Narendra Modi

সংসদে সংখ্যা দিয়ে আইন পাশ করিয়েও ২৬ মাসে দু’বার পিছু হটল মোদী সরকার, কী তার কারণ?

দিল্লির উপকণ্ঠে নজিরবিহীন কৃষক আন্দোলন দেখেছিল গোটা দেশ। যা রাজধানীকেও আন্দোলিত করেছিল। যেমন গত কয়েক দিনে ট্রাকচালকদের আন্দোলনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সারা দেশের পণ্যপরিবহণ।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১৬:৪৬
Truck Driver’s Protest

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —পিটিআই।

২০২১ সালের নভেম্বর— প্রথম বার পিছু হটেছিল মোদী সরকার। প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছিল তিনটি ‘বিতর্কিত’ কৃষি আইন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি— ট্রাক চালকদের আন্দোলনে ন্যায় সংহিতার নির্দিষ্ট একটি ধারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার। তার পরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, সংসদে সংখ্যার জোরে বিল পাশ করিয়ে নিলেও মাঠে-ময়দানে আন্দোলনের সামনে কি মাথা ঝোঁকাতে হচ্ছে মোদীর সরকারকে?

Advertisement

দিল্লির উপকণ্ঠে টিকরি সীমান্তে নজিরবিহীন কৃষক আন্দোলন দেখেছিল গোটা দেশ। ‘অন্নদাতা’দের টানা আন্দোলন রাজধানীকেও আন্দোলিত করেছিল। সেই আন্দোলন কখনও কখনও ‘নিরামিষ’ থেকে ‘আমিষ’ হয়েছিল। ২০২১ সালের ১৫ অগস্ট লালকেল্লায় ঢুকে পড়ে হইহই ফেলে দিয়েছিল আন্দোলনরত কৃষকদের একটি অংশ। সেই আন্দোলনকে বিজেপির কোনও কোনও নেতা কটাক্ষ করেছিলেন। কেউ আবার নরম স্বরেই বলেছিলেন, আইন বদলানো যায় না। গেরুয়া শিবিরের পক্ষ থেকে এ-ও অভিযোগ করা হয়েছিল, ওই আন্দোলনে বিদেশের টাকা রয়েছে। বাইরের শক্তি ভারতকে ‘অস্থির’ করতে চায়। কিন্তু শেষমেশ আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল কেন্দ্র।

সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে ন্যায় সংহিতা বিল পাস করিয়ে তাকে আইনে পরিণত করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। যে অধিবেশনে গণ সাসপেনশনের মাধ্যমে সংসদ কার্যত বিরোধীশূন্য হয়ে গিয়েছিল। বিরোধীদের বক্তব্য, বিতর্ক, আলোচনা এড়িয়ে আইন পাশ করতেই সংসদ ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছিল বলে বিরোধীপক্ষের অভিযোগ। তার পরে পাশ করানো হয়েছে ‘অন্যায় সংহিতা’। কিন্তু সেই আইন পাশ হলেও গত কয়েক দিন ধরে ট্রাকচালকদের আন্দোলনে স্তব্ধ হয়ে যায় সারা দেশের পণ্য পরিবহণ। যার আঁচ পড়েছিল স্বয়ং মোদীর রাজ্য গুজরাতের বন্দর এলাকাতেও। শেষমেশ বুধবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অজয় ভল্লা পরিবহণ সংগঠনগুলির সঙ্গে বৈঠকে বসে আশ্বাস দেন, ন্যায় সংহিতার ১০৬/২ ধারা আলোচনা না করে কার্যকর করা হবে না। যে ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাকচালকেরা কাউকে চাপা দিয়ে পালিয়ে গেলে ১০ বছরের জেল ও সাত লক্ষ টাকা জরিমানা হবে। ট্রাকচালকেরা ‘অন্যায়’ সম্পর্কে বলেছেন, দুর্ঘটনা ঘটলে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁদের উপায় থাকে না। নচেৎ গণপিটুনিতে তাঁদেরও প্রাণ যাবে।

কী কারণে দু’টি ক্ষেত্রে পিছু হটতে হল আপাতদৃষ্টিতে ‘জনপ্রিয় এবং প্রতাপান্বিত’ মোদী সরকারকে?

লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতা অধীর চৌধুরীর কথায়, ‘‘সঠিক দাবিতে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন হলে খাতায়কলমে প্রতাপশালী নরেন্দ্র মোদী সরকারকেও মাথা নিচু করতে হয়, তা প্রমাণিত হল।’’ বাম কৃষক নেতা হান্নান মোল্লার বক্তব্য, ‘‘অনেক দাবিতে আন্দোলন করলে তা দানা বাঁধে না। যদি নির্দিষ্ট দাবি থাকে এবং আদায় করবই, এই মেজাজ থাকে, তা হলে সেই আন্দোলনের জয় অনিবার্য। কৃষক আন্দোলন তা দেখিয়েছিল। ট্রাকচালকদের আন্দোলনে তা ফের এক বার প্রমাণিত হল।’’ আর সিটুর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য তপন সেনের কথায়, ‘‘এই সরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আন্দোলন করলে টের পাবে না। তাই যে ভাবে করা উচিত, সেই আন্দোলনই তাদের পিছু হটতে বাধ্য করছে। এটাই ভবিষ্যৎ।’’ তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী তথা রাজ্যসভার সাংসদ দোলা সেন আবার মনে করেন, শুধু এই দুই ক্ষেত্রেই নয়, মোদী সরকার অনেক জায়গাতেই পিছু হটেছে। তাঁর কথায়, ‘‘এই দুইয়ের পাশাপাশি সংসদে সংখ্যার দম্ভ দেখালেও ওরা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং শ্রমকোডের রুল তৈরি করতে পারেনি। ওই ক্ষেত্রেও পিছুই হটেছে মোদী সরকার। কারণ, ওরা মানুষের মেজাজ জানে না।’’

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য বলেছেন, ‘‘আমরা এখনও মনে করি কৃষি আইন সঠিক ছিল। কিন্তু যাঁদের জন্য আইন, তাঁরাই যদি না চান, তা হলে তা বাস্তবায়িত করবেন না বলে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভবিষ্যতে কৃষকেরাই চাইবেন ওই আইন হোক। ট্রাকচালকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কোনও সরকারের কাজ নয় জোর করে আইন চাপানো।’’

প্রসঙ্গত, বিজেপির মধ্যে এই আলোচনা অনেক দিনই রয়েছে যে, দলের কোনও শ্রমিক সংগঠন নেই। বিএমস আরএসএসের শ্রমিক শাখা। বিজেপির নয়। ফলে সেই সংগঠনে সরাসরি বিজেপির ‘নিয়ন্ত্রণ’ নেই। বিএমএস সেই অর্থে সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে অভিঘাত তৈরি করার মতো ট্রেড ইউনিয়ন নয়। ফলে তাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। বিজেপির কৃষক মোর্চা থাকলেও ‘গণসংগঠন’ হিসাবে তাদের যে সারা বছর সক্রিয় ভাবে দেখা যায়, তেমন নয়।

রাজনৈতিক মহলের অনেকের বক্তব্য, শাসকদল অনেক সময়ে ভাবে সরকারি পরিকাঠামো, আমলাতন্ত্র দিয়ে সবটা হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সিঙ্গুরের সময়েও একই জিনিস করেছিল বাংলার তদানীন্তন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকার। সেই সময়ে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘‘আমাদের কৃষকসভা কি ওখানে ঘুমোচ্ছিল?’’ আর হুগলির কৃষক নেতা অধুনাপ্রয়াত বলাই সাঁবুই সিপিএমের হুগলি জেলা দফতরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমলাদেরই তো কয়েক দিন পরে পার্টির নেতা করে দেবে মনে হচ্ছে!’’ মোদী সরকারকেও দু’টি ক্ষেত্রে পিছু হটতে হল বাস্তবে ‘হোঁচট’ খেয়ে।

আরও পড়ুন
Advertisement