরেস্ট রেঞ্জার। চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান অজয় অঙ্কশাস্ত্র নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৯০ সালে রামমন্দির আন্দোলনের সময় ঘর ছাড়েন। তার পর থেকে তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু গোরক্ষপুরের গোরক্ষনাথ মঠের অধ্যক্ষ মহন্ত অবৈদ্যনাথ। যাঁর তিরোধানের পর যোগীই ‘মঠাধীশ’ হয়েছিলেন। সেখান থেকে সটান ঝাঁপ রাজনীতিতে। দ্বাদশ লোকসভায় যখন গোরক্ষপুর কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন আদিত্যনাথ, তখন তাঁর বয়স মাত্রই ২৬ বছর। বস্তুত, দ্বাদশ লোকসভায় তিনিই ছিলেন কনিষ্ঠতম সাংসদ। পর পর পাঁচবার গোরক্ষপুর থেকে জিতেছিলেন।
লোকসভার তথ্য বলছে, সেখানে আদিত্যনাথের উপস্থিতির হার ৭৭ শতাংশ। ২৮৪টি প্রশ্ন করেছেন। ৫৬টি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু সে সব তো সংসদের তথ্যে নথিবদ্ধ থাকবে। আদিত্যনাথের আসল উত্থান পূর্ব উত্তরপ্রদেশে ‘হিন্দু যুব বাহিনী’র সওয়ার হয়ে। সেই ডাকাবুকো এবং ডোন্ট কেয়ার বাহিনীকে নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। থানা-পুলিশও হয়েছে। কিন্তু হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার ‘চ্যাম্পিয়ন’ আদিত্যনাথের সেই বাহিনীকে রোখা যায়নি। তারা লোকের হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল। সেই বাহিনীই জন্ম দিয়েছিল সংগঠক আদিত্যনাথের। জন্ম দিয়েছিল এক তারকা বক্তারও। যা তাঁকে কালক্রমে লোকসভা এবং শেষমেশ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে পৌঁছে দিয়েছে।
তার মধ্যেই আদিত্যনাথের কেরিয়ার ছুঁয়ে গিয়েছে তাঁর ‘কট্টর হিন্দুত্ব’-এর লাইন নিয়ে বিজেপি-র সঙ্গে অবনিবনা, তার জেরে ভোটে বিজেপি-র বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করানোর মতো ঘটনাও। কিন্তু হিন্দু যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগীর জনপ্রিয়তা, খরখরে গলায় তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ তাঁকে গিলতে বাধ্য করেছিল বিজেপি-কে। ২০১৭ সালে বিপুল আসন নিয়ে বিজেপি উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যোগীকে মুখ্যমন্ত্রী করায় একটা বিস্ময় যে তৈরি হয়নি, এমন নয়। কিন্তু যোগীর ব্যক্তিগত সততা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না (এখনও নেই)। পাঁচ বছরের শাসনকালে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আমলাদের কাজকর্মে স্বাধীনতা দিয়েছেন বলেই শোনা যায়। অন্তত পশ্চিমবঙ্গের এক প্রবীণ আমলার লখনউয়ে কর্মরত ব্যাচমেটের কথা বিশ্বাস করতে হলে।
কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে দেশের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্যের (২০১২ সালে লোকসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ২০ কোটি) বিধানসভা ভোটে সেই যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রীর ‘ঘোষিত মুখ’ নন। গত বারও ছিলেন না। মুখ্যমন্ত্রিত্বের দৌড়ে আগুয়ান একাধিক সতীর্থকে রুখে দিয়ে লখনউয়ের কালিদাস মার্গের বাসিন্দা হন আদিত্যনাথ। কথিত যে, স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীর কাছ থেকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ইঙ্গিত পেয়ে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছিলেন মনোজ সিংহ। কিন্তু পরে দেখা যায়, ‘বিশ্বনাথ’-এর থেকে ‘গোরক্ষনাথ’ অনেক বেশি জাগ্রত। আদিত্যনাথকেই ‘গিলতে’ বাধ্য হয়েছিলেন মোদী। মনোজ এখন জম্মু ও কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর।
আরও একজনের নাম প্রবল ভাবেই সামনে ছিল। তিনি কেশব প্রসাদ মৌর্য। যোগী আদিত্যনাথের উপমুখ্যমন্ত্রী হন শেষ পর্যন্ত। আদিত্যনাথ তাঁর শাসনকালের পাঁচ বছর নানা বিতর্কে দীর্ণ থেকেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত স্তরে আদিত্যনাথের সততা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি।
তবু আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশে এ বার মুখ্যমন্ত্রীর ‘ঘোষিত’ মুখ নন। ভোটের উত্তরপ্রদেশে এটা যেমন এক নম্বর প্রশ্ন যে, বিজেপি ক্ষমতা থেকে চলে যাবে না থাকবে, তেমনই প্রশ্ন হল— যোগী আদিত্যনাথ থাকবেন না যাবেন?
লোকে বলবে, এ আবার কেমন প্রশ্ন! বিজেপি থাকলে আদিত্যনাথ থাকবেন। বিজেপি না-থাকলে আদিত্যনাথ থাকবেন না। এ তো সহজ বিষয়।
এবং মোটেই সহজ নয়।
বিজেপি উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় না ফিরলে আদিত্যনাথ লখনউয়ের তখ্তে ফিরবেন না, এটা তো সহজই। কিন্তু মোচড়টা হল, বিজেপি ক্ষমতায় ফিরলেও আদিত্যনাথ না-ও ফিরতে পারেন। এর কারণ হিসেবে মোটামুটি তিনটি কথা শোনা যাচ্ছে। প্রথমত, আদিত্যনাথের উপর ইদানীং বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব খুব সন্তুষ্ট নন। কারণ, আদিত্যনাথের কারণে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ উত্তরপ্রদেশে প্রচুর সমস্যায় পড়েছেন। রাজ্যের ক্ষমতায় ফিরলেও আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হলে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে আগামী দু’বছর উত্তরপ্রদেশে আদিত্যনাথ আরও বড় ‘বোঝা’ হয়ে উঠতে পারেন। দ্বিতীয়ত, আদিত্যনাথ তাঁর পাঁচ বছরের শাসনকালে দলিতদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের জনতার একাংশ প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেছে যে, এটা ঠাকুরদের সরকার হয়ে গিয়েছে। এ বার ‘ঠাকুররাজ’ হটাতে হবে। তৃতীয়ত, যোগী যে ঠাকুর এবং ক্ষত্রিয়দের পছন্দ করেন, তা তিনি খোলাখুলিই বলেন। যে কারণে যোগীকে সমাজে একটা বড় অংশ অপছন্দও করে। সেই কারণেই, বিজেপি ফিরলেও আদিত্যনাথ ফিরবেন এমনটা নাকি এখনই বলে দেওয়া যাচ্ছে না।
উত্তরপ্রদেশে মোট সাত দফায় ভোট। প্রথম দফা হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি। ৫৮টি আসনে। দ্বিতীয় দফায় ৫৫টি আসনে ভোট হয়েছে সোমবার। সমাজবাদী পার্টি শিবিরের দাবি, প্রথম দফায় বিজেপি-র ফল ভাল হবে না। দ্বিতীয় দফায় যে ৫৫টি আসনে ভোট হয়েছে, সেগুলি মুসলিম অধ্যুষিত। ফলে সেখানেও বিজেপি-র ফল ভাল হবে না বলেই তাদের দাবি। মাসদুয়েক আগেও বিজেপি নেতারা বলছিলেন, হাসতে হাসতে জিতবেন। কিন্তু প্রথম দু’দফার পর ব্যাপারটা নাকি আর অত সহজ নেই। বিজেপি আর অতটা আত্মবিশ্বাসী নয়। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘প্রথম দফায় যে ভোট হয়েছে, সেটা নিয়ে সকলেই সকলের মতো অঙ্ক কষেছে। দ্বিতীয় দফাতেও তা-ই। এখনও পাঁচ দফা বাকি। দেখা যাক!’’ বিরোধী শিবিরের দাবি, প্রথম এবং দ্বিতীয় দফায় বিজেপি নাকি ২০ থেকে ২৫টা আসন হারাবে। প্রতিটি দফায় যদি বিজেপি ২০-৩০টা করে আসন হারায়, তা হলে তারা প্রায় ২০০ আসন হারবে।
তবে আরও পাঁচ দফা ভোট যে বাকি, সেটাও বিরোধী শিবির জানে। যেমন তারা জানে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং বিনে পয়সার আনাজ দেওয়ার জন্য মহিলারা বিজেপি-কে ঢেলে ভোট দিতে পারেন। আবার চাকরি-বাকরি না-থাকায় যুব সম্প্রদায়ের ভোট যাবে বিজেপি-র বিরুদ্ধে।
৪০৩টি আসনের বিধানসভায় সরকার গড়তে চাই ২০২টি আসন। সেখানে বিজেপি গতবার জোটসঙ্গীদের ছাড়া একাই পেয়েছিল ৩১২। সমাজবাদী পার্টি ৪৭ আসন পায়। জোটসঙ্গী কংগ্রেস ৭ এবং আরএলডি ১। মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি পেয়েছিল ১৯টি আসন। এ বার আড়াআড়ি লড়াই বিজেপি বনাম সমাজবাদী পার্টির জোট। আলাদা আলাদা লড়তে নামা মায়াবতী আর কংগ্রেসের সম্ভাবনার কথা কেউই মুখে আনছেন না। পদ্মশিবির অবশ্য মনে করছে, গতবারের মতো বিপুল আসন না-পেলেও সরকার হয়ে যাবে। অন্তত ২৩০ থেকে ২৫০ আসন শেষপর্যন্ত হয়ে যাবে।
এ তো গেল আসনের খতিয়ান। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ গত পাঁচ বছরে গোটা দেশের রাজনীতিকে যে ভাবে আন্দোলিত করেছে এবং আলোড়িত করেছে, তা অন্যান্য কোনও রাজ্যের ক্ষেত্রে হয়নি। গত পাঁচ বছরে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন প্রান্ত জুড়ে রয়েছে ভারতীয় রাজনীতির বিভিন্ন মাইলফলক।
‘উত্তরপ্রদেশের ভোট-বুক’ সিরিজে আনন্দবাজার অনলাইন সেই সমস্ত দিকচিহ্ন ছুঁয়ে দেখার যাত্রা শুরু করল দেশের রাজধানী থেকে। (চলবে)
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)